শেষ কবে আর্জেন্টিনা এমন ফুরফুরে মেজাজে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল!
এবারের কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা খেলতে যাচ্ছে টানা ৩৬ ম্যাচে অপরাজিত থেকে। তাদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স, খেলোয়াড়দের ফর্ম, দেড় বছর আগে কোপা আমেরিকা জয়ের গৌরব, আর্জেন্টিনাকে এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিটের তকমা দিচ্ছে। কোচ লিওনেল স্কালোনির পরিকল্পনায় আবেগ নয়, যুক্তিযুক্ত কারণেই মনে হচ্ছে, বিশ্বকাপটা এবার জিততে পারে লিওনেল মেসির দল। আর্জেন্টিনাকে এমন দল কীভাবে বানালেন স্কালোনি? আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ফুটবল সাংবাদিক মার্সেলা মোরা আরাউহোর মতে, স্কালোনির হাতে আর্জেন্টিনা ভালো দল হয়ে ওঠার মূল কারণ, তিনি কখনোই লিওনেল মেসি-নির্ভর দল তৈরি করতে চাননি।
২০১৮ সালে রাশিয়ার বিশ্বকাপে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল আর্জেন্টিনা। গ্রুপ পর্বে আইসল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করার পর ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে তারা রীতিমতো ধরাশায়ী হয় ৩-০ গোলে হেরে। গ্রুপের শেষ ম্যাচে নাইজেরিয়ার সঙ্গে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে ২-১ গোলে জিতে কোনোমতে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে তারা। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে বিদায় নেন মেসিরা। বিশ্বকাপের পরপরই হোর্হে সাম্পাওলিকে বিদায় বলে দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব দেওয়া হয় পাবলো আইমার ও লিওনেল স্কালোনিকে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে পাকাপাকিভাবে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় স্কালোনির হাতে।
সে সময় সমালোচনা কম হয়নি। স্কালোনি আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ হওয়ার যোগ্য কি না, সমালোচনাটা ছিল সেটি নিয়েই।
তবে স্কালোনির আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব-২১ দল নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা দারুণভাবে কাজে এসেছে জাতীয় দলের কোচের দায়িত্বে। মোরা আরাউহো মনে করেন, তরুণ ফুটবলারদের সঙ্গে তাঁর কাজ করার অভিজ্ঞতা স্কালোনিকে সাফল্য এনে দিয়েছে।
আরাউহোর মতে, স্কালোনি প্রথম থেকেই একটা বিশেষ কৌশলে আর্জেন্টিনা দলটাকে সাজিয়েছেন। অতীত থেকে শিক্ষাই নিয়েছিলেন তিনি। এর আগে ডিয়েগো ম্যারাডোনা, সের্হিও বাতিস্তা, আলেহান্দ্রো সাবেয়া, হোর্হে সাম্পাওলি—জাতীয় দলের প্রত্যেক কোচই নিজের কৌশল সাজিয়েছিলেন মেসিকে মধ্যমণি ভেবে। ফলে যা হবার, তা-ই হয়েছিল। মেসি যেদিন নিষ্প্রভ থাকতেন, গোটা দলই ম্লান হয়ে যেত। মেসির বাজে দিন মানেই ছিল আর্জেন্টিনার বাজে দিন।
সেই সময় প্রতিপক্ষের জন্য আর্জেন্টিনার কৌশল সাজানোও খুব সহজ হয়ে যাচ্ছিল। মেসিকে আটকে দাও, আটকে যাবে আর্জেন্টিনা! স্কালোনি সেটি মাথায় রেখেছিলেন। তিনি আর্জেন্টিনা দলকে একটা দল হিসেবে দাঁড়া করাতে চেয়েছেন। মেসিকে দলের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ বানিয়েছেন, তাঁকে মূল চালিকাশক্তি বানাননি। ২০১৮ বিশ্বকাপের পরপর আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে মেসির কিছুদিনের অনুপস্থিতি স্কালোনিকে খুব সাহায্য করেছিল। তিনি মেসিকে ছাড়াই পরিকল্পনা তৈরি করা আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন।
আরাউহো তাঁর বিশ্লেষণে বলেন, ‘আমি মনে করি স্কালোনির সেই ভাবনাটা দারুণ ছিল। তিনি এমন একটা দল সাজাতে চেয়েছিলেন, যাতে আর্জেন্টিনায় খেলা খেলোয়াড়দেরই প্রাধান্য থাকবে। দলের খেলোয়াড়েরা হবেন দারুণ প্রতিভাবান, কিন্তু খুব বেশি পরিচিতি নেই তাদের। মেসি থাকবেন, তিনি থাকবেন নিজের আলোতেই, দলের মূল শক্তি হিসেবে নন। তিনি এমন একটা দল বানাতে চেয়েছিলেন, যে দলটি তথাকথিত মহাতারকাদের ছাড়াই স্বচ্ছন্দে লড়ে যেতে পারে।’
আরাউহো নিজেও স্কালোনির নিয়োগে খুশি হতে পারেননি। সেটি তিনি স্বীকার করেছেন। তিনিও বিরক্ত ছিলেন ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর হাই প্রোফাইল কাউকে নিয়োগ না দিয়ে স্কালোনির মতো আপাত অখ্যাত একজনকে নিয়োগ দেওয়ায়। কিন্তু স্কালোনি নিজের লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। তিনি দায়িত্ব পেয়েই নিজের সহযোগী হিসেবে বেছে নেন ওয়াল্টার স্যামুয়েল ও রবার্তো আয়ালাকে। দুজনই আর্জেন্টিনার জার্সিতে খেলেছেন। নিজেদের কাজটা তাঁরা খুব ভালো বোঝেন। তিনজনের মধ্যে রসায়নটা গড়ে উঠল দারুণ। তিনজনই পরস্পরের চাওয়াটা ভালো বুঝতেন। স্যামুয়েল আর আয়ালা স্কালোনির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছিলেন আদর্শ দুই সঙ্গী। তাঁরা তিনজন মিলে দলে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করলেন, খেলোয়াড়দের এমন একটা অভ্যাস গড়ে তুললেন, যাঁরা মেসিকে ছাড়াই জিততে পারে। যাঁরা মাঠে মেসির দিকে তাকিয়ে থাকে না।
মেসি আর্জেন্টিনা দলে ফিরে নিজেকে স্কালোনির পরিকল্পনার সঙ্গে মেশালেন। ব্যাপারটাতে পিএসজি তারকা খুশিই হয়েছিলেন। কারণ, স্কালোনির পরিকল্পনা তাঁকে ভারমুক্ত করল। আগে যেমন গোটা দলের চাপ তিনি একাই নিতেন, পরিস্থিতিটা তেমন রইল না। মেসি অনেকটাই স্বাধীনভাবে নিজেকে মেলে ধরতে লাগলেন। যার ফল ২০২১ সালের জুলাইয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা। ১৯৯৩ সালের পর এটাই তাদের প্রথম কোনো শিরোপা জয়।
স্কালোনি এরই মধ্যে ইতিহাস গড়েছেন। কাতারে যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তাঁর নাম হয়তো ইতিহাসে সিজার লুই মেনোত্তি ও কার্লোস বিলার্দোর সঙ্গেই উচ্চারিত হবে।