সালাহ ও মানে
সালাহ ও মানে

সালাহ, মানে, ওসিমেন, নাকি অন্য কেউ—আফ্রিকার সেরা হবেন কে

শুরুতেই ২০২২ সালের সেনেগাল–মিসর ফাইনালে ফিরে যাওয়া যাক। সেদিন শিরোপা লড়াইয়ে আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন দুই লিভারপুল সতীর্থ সাদিও মানে ও মোহাম্মদ সালাহ। নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত সময়েও গোলশূন্য ড্র থাকলে ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। প্রথম চার শটের তিনটিতেই গোল করে সেনেগাল, আর সালাহর মিসর সেদিন শুরুর চার শটের দুটিই মিস করে। তাই মানের পঞ্চম শটটা ছিল শিরোপা নির্ধারণী।

মানে যখন শটটা নিতে এগিয়ে আসছিলেন, উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় জার্সি দিয়ে নিজের মুখ ঢাকছিলেন সেই সময়ে তাঁর লিভারপুলের সতীর্থ সালাহ। নাহ্‌, মানে সেদিন পেনাল্টি মিস করেননি। গোলরক্ষক দিক ভুল না করলেও বুলেট গতির সেই শট থামানোর ক্ষমতা তাঁর ছিল না। দেশকে আফ্রিকান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট এনে দিয়ে মানে যখন উচ্ছ্বাসে ভাসছিলেন, হতাশায় জার্সিতে মুখটা পুরোপুরিই ঢেকে ফেলেছিলেন সালাহ। সেদিন দলের শেষ পেনাল্টিটা নিজের জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সালাহ। কিন্তু সেটি নেওয়ার সুযোগই পাননি ‘মিসরের রাজা’ খ্যাত এই ফরোয়ার্ড।

সালাহ–মানের জন্য দুই বছর পর আবার এল একই উপলক্ষ। মানের সামনে সুযোগ আরও একবার দেশকে শিরোপা জেতানোর। আর সালাহর লক্ষ্য দেশের হয়ে শিরোপা জিততে না পারার অপবাদ ঘোচানোর। তবে এই লড়াইয়ে এবার সালাহ–মানেই শুধু নন, আরও কিছু তারকা মাঠে নামবেন নিজ নিজ দেশকে শিরোপা জেতাতে। যাঁদের মধ্যে ভিক্টর ওসিমেন, সেরহাউ গুইরাসি ও ইউসেফ এন নেসিরি উল্লেখযোগ্য। এবারের আসরে তাঁরাও পারেন নিজ নিজ দেশের হয়ে ভাগ্য গড়ে দিতে।

মোহাম্মদ সালাহ, মিসর

লিভারপুল তারকা সালাহ প্রিমিয়ার লিগের বর্তমান সময়ের তো বটেই, বরং ইতিহাসেরও অন্যতম সেরা ফুটবলার। আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল আইকনও এখন ৩১ বছর বয়সী এই ফুটবলার। চলতি মৌসুমে সালাহ আছেনও দারুণ ছন্দে। লিগে এখন পর্যন্ত ১৪ গোল করে যৌথভাবে সবার ওপরে আছেন এই লিভারপুল তারকা। লিভারপুলের আক্রমণভাগে সালাহ এতটাই নির্ভরতা দিয়েছেন যে তাঁর দেশ মিসরের আগাম বিদায় প্রত্যাশা করার কথাও জানিয়েছেন লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। নিছক মজা করে এ কথা বলা হলেও এতে বোঝা যায় যখন যে দলেই খেলুন না কেন, সেই দলের জন্য সালাহ কতটা অপরিহার্য।

মোহাম্মদ সালাহ

জাতীয় দলে সালাহর অভিষেকের আগের বছরই সর্বশেষ আফ্রিকান শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা জিতেছিল মিসর (২০১০)। অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় রেকর্ড ৭ বারের চ্যাম্পিয়নরা গত ১৪ বছরে আর কোনো শিরোপা জিততে পারেনি। অথচ এর মধ্যে টুর্নামেন্টটি মাঠে গড়িয়েছে আরও ৬ বার, যেখানে মিসর ২ বার ফাইনালেও খেলেছে। কিন্তু সালাহ পাননি শিরোপার দেখা।

এমন ব্যর্থতায় সালাহর নামের পাশে ‘ক্লাব-তারকা’র তকমাও জুটে গেছে। এখানে একসময়কার লিওনেল মেসির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় সালাহর। পরপর দুই বছরে কোপা আর বিশ্বকাপ জিতে সেই অপবাদ ঘুচিয়েছেন মেসি। সালাহও কি তা পারবেন? সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর না দিলেও সালাহ বলে দিয়েছেন, ‘আমার দল ও আমি সাফল্যের জন্য মরিয়া।’

সাদিও মানে, সেনেগাল

২০২২ সালে শিরোপা জয়ের পর ট্রফি জড়িয়ে মানের শুয়ে থাকার দৃশ্যটি এখনো অমলিন। তাঁর হাত ধরে সেবারই প্রথম আফ্রিকান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছিল সেনেগাল। এমনকি ফাইনালে শিরোপা জয়ে শেষ শটটিও ছিল তাঁর। দলকে ট্রফি জিতিয়ে ২০২২ সালের ব্যালন ডি’অরে রানারআপও হয়েছিলেন মানে। এরপরই কিছুটা ধাক্কা খেয়েছেন। লিভারপুল ছেড়ে চলে যান বায়ার্ন মিউনিখে। সেই সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা প্রমাণ হয়েছে এক মৌসুমেই।

সেনেগালের সবচেয়ে বড় তারকা সাদিও মানে

বায়ার্নে টিকতে না পেরে দল বদলে মানে পাড়ি জমান সৌদি ক্লাব আল নাসরে। যেখানে এখন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে জুটি বেঁধে খেলছেন এই ফরোয়ার্ড। করছেন নিয়মিত গোল ও অ্যাসিস্টও। তবে দুই বছর আগের সেই মানে নিজের দ্যুতি এখন অনেকটাই হারিয়েছেন। এরপরও সেনেগালের মূল ভরসা মানেই। বড় মঞ্চে কীভাবে জ্বলে উঠে দলকে জেতাতে হয়, সেটা তাঁর ভালোই জানা। আরও একবার তাই মানেকে ঘিরেই বড় স্বপ্ন বুনছে সেনেগাল।

ভিক্টর ওসিমেন, নাইজেরিয়া

সালাহ–মানের পর আফ্রিকার অন্যতম আলোচিত তারকা ওসিমেন। আফ্রিকার বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের তকমা নিয়েই এবার নাইজেরিয়ার হয়ে শিরোপা সন্ধানে নামবেন এই নাপোলি তারকা। গত মৌসুমে নাপোলির লিগ শিরোপা পুনরুদ্ধারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ওসিমেনের। নাপোলির হয়ে সেবার সব মিলিয়ে করেছিলেন ২৬ গোল। চলতি মৌসুমে ওসিমেন অবশ্য কিছুটা খুঁড়িয়ে চলছেন।

আফ্রিকা মহাদেশের সেরা ফুটবলার ভিক্টর ওসিমেন

সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এখন পর্যন্ত খেলা ১৮ ম্যাচে করেছেন ৮ গোল। এ জন্য অবশ্য তাঁর নিজের চেয়ে ক্লাবের ভেতর চলতে থাকা অস্থিরতাই বেশি দায়ী। আর ক্লাবের অপূর্ণতাটুকু ওসিমেন হয়তো এবার জাতীয় দলের জার্সিতেই পূর্ণ করতে চাইবেন। সে সঙ্গে নাইজেরিয়াকে চতুর্থ শিরোপার স্বাদ এনে দিতে নিজের সেরাটাও উজাড় করে দেবেন ওসিমেন। এর আগে সর্বশেষ আসরে চোটের কারণে দর্শক হয়ে থাকতে হয়েছিল ওসিমেনকে।

ইউসেফ এন নেসিরি, মরক্কো

২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলে সবাইকে চমকে দিয়েছিল মরক্কো। সেটি ছিল কোনো আফ্রিকান দেশের ইতিহাস সেরা পারফরম্যান্স। এবারও আগ্রহের কেন্দ্রে আছে মরক্কো। বিশ্বকাপে ফুল-ব্যাক আশরাফ হাকিমি আর উইঙ্গার হাকিম জিয়েশ মূল তারকা হলেও দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল করার কাজটি করেছিলেন ইউসেফ এন নেসিরি।

এন–নেসিরি

২৬ বছর বয়সী এই সেভিয়া তারকা এবার আফ্রিকান নেশনস কাপেও মরক্কোর মূল ভরসা। আক্রমণভাগে তাঁর পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করছে দলের অনেক কিছু। এখন অপেক্ষা শুধু আসল লড়াইয়ে জ্বলে ওঠার। আর নেসিরির জ্বলে ওঠা মানেই এ লড়াইয়ে মরক্কোর সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাওয়া।

সেরহাউ গুইরাসি, গিনি

আফ্রিকান অঞ্চলেও গিনি কোনো পরাশক্তি নয়। ২০১৫ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা বাদ দিলে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের তেমন কোনো সাফল্য নেই। এবার সেনেগাল, ক্যামেরুন ও গাম্বিয়ার গ্রুপ থেকে পরের রাউন্ডে যাওয়াও হতে পারে বড় চ্যালেঞ্জ। এরপরও একজন খেলোয়াড়ের কারণে বিশেষভাবে আলোচনায় আছে গিনি। তিনি সেরহাউ গুইরাসি।

সেরহাউ গুইরাসি

ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া ২৭ বছর বয়সী এই তারকা বুন্দেসলিগায় এবার দারুণ ছন্দে আছেন। স্টুটগার্টের হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১৬ ম্যাচে করেছেন ১৯ গোল, যেখানে আছে দুটি হ্যাটট্রিকও। এমন দুর্দান্ত ছন্দে থাকা খেলোয়াড় একাই যেকোনো দলের ভাগ্য বদলে দিতে পারেন। এখন ক্লাবের ছন্দ গুইরাসি জাতীয় দলের জার্সিতে নিয়ে যেতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।