মোহামেডান ক্লাবের সেই দিন কি একেবারেই গেছে
মোহামেডান ক্লাবের সেই দিন কি একেবারেই গেছে

মোহামেডানের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে

২০১৯ সালের শেষ দিকে ক্যাসিনো-কাণ্ডের পর বদলে যায় মোহামেডান। ক্লাবের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে বিদায় নিতে হয়। বিদায় নেন দীর্ঘদিন দলের ম্যানেজার পদে থাকা আমিরুল ইসলামও। ঢাকঢোল পিটিয়ে নতুন নেতৃত্ব আসে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। সাবেক খেলোয়াড়েরা প্রিয় ক্লাবের দুর্দিনে হাল ধরতে এগিয়ে আসেন। কেমন দুর্দিন? ২০০২ সালের পর ঘরোয়া লিগ জিততে পারেনি মোহামেডান, এর মধ্যে অবনমনের শঙ্কাও জেগেছে কখনো কখনো।

নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর সাদা–কালো সমর্থকেরা আশায় বুক বাঁধেন, অবস্থার বদল হবে। মোহামেডান আবার ‘মোহামেডান’ হয়ে উঠবে। মাঠে নামবে জেতার জন্য, ঘরে আনবে শিরোপা। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা মোহামেডানকে এভাবেই তো দেখে এসেছেন সমর্থকেরা।

কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। এখন প্রশ্ন জাগছে, মোহামেডানের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে? মোহামেডান মাঠে এখন রাজ্য হারানো রাজার মতোই। নামটা বাদ দিলে ছোট দলগুলোর সঙ্গে যেন কোনো পার্থক্য নেই তাদের।

‘সভায় আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নেব। সেই সিদ্ধান্ত কী হবে, জানতে অপেক্ষা করুন।’
আবু হাসান চৌধুরী, মোহামেডানের ফুটবল সম্পাদক

এই মৌসুমের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে পয়েন্ট টেবিলের দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্ট। ৯ ম্যাচে মাত্র দুটি জয় মোহামেডানের। ৩ ড্র আর ৪ হারে ৯ পয়েন্ট নিয়ে লিগের পয়েন্ট তালিকায় অবস্থান সাতে। স্বাধীনতা কাপে বিদায় নিয়েছে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। জয় দুটি, দুটি হার। ফেডারেশন কাপে তুলনামূলক ভালো করেছে। তিন ম্যাচের দুটি জয়। অন্য ম্যাচটা ড্র করে গ্রুপসেরা হয়ে উঠেছে শেষ আটে। সব প্রতিযোগিতা মিলে মৌসুমে ১৬ ম্যাচ খেলে এখন পর্যন্ত ৬ জয় মোহামেডানের। ৫ ড্র, ৬টি হার।

বড় দলের কোনো বৈশিষ্ট্যই এখন আর নেই মোহামেডানের

সর্বশেষ হার গতকাল কুমিল্লায় প্রিমিয়ার লিগে নবাগত ফর্টিস এফসির কাছে। ২ গোলে এগিয়েও মোহামেডান হেরেছে ৪-৩ গোলে। আর এই হার হজম করতে পারছে না টিম ম্যানেজমেন্ট। আজ বিকেলে ক্লাবের টেকনিক্যাল কমিটির জরুরি সভা ডাকা হয়েছে, যে কমিটির নেতৃত্বে আছেন সাবেক তারকা ইমতিয়াজ সুলতান জনি। এ সভার কথা জানিয়ে ক্লাবের ফুটবল সম্পাদক আবু হাসান চৌধুরী অন্য রকম ইঙ্গিতই যেন দিয়ে রাখলেন, ‘সভায় আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নেব। সেই সিদ্ধান্ত কী হবে, জানতে অপেক্ষা করুন।’

তাহলে কি কোচ শফিকুল ইসলাম মানিককে বদল করা হবে? আবু হাসান খোলাখুলি কিছু না বলে রহস্য রাখলেন। মোহামেডানের সব আশা শেষ, তা অবশ্য নয়। লিগে ১১ ম্যাচ বাকি। তবে প্রশ্নটি উঠে পড়েছে। ক্যাসিনো–কাণ্ডের পর আসলে কী পরিবর্তন হলো ক্লাবটিতে?

“আমরা তো টিম বানাতে পারলাম না। কেন পারলাম না, সেটা আমাদের ব্যর্থতা”। এসব শুনে আসলে আক্ষেপ করা ছাড়া কী করার আছে। আসলে খেলোয়াড় দলে নেওয়াই ঠিকঠাক হয়নি।’
গোলাম সারোয়ার টিপু, মোহামেডানের সাবেক তারকা ও কোচ

সাদা–কালোর সাবেক তারকা ফুটবলার ও কোচ গোলাম সারোয়ার টিপুর মনেও প্রবলভাবে আসছে প্রশ্নটি, ‘মোহামেডান সেই মিডিওকর (মাঝারি মানের) দলই রয়ে গেছে। অথচ ক্লাবের কমিটি যখন হলো তা বেশ প্রচারে এসেছে। কমিটি করে তো লাভ নেই। মাঠে পারফর্ম করতে হবে। সেটা তারা করতে না পারল না। লিগে ৯ ম্যাচে মাত্র দুটি জয় ভালো লক্ষণ নয়। অন্তত ৭-৮টা ম্যাচ জেতা উচিত ছিল। মাঠের খেলাতেই যদি বদল না হয়, তাহলে নেতা বদল করে কী লাভ হলো? আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। এভাবে চললে মোহামেডান হয়তো ওয়ান্ডারার্সের পথে চলে যাবে।’

মোহামেডানের নামের সঙ্গে এই পারফরম্যান্স যায় না বলছেন পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলা সাবেক এই ফুটবলার, ‘এখন যদি বলা হয় অমুক খেলোয়াড়কে টাকা দেওয়ার পরও চলে গেছে, এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই। কেন তারা ভালো টিম বানাতে পারল না, এর ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত।’

সাবেক তারকারাও পতন ঠেকাতে পারছেন না মোহামেডানের

গোলাম সারোয়ার আরও বলেন, ‘মোহামেডানের টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যুক্ত এক সাবেক খেলোয়াড় আমাকে বলল, ক্লাবের ভেতরে কিছু সমস্যা আছে। সে এভাবে বলল, “আমরা তো টিম বানাতে পারলাম না। কেন পারলাম না, সেটা আমাদের ব্যর্থতা”। এসব শুনে আসলে আক্ষেপ করা ছাড়া কী করার আছে। আসলে খেলোয়াড় দলে নেওয়াই ঠিকঠাক হয়নি।’

‘আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম লিগে তিন–চারে থাকব। সেটা হবে কি না, জানি না। আসলে টাকা থাকলেও সে রকম খেলোয়াড় নেই। এবার আমাদের বোর্ড গতবারের চেয়ে ভালো দল করতে চেয়েছিল। জাতীয় দলের ডিফেন্ডার রহমত আর রিয়াদুলকে টাকা দিয়েছে। কিন্তু দিলেও ওরা আবাহনীতে চলে গেছে। আমরা যে বিদেশি খেলোয়াড়দের নিয়েছি, ভালো হয়নি। ইরান, ভেনেজুয়েলা থেকে খেলোয়াড় এনে লাভ হয়নি। একমাত্র মালির স্ট্রাইকার দিয়াবাতে প্রতিষ্ঠিত। সে ভালো করছে। আসলে বিদেশি আর দেশিদের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে না। ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল নেই।’
সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির, মোহামেডানের সাবেক তারকা ফুটবলার

মোহামেডান সমর্থকেরা জানতে চান না কে কর্মকর্তা, জানতে চান দলে খেলোয়াড় কে? মোহামেডানে তেমন ফুটবলার নিতে পারেনি। এর বড় কারণ, খেলোয়াড়সংকট। বসুন্ধরা কিংস প্রথম সারির অনেক খেলোয়াড় নিয়ে বসিয়ে রাখে। ফলে অন্যরা চাইলেও পছন্দের খেলোয়াড় নিতে পারে না। মোহামেডান এবার জাতীয় দলের স্ট্রাইকার সাজ্জাদ হোসেনকে নিয়েছে, কিন্তু তিনি বলার মতো কিছু করতে পারেননি। বসুন্ধরা কিংসের ছেড়ে দেওয়া মাহবুবুর রহমান সুফিল, আলমগীর রানাদের নিলেও ভাগ্য ফেরেনি সাদা–কালোর। দলে আছেন জাতীয় দলের ফরোয়ার্ড জাফর ইকবালও।

‘রেফারিং সম্পর্কে অভিযোগ করব না। তবে রেফারিদের অনিচ্ছাকৃত কিছু ভুলের খেসারত দিয়েছি আমরা। তারপরও বলব, খুব হতাশার কিছু নেই। লিগে হয়তো ভালো করব না। শেখ জামাল, চট্টগ্রাম আবাহনীও ভালো করছে না। তবে সামনে দ্বিতীয় পর্ব আছে। জানি সমর্থকেরা হতাশ। তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। আস্থা রাখুন, ফেডারেশন কাপ রয়ে গেছে।’
শফিকুল ইসলাম মানিক, মোহামেডানের সাবেক খেলোয়াড় ও বর্তমান দলের কোচ

মোহামেডানের টেকনিক্যাল কমিটির অন্যতম সদস্য সাবেক তারকা সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম লিগে তিন–চারে থাকব। সেটা হবে কি না, জানি না। আসলে টাকা থাকলেও সে রকম খেলোয়াড় নেই। এবার আমাদের বোর্ড গতবারের চেয়ে ভালো দল করতে চেয়েছিল। জাতীয় দলের ডিফেন্ডার রহমত আর রিয়াদুলকে টাকা দিয়েছে। কিন্তু দিলেও ওরা আবাহনীতে চলে গেছে। আমরা যে বিদেশি খেলোয়াড়দের নিয়েছি, ভালো হয়নি। ইরান, ভেনেজুয়েলা থেকে খেলোয়াড় এনে লাভ হয়নি। একমাত্র মালির স্ট্রাইকার দিয়াবাতে প্রতিষ্ঠিত। সে ভালো করছে। আসলে বিদেশি আর দেশিদের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে না। ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল নেই।’

সাব্বির যোগ করেন, ‘কালকের দেখুন, ফর্টিসের সঙ্গে দুই গোলে এগিয়েও ম্যাচ হারল। ফর্টিস আহামরি খেলেনি। তবু জিতে গেছে। আরেকটি কথা, রেফারিং অনেক সিদ্ধান্ত আমাদের বিরুদ্ধে গেছে। আমরা নিরপেক্ষ রেফারিং চাই।’

বড় দল থেকে মোহামেডান এখন মাঝারিমানের এক দল

সাদামাটা দল নিয়েও অস্ট্রেলিয়ান কোচ শন লেনের অধীনে ভালোই এগোচ্ছিল মোহামেডান। কিন্তু গত মৌসুমের শেষের আগেই তিনি চলে গেলে দায়িত্ব পান শফিকুল ইসলাম মানিক। তাঁর কাছে আরও ভালো কিছু প্রত্যাশা ছিল জানিয়ে সাব্বির বলেন, ‘কোচ, খেলোয়াড় সবার কাছেই আরও ভালো কিছু চেয়েছিলাম। সেটা হচ্ছে না।’

এ নিয়ে কোচ কী বলছেন? শফিকুল ইসলাম মানিকের ভাষ্য, ‘যে প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করেছিলাম লিগে, সেটা পূরণ হয়নি। আশা ছিল টিমটা নিয়ে একটা কিছু করতে পারব। বিদেশি খেলোয়াড়দের ভিডিও দেখে নিয়েছি, ট্রায়াল তো আর এই পর্যায়ে নেওয়া যায় না। ভিডিও দেখে খেলোয়াড় নিয়ে নেওয়ায় আমার কাছে মনে হয় মানসম্মত হয়নি। যার কারণে আমরা একটু ব্যাকফুটে আছি। কিছু ম্যাচ ভালো খেলেছি। কালকের ম্যাচের আগের ম্যাচে কুমিল্লায় বসুন্ধরা কিংসের কাছে ৯৫তম মিনিটে গোল খেয়ে হেরেছি। নইলে অন্তত ড্র হতে পারত। স্বাধীনতা কাপে কিংসের সঙ্গে মুন্সিগঞ্জে ভালো খেলেছি। সমস্যা হলো ধারাবাহিকতা রাখতে পারিনি।’

ভাগ্যও মোহামেডানের সহায় ছিল না বলছেন মানিক। সঙ্গে রেফারিং নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ তাঁর, ‘রেফারিং সম্পর্কে অভিযোগ করব না। তবে রেফারিদের অনিচ্ছাকৃত কিছু ভুলের খেসারত দিয়েছি আমরা। তারপরও বলব, খুব হতাশার কিছু নেই। লিগে হয়তো ভালো করব না। শেখ জামাল, চট্টগ্রাম আবাহনীও ভালো করছে না। তবে সামনে দ্বিতীয় পর্ব আছে। জানি সমর্থকেরা হতাশ। তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। আস্থা রাখুন, ফেডারেশন কাপ রয়ে গেছে।’

ক্লাবে খেলোয়াড়দের সামান্য কিছু টাকা বাকি আছে। তবে সেটা মাঠের ফলে প্রভাব ফেলার মতো নয়, বললেন ক্লাবের এক খেলোয়াড়। কারণ যা–ই হোক, যে পরিবর্তনের আশায় মোহামেডানে নেতৃত্ব বদল হয়েছিল, সেটা পূরণ হয়নি এখনো। লিগে গতবার ছিল পঞ্চম, তার চেয়ে ভালো কিছু কি হবে?