‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও, যাও গো এবার যাবার আগে’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বিশ্বজোড়া ক্রিস্টিয়ানোর রোনালদোর ভক্ত-সমর্থকেরাও প্রিয় তারকার কাছে এটাই চেয়েছিলেন! তাঁরা চেয়েছিলেন, ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপটা রোনালদো ভরিয়ে তুলবেন নিজের আলোয়।
বয়স ৩৭ বছর হয়ে গেছে ঠিক, কিন্তু তাঁর আপন রঙে, ভেতরে লুকিয়ে থাকা চরম ইচ্ছাশক্তির গোপন রাগে তিনি বিশ্বকাপ রাঙাবেন—এমনটাই আশা ছিল রোনালদো-ভক্তদের!
রোনালদোও বিশ্বকাপ শুরুর আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন—বিশ্বকাপটা আপন রঙে রাঙাবেন। আর এর জন্য তিনি নিজেকে ভালোভাবে তৈরিও করে এসেছেন। কারও কারও ক্ষেত্রে নিজের সেরাটা বের করে আনতে নিজেকে তাতিয়ে তুলতে হয়। বিশ্বকাপে আসার আগে নিজেকে তাতিয়ে তোলার সেই অনুঘটক নিজেই ঢেলে দেন। ইংল্যান্ড থেকে কাতার আসার আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নিয়ে এক বোমা ফাটানো সাক্ষাৎকার দিয়ে বিতর্ক তৈরি করলেন নিজেই।
সেই বিতর্ক মাথায় নিয়ে বিশ্বকাপে পা রাখলেন। এ বা ও—সবাই এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। রোনালদোকে কাছে না পেয়ে পর্তুগাল দলের হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসতে থাকা সবাইকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকেন সাংবাদিকেরা।
ঘানার বিপক্ষে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচের আগে সংবাদমাধ্যমের সামনে আবির্ভূত হন রোনালদো। সেখানে তিনি তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে সতীর্থদের ‘বিরক্ত’ না করতে আহ্বান জানান সংবাদমাধ্যমকে। একই সঙ্গে বিশ্বজোড়া ভক্তদের উদ্দেশে বলে যান, ‘আমি বিশ্বকাপে বিশেষ মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য নিজেকে খুব ভালোভাবেই প্রস্তুত করেছি। আশা করছি ভালো কিছুই হবে।’
রোনালদোর প্রতিশ্রুতির পথ ধরে তাঁর ভক্তরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। অতীতে ফুটবলের অনেক মহারথিরই তো একটি বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তালিকাটা খুব একটা ছোট নয়—ইয়োহান ক্রুইফ, ইউসেবিও, লুইস ফিগো, ডেভিড বেকহাম, সক্রেটিস, জিকো...আরও কত নাম! হাল আমলেও তো একটি বিশ্বকাপ শিরোপার স্বপ্নে বিভোর লিওনেল মেসি বা নেইমার। রোনালদোরও স্বপ্ন ছিল—ফুটবলকে বিদায় জানানোর আগে একটি বিশ্বকাপ জিতবেন!
সেই স্বপ্ন পূরণের আশা নিয়েই মেসি-নেইমারের মতো কাতারে পা রেখেছিলেন রোনালদো। শুরুটাও ছিল আশাজাগানিয়া। ঘানার বিপক্ষে পর্তুগাল পেল ৩-২ গোলের জয়। ৬৫টি মিনিটে দলের প্রথম গোলটি এনে দিয়েছেন রোনালদোই। হোক না পেনাল্টি থেকে, তবু তো প্রতিশ্রুতি রেখে শুরুটা গোলের রঙে রাঙিয়েছেন তিনি!
উরুগুয়ের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে মনে হয়েছিল পর্তুগালের প্রথম গোলটি তাঁরই। ব্রুনো ফার্নান্দেজের ক্রস থেকে অসাধারণ একটি ক্রসে হেড করেছিলেন রোনালদো। প্রথমে তাঁর নামেই গোল দেওয়া হয়েছিল। পরে টিভি রিপ্লেতে বোঝা গেল, বল রোনালদোর মাথা স্পর্শ করেনি। গোলটি পেলে বিশ্বকাপে পর্তুগালের হয়ে সর্বোচ্চ গোলে ইউসেবিওকে (৯টি) ছুঁয়ে ফেলতেন তিনি। গোল পাননি গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচেও।
এরপর শেষ ষোলোতে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে দলের ৬-১ গোলের জয়ে কোচ ফার্নান্দো সান্তোস রোনালদোকে শুরুর একাদশেই রাখেননি। এ নিয়ে আবার বিতর্ক। পর্তুগালের পত্রিকা ‘রেকর্ড’ খবর ছাপে, শুরুর একাদশে না রাখায় রোনালদো নাকি কাতার ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন কোচকে। পরে অবশ্য রোনালদো আর পর্তুগাল ফুটবল ফেডারেশন জানায়, এ খবর সত্যি নয়!
আজ শেষ আটের ম্যাচে মরক্কোর বিপক্ষেও রোনালদোকে শুরুর একাদশে রাখেননি সান্তোস। ১-০ গোলে পিছিয়ে থেকে বিরতিতে যায় পর্তুগাল। দ্বিতীয়ার্ধে রোনালদোকে মাঠে নামান কোচ। রোনালদোর কাছে সুযোগ ছিল রাঙিয়ে দেওয়ার। গোলের রঙে রঙিন হয়ে ইউসেবিওকে ছুঁয়ে ফেলার, দলকে শেষ চারে তোলার। এটা করতে পারলে যে অনেক কিছুর জবাব দেওয়া হতো, একই সঙ্গে নিজের প্রতিশ্রুতিও রাখা যেত!
কিন্তু গোলের বেশ কয়েকটি সুযোগ পেয়েও পারলেন না রোনালদো।
মরক্কোর কাছে ১-০ গোলে হেরে শেষ আট থেকেই ছিটকে গেল পর্তুগাল। দলটির সোনালি প্রজন্মের শেষ সদস্যও কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিলেন বিশ্বকাপ থেকে। রোনালদোর কান্না ছুঁয়ে গেছে অনেককেই। চোখ মুছতে মুছতে টানেল দিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় তিনি হয়তো মনে মনে বলছিলেন—বড় বেরঙিন আজকাল, কাছাকাছি কোনো রং পাই না...কিছুই রাঙানো হলো না!
রোনালদোর ভক্ত, বিশ্বজোড়া ফুটবলপ্রেমীরা আর কী বলতে পারেন। শুধু এটুকুই হয়তো বলার আছে তাঁদের—বিদায় রোনালদো, শেষটায় আপনার আপন আর গোপন রাগে রঙিন হওয়া হলো না!