মৌসুম শেষ। লিভারপুল স্কোয়াডের অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গেছেন। কেউ আবার মাঠে জাতীয় দলের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। শুধু একজনের সামনে ক্লাব ফুটবলের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। বলা যায়, তাঁর জন্য মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। কিন্তু সেটি লিভারপুলের হয়ে নয়!
অ্যান্ডারসন আরোয়োকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। পরশু রাতে লা লিগায় ওঠার প্লে–অফ ফিরতি লেগ ম্যাচে লেভান্তের বিপক্ষে ১২৯ মিনিটে পেনাল্টি থেকে করা গোলে জিতেছে আলাভেস। ১–০ গোলের এই জয়ে লা লিগায় উঠে এসেছে ক্লাবটি। অ্যান্ডারসন আরোয়োর জন্য এটাই ছিল মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। কিন্তু পোড়া কপাল তাঁর—স্কোয়াডে থাকলেও আলাভেস কোচ লুইস গার্সিয়া কলম্বিয়ান এ ডিফেন্ডারকে বদলি হিসেবেও মাঠে নামাননি।
নিশ্চয়ই ভ্রুকুটি তুলে ভাবছেন, লিভারপুলের কথা বলে লা লিগার প্লে–অফ ম্যাচের প্রসঙ্গ টেনে আনার কী হেতু?
আসলে অ্যান্ডারসন আরোয়োর কপাল কত খারাপ, তা বোঝাতে এই ম্যাচের প্রসঙ্গ টানা হয়েছে। আর আলাভেসে তাঁকে ধারে পাঠিয়েছে লিভারপুল।
কৌতূহলী হয়ে কেউ কেউ আরোয়োর উইকিপিডিয়া পেজে ঢুঁ মারতে পারেন। সেখানে তাঁর ক্লাব পরিসংখ্যানে তাকালেই খটকাটা লাগে। কলম্বিয়ান ক্লাব ফোর্তালেজা থেকে ২০১৮ সালে তাঁকে কিনেছিল লিভারপুল। কিন্তু ক্লাবের এই পরিসংখ্যানে কোথাও লিভারপুলের নাম লেখা নেই। ফোর্তালেজায় খেলেছেন ৩ বছর, ২০১৮ সালে লিভারপুলে নাম লেখানোর পর দ্রুতই তাঁকে স্পেনের চতুর্থ বিভাগে খেলা মায়োর্কা ‘বি’ দলে ১৮ মাসের জন্য ধারে পাঠিয়েছিল লিভারপুল।
২০১৮–১৯ মৌসুমেও অ্যানফিল্ডে ফেরা হয়নি। বেলজিয়ান ক্লাব গেন্টে তাঁকে আবারও ধারে পাঠায় লিভারপুল। সেখান থেকে ২০১৯–২০ মৌসুমে গেলেন চেক প্রজাতন্ত্রের ক্লাব মালদা বোলেস্লাভে। পরের মৌসুমেও তাঁকে ফেরায়নি লিভারপুল। ২০২০–২১ মৌসুমে আরোয়োর ঠিকানা হয় স্পেনের চতুর্থ বিভাগে খেলা দল সালমানাকা। সেখান থেকেও ধারে স্পেনের দল মিরান্দেস ঘুরে গত ৯ জুলাই আলাভেসে ধারে যোগ দেন আরোয়ো। পাঁচ বছর আগে লিভারপুলে শুধু সইটাই করেছিলেন ২৩ বছর বয়সী এ ডিফেন্ডার। লিভারপুলের হয়ে কখনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে মাঠে নামতে পারেননি।
আরোয়োর নিশ্চয়ই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটা পড়া নেই।
পড়া থাকলে এ পাঁচ বছরজুড়ে ধারে খেলতে খেলতে আরোয়ো নিশ্চয়ই অনুধাবন করতেন সুনীলের ওই কবিতার সেই চরণটির তাৎপর্য, ‘নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো/আমার মাথা এ ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে/তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে?’ কবিতাটা পড়া থাকলে আরোয়োও হয়তো চরণটির অনুকরণে অ্যানফিল্ডের ক্লাবটির কাছে জানতে চাইতে পারতেন, ‘ওহে লিভারপুল, আমি আর কত ধারে খেলব...তারপর তুমি আমায় মাঠে নামাবে?’
ব্যাপারটা কল্পনাপ্রসূত হলেও আরোয়োর বাস্তবতা মোটেই এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। লিভারপুলে যোগ দিয়ে এই পাঁচ বছরে ছয়টি ক্লাবে ধারে খেলেছেন। কিন্তু মূল ক্লাবের হয়ে একটি ম্যাচও খেলার সুযোগ পাননি। সাধারণত ধারে পাঠালে খেলোয়াড়েরা ভালো খেলে মূল ক্লাবকে বুঝিয়ে দিতে চান তারা কী মিস করেছে!
হার্ভে এলিয়ট ও হ্যারি উইলসনদের ক্ষেত্রে লিভারপুলে তাই ঘটেছে। নিয়মিত ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দিতে তাদের ধারে পাঠিয়েছিল লিভারপুল। নিজেকে প্রমাণ করে লিভারপুলে ফিরে অবস্থানও সুসংহত করেছেন তাঁরা। কিন্তু আরোয়োর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। অবশ্য ধারে খেলা ক্লাবগুলোয় আরোয়ো যে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছেন, সেটাও নয়। এই পাঁচ বছরে ছয়টি ক্লাবের হয়ে আহামরি কোনো পারফরম্যান্স নেই আরোয়োর। ম্যাচ খেলার সংখ্যাও সন্তোষজনক নয়—৫ বছরে ৯৩।
ইকুয়েডরে অনুষ্ঠিত ২০১৭ দক্ষিণ আমেরিকান অনূর্ধ্ব–২০ চ্যাম্পিয়নশিপে লিভারপুল স্কাউটদের নজরে পড়েছিলেন আরোয়ো। তাৎক্ষণিকভাবে লিভারপুল তাঁকে সই করায় কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট না থাকায় তাঁকে স্পেনের মায়োর্কায় ধারে পাঠানো হয়।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাক মৌসুম সফরে তাঁকে লিভারপুলের স্কোয়াডে রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। কিন্তু চোটের কারণে তখন ৬ মাস মাঠের বাইরে থাকতে হয়। তাই সে যাত্রায় আরোয়োর আর লিভারপুলের হয়ে খেলা হয়নি।
ইংল্যান্ডে এখনো ওয়ার্ক পারমিট নেই আরোয়োর, লিভারপুলের হয়ে খেলতে না পারার এটাও একটা কারণ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, লিভারপুল এরপরও গত মৌসুম শেষে তাঁর সঙ্গে ২০২৫ সাল পর্যন্ত নতুন চুক্তি করেছে! আর আরোয়োরও লিভারপুলের হয়ে একদিন খেলার আশা। ২০২০ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ফুটবল ইনডেক্স’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘লিভারপুলের হয়ে অভিষিক্ত হওয়াই আমার লক্ষ্য ও স্বপ্ন।’
তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও আরোয়োর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সামনে হবে কি না, কে জানে!