তাঁকে বলা হতো ‘অলস জাদুকর’। মাঠে তাঁকে প্রায়ই অলস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। মাঠে দৌড়াদৌড়ি খুব বেশি করতেন না বলে তাঁর ব্যাপারে বিভ্রান্ত হতেন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা। কিন্তু বল নিয়ে যখন দৌড়াতেন, তা যেন সবুজ মাঠকে শিল্পীর ক্যানভাস বানিয়ে দিত। বল নিয়ে ধীরপায়ে তিনি জাদু দেখাতেন। অতুলনীয় মুগ্ধতা ছড়াতেন। তিনি হুয়ান রোমান রিকেলমে।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবা লিওনেল মেসির মতো তিনি আর্জেন্টিনার ‘১০ নম্বর’ জার্সি পরে খেলতেন। মেসির আগে আর ম্যারাডোনার পর যে কজন ফুটবলার আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সিকে আলাদা করে চিনিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে রিকেলমে শ্রেষ্ঠতম। একজন ১০ নম্বর জার্সিধারী ফুটবলারের যা কিছু গুণ প্রয়োজন, তার প্রায় সবকিছু রিকেলমের মধ্যে ছিল। ডিয়েগো ম্যারাডোনার দেখানো পথে মেসির আগে একে একে আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সি পেয়েছেন আরিয়েল ওর্তেগা, মার্সেলো গ্যালার্দো, পাবলে আইমার, আন্দ্রেস দি’আলেহান্দ্রোরা। প্রত্যেকেই ‘নতুন ম্যারাডোনা’ তকমা পেয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের সাধ্যমতো ‘ম্যারাডোনা’ হতে চাইলেও পারেননি। তবে এ সময় ‘ম্যারাডোনার সবচেয়ে কাছে’ বোধহয় যেতে পেরেছিলেন রিকেলমেই। কিন্তু এমন এক খেলোয়াড় আর্জেন্টিনার হয়ে তেমন কিছুই পাননি।
মেসি যখন ঝলক দেখানো শুরু করেছেন। ফুটবল দুনিয়ায় যখন আর্জেন্টিনার নতুন জাদুকরের কথা সবার মুখে মুখে ফেরা শুরু করেছেন, তখন রিকেলমে তাঁর ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে। ২০০৬ বিশ্বকাপে এ দুই তারকা একসঙ্গে আর্জেন্টিনা দলে ছিলেন। কিন্তু আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা সেভাবে মেসি–রিকেলমের ঝলক একসঙ্গে দেখতে পারেননি। ২০০৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ হোসে পেকারম্যানকে নিয়ে একটা অভিযোগ আছে সমর্থকদের। তিনি মেসি আর রিকেলমেকে একসঙ্গে খেলাতে চাননি কখনোই। আরও বড় অভিযোগ, তিনি রিকেলমেকে ঠিকমতো ব্যবহারই করেননি। ২০০৬ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে সেই কোয়ার্টার ফাইনালের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি কেউ। জার্মানির বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ১–০ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় কোচ রিকেলমেকে তুলে নিয়েছিলেন। দুর্দান্ত খেলতে থাকা রিকেলমেকে কেন তিনি তুলে নিয়েছিলেন, সেটি পরিষ্কার নয়। তবে বাস্তবতা হলো, রিকেলমেকে তুলে নেওয়ার ৮ মিনিটের মাথায় জার্মানি গোল শোধ করে ম্যাচ টাইব্রেকারে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারের দুর্ভাগ্য বরণ করে আর্জেন্টিনাকে বিদায় নিতে হয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই। এরপর মেসি নিজেকে মেলে ধরলেও রিকেলমে–মেসির জুটি কখনোই সেভাবে জমে ওঠেনি।
২০০৬ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে মেসি আর রিকেলমে ৭০ মিনিট একসঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচেও দুজন একসঙ্গে খেলেছিলেন প্রায় পুরো ম্যাচ। সে ম্যাচে প্রথম একাদশে ছিলেন না মেসি। ম্যাচের ৩৯ মিনিটের সময় মাঠে নামেন আর্জেন্টিনার আগামী দিনের সেরা তারকা। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে পেকারম্যানের কী হয়েছিল কে জানে! রিকেলমেকে দ্বিতীয়ার্ধে তুলেই নিলেন। মেসিকে সে ম্যাচে মাঠেই নামাননি তিনি।
ম্যারাডোনার পর আর্জেন্টিনার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাময় দুই তারকার একসঙ্গে খেলতে না পারার বেদনা আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা বয়ে নিয়ে বেড়ান সব সময়ই। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকেও দুজন একসঙ্গে আলো ছড়িয়েছিলেন। খেলেছেন ২০০৭ কোপা আমেরিকাতেও। কিন্তু আর্জেন্টিনার সমর্থকদের হয়তো আরও আনন্দ দিতে পারতেন তাঁরা। এই জায়গাতে একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে।
মেসি ও রিকেলমে একসঙ্গে আর্জেন্টিনাকে গৌরব এনে দিতে পারতেন ২০১০ বিশ্বকাপেই। কিন্তু সেটি হয়নি ডিয়েগো ম্যারাডোনার কারণে।
মেসি ও রিকেলমে একসঙ্গে আর্জেন্টিনাকে গৌরব এনে দিতে পারতেন ২০১০ বিশ্বকাপেই। কিন্তু সেটি হয়নি ডিয়েগো ম্যারাডোনার কারণে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তিনি সে বছর ১০৮ জন ফুটবলার ব্যবহার করলেও শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় সেরা দলটি নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। রিকেলমে ২০০৯ সালে ম্যারাডোনার ওপর অভিমান করে জাতীয় দল থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। ম্যারাডোনার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, তিনিই দল থেকে বাদ দিয়েছিলেন। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, রিকেলমে নাকি শারীরিক দিক দিয়ে মোটেও উপযোগী খেলোয়াড় নন। আর্জেন্টিনার নয়নের মণি হলেও আর্জেন্টাইন ফুটবলপ্রেমীরা ম্যারাডোনার এই কথা কোনো দিন মেনে নিতে পারেননি। মাত্র ২৭ ম্যাচে শেষ হয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা দলে মেসি–রিকেলমে জুটির গল্প। আর্জেন্টিনার হয়ে সাকল্যে ৫১ ম্যাচ খেলতে পেরেছেন রিকেলমে। ১৭টি গোল করে তিনি প্রমাণ রেখেছেন, আর্জেন্টিনার হয়ে আরও ম্যাচ খেলতে পারলে নিশ্চিতভাবেই দারুণ কিছু করে দেখাতে পারতেন।
খেলা ছাড়ার ৯ বছর পর আনুষ্ঠানিভাবে বিদায় সংবর্ধনা পেতে যাচ্ছেন রিকেলমে। আয়োজিত হতে যাচ্ছে তাঁর বিদায়ী ম্যাচ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রিকেলমের বিদায়ের ম্যাচে খেলবেন মেসি। আর রিকেলমে নিজে মেসিকে তাঁর বিদায়ী ম্যাচে পেয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত, ‘মেসির খেলা আমার জন্য স্বপ্নের মতো একটা ব্যাপার। দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড় সে। ম্যারাডোনা ও মেসির মতো দুই খেলোয়াড়কে পেয়ে আমরা আর্জেন্টাইনরা গর্বিত ও নিজেদের ভাগ্যবান মনে করি। আমার সৌভাগ্য যে আমি দুজনের সঙ্গেই খেলেছি।’
২০১৯ সালে রিকেলমের জন্য এমন একটা ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু মেসি সেবার থাকতে পারেননি। মেসি না থাকায় হয়নি সেই ম্যাচও। এবার বিশ্বকাপজয়ী মেসিকে নিয়েই আয়োজিত রিকেলমের বিদায়ী ম্যাচ। রিকেলমের কাছে যেটি ‘স্বপ্নের মতো’ ব্যাপার। কিন্তু এটা নিশ্চিত, আজকের এই বিদায়ী ম্যাচে দুজনকে একসঙ্গে দেখে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের আক্ষেপ নতুন করে দীর্ঘশ্বাস ছড়াবে।