ইউরোপিয়ান ফুটবল দেখার সুবাদে করিম বেনজেমার নৈপুণ্য বারবারই আমার চোখ কাড়ে। তাই নড়েচড়ে বসেছিলাম বিশ্বকাপেও তাঁর ঝলক দেখব বলে। বেনজেমা ও কিলিয়ান এমবাপ্পে মিলে ফ্রান্সের আক্রণভাগে ঝড় তুলবেন বলেই আমার বিশ্বাস ছিল। আমি তো প্রথম আলোয় লেখা কলামে এবার সোনার বুটের লড়াইয়ে শীর্ষ দুইয়ে এমবাপ্পের পর বেনজেমাকেই রেখেছিলাম। অথচ বিশ্বকাপ শুরুর দিনেই কিনা এত বড় দুঃসবাদ! বেনজেমার চোটের খবর অন্য সবার মতো আমাকেও ব্যথিত করেছে।
এমনিতেই ফ্রান্সের মাঝমাঠ থেকে পল পগবা, এনগোলা কন্তে চোটে পড়ে আগেই ছিটকে গেছেন। সর্বনাশা চোট বেনজেমাকেও ছিটকে ফেলায় বিশ্বকাপের আকর্ষণে কিছুটা টান পড়ল বৈকি। কিছুটা দুর্বলও হলো ফরাসি আক্রমণ। এখন এমবাপ্পের ওপর চাপ বাড়ল। বেনজেমার বিদায়ে সেরা গোলদাতার লড়াইয়ে হ্যারি কেইন এগিয়ে আসতে পারেন, যদি ইংল্যান্ড দলটা ভালো করে মাঠে।
অন্যবারের চেয়ে এবার ফুটবলারদের চোটের প্রবণতা বাড়বে বলে আগেই অনুমান করেছিলাম। কারণ, ইউরোপের ব্যস্ত সূচি। অন্যবার বিশ্বকাপের আগে ফুটবলাররা ২০–২৫ দিন বিশ্রাম নিতে পারতেন। এবার সেটা হয়নি। লিগ খেলেই দলগুলোকে আসতে হলো কাতারে। তার ওপর ম্যাচের সূচি বেশ ঠাসা। ফলে বিশ্রামেরও সময় কম। সবকিছু মিলিয়ে চোটজর্জর একটা অবস্থা, যা কমবেশি সব দলেই আছে।
এ অবস্থার জন্য অনেকে দায়ী করছেন ইউরোপের ফুটবলের ব্যস্ত সূচিকে। বলা হচ্ছে, এভাবে কেন বিশ্বকাপ হচ্ছে? ইউরোপের মিডিয়া নানা প্রশ্ন তুলছে। কাতারে অনেক গরম—এ রকম অনেক কিছুকে বড় করে দেখাচ্ছে।
আরে, বিশ্বকাপ তো পৃথবীর সব অঞ্চলেই হতে হবে। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকায় বিশ্বকাপ হয়েছে। এশিয়ায় আগে একবার হয়েছে, এখন হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। আর মধ্যপ্রাচ্য, মানে কাতার অতীতের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি খরচ করছে। এখন ইউরোপ যদি বলে এশিয়ায় গরম, এখানে বিশ্বকাপ দেওয়া ঠিক হয়নি, তাহলে এশিয়াও তো বলতে পারে ইউরোপে অনেক ঠান্ডা। আমরা ইউরোপে খেলব না। এসব আসলে কোনো যুক্তি হলো না।
কাতারে যে বিশ্বকাপ হবে, সেটা তো অনেক আগে থেকেই জানা। এমন তো নয় যে হঠাৎ করে কেউ বলল চলো বিশ্বকাপ খেলি। সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করা। দলগুলো সেভাবে তাদের পরিকল্পনা সাজানোর অনেক সময় পেয়েছে। এখন কাতারের ছিন্দ্রানুসন্ধান করার কোনো মানে নেই, অথচ হচ্ছে। ইউরোপের লিগগুলো আরও আগে বন্ধ করা উচিত ছিল কি না, তা নিয়ে কথা উঠছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করা আমার জন্য বোকামি হবে। টক শোতে বসে কথা বলা সহজ।
আমাদের দেশেও যেটা হয়, টক শোতে বাফুফের বিরুদ্ধে নানা কথা বলে অনেকে। কিন্তু বিশ্বকাপের ফিকশ্চার, সূচি যাঁরা করেছেন, তাঁরা আমাদের চেয়ে কম বোঝেন না। অনেক গবেষণা করেই এগুলো তাঁরা করেছেন। ঠিক কোন সময়ে ম্যাচগুলো করলে ভালো হয়, সেটা ঠিক করতে অনেক চিন্তাভাবনা হয়েছে। জেনে–বুঝেই সূচি করা হয়েছে। ওই বিশেষজ্ঞরা আমাদের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি বোঝেন। ফলে তাঁদের সমালোচনা করা আমাদের মানায় না।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে আমি কিছু বিষয় কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের দেশে ক্লাবগুলো সকালবেলা উঠে ফিকশ্চার বদল করার দাবি তোলে। নানা রকম ওজর–আপত্তি করে। আজ খেলব না, অমুক খেলোয়াড়ের চোট, সূচি বদলাও ইত্যাদি সমস্যা দেখাতে থাকে। কিন্তু বিশ্বকাপে সেটা সম্ভব নয়।
ফিফার সঙ্গে কাজ করার সুবাদে এটা বলতে পারি, ফিফা এখন পর্যন্ত যা করেছে, ঠিক করেছে। ফিফা তো আসলে আলাদা কিছু নয়। আমরা সদস্যদেশগুলো ভোট দিয়ে ফিফার বোর্ড তৈরি করি। সেখানে সবার মতামত থাকে। আমাদের ভোটে নির্বাচিত ফিফা সভাপতি পরশু সংবাদ সম্মেলন করে কাতারের সমালোচনা করায় ইউরোপকে ধুয়ে দিয়েছেন। তাঁর সব কথার সঙ্গেই আমি একমত। সঠিকভাবেই সব বলেছেন ফিফা সভাপতি।