ওয়েম্বলির রাতটা হয়তো এখনো আধোঘুমে তাড়া করে ফেরে নিকোলাস ফুলক্রুগ–ম্যাট হুমেলস-মার্কো রয়েসদের। মঞ্চ সাজানোই ছিল। গ্যালারি থেকে ক্ষণে ক্ষণে শোনা যাচ্ছিল হলুদের গর্জনও। আর মাত্র একটি ধাপ পেরোলেই মাথায় উঠত ইউরোপ–সেরার মুকুট। কিন্তু সেই ধাপটি আর পেরোনো হলো না ‘ইয়েলো–ব্ল্যাক’দের। রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে পুরোটাই হয়ে থাকল আক্ষেপের গল্প। এ আক্ষেপের উল্টো পিঠে অবশ্য ভিন্ন এক গল্পও আছে, যা না বললে পুরো চিত্রটি স্পষ্ট হবে না।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মঞ্চকে যদি দুটি সেটে ভাগ করা হয়, তবে একটি সেটে থাকবে রিয়াল মাদ্রিদ এবং বাকি দলগুলো থাকবে অন্য সেটে। এর কারণ জানতে পরিসংখ্যানে খানিকটা চোখ বুলিয়ে নিলেই চলবে। রিয়ালের ১৫ শিরোপার বিপরীতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা এসি মিলানে শিরোপাসংখ্যা ৭। এমনকি দ্বিতীয় ও তৃতীয় দল দুটির শিরোপাসংখ্যা যোগ করলেও রিয়ালের সমান শিরোপা হয় না। এটুকুই বলে দিচ্ছে, এই মঞ্চে রিয়ালই শেষ কথা! যখন তারা বিশ্রামে যায়, তখন হয়তো বাকিরা এক–আধটু শিরোপার স্বাদ পায়। এটুকু তথ্য ডর্টমুন্ড সমর্থকদের ক্ষতে খানিকটা প্রলেপ দিলেও দিতে পারে।
পরিসংখ্যানের ভূত বাদ দিয়ে আরেকটু গভীরে দৃষ্টি দেওয়া যাক। চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল বরাবরই ভিন্ন ধাতুতে গড়া দল। এখানে তুমুল ঘূর্ণিঝড়ও যেন তাদের টলাতে পারে না। উদাহরণ খুঁজতে খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের দিকে তাকালেই হয়। প্রথম লেগে পরাক্রমশালী সিটির সঙ্গে ৩–৩ গোলে ড্র। আর ফিরতি লেগে ইতিহাদে আক্ষরিক অর্থেই সিটির একের পর আক্রমণের ঢেউ সামলে ম্যাচকে টাইব্রেকারে নিয়ে যায় রিয়াল। এরপর টাইব্রেকারে বাজিমাত করে নিশ্চিত করে সেমিফাইনালের টিকিট।
সেমিফাইনালেও একই রকম নাটকীয়তা। বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে জোড়া গোল করে রিয়ালের তরি পার করান অখ্যাত হোসেলু। চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল এমনই, হারার আগে যারা কখনোই হারে না এবং নায়ক হতে পারেন যে কেউ। এমনকি হারা ম্যাচও দৈববলে জিতে যেতে পারে তারা। অনেক সময় দলটিকে দেখলে মনে হয় অদৃশ্য কোনো জিন সঙ্গে নিয়ে মাঠে নেমেছ! এই দলকে হারাতে ফাইনালে ডর্টমুন্ডকে তাই অবিশ্বাস্য কিছুই করতে হতো। পাল্টা কোনো দৈব শক্তির হস্তক্ষেপেরও হয়তো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি, ২–০ গোলে জিতে রিয়াল যথারীতি সমৃদ্ধ করেছে নিজেদের অর্জনের ভাঁড়ার।
প্রশ্ন হচ্ছে, রিয়াল ও ডর্টমুন্ডের সেই ম্যাচ শেষ হয়েছে আরও চার মাস আগে। হঠাৎ সেই ম্যাচ নিয়ে এত আলোচনা কেন? আলোচনার কারণ, সেই একই মঞ্চে আবার দেখা হচ্ছে এই দুই দলের। নাহ, এবার ফাইনালে নয়, প্রথম রাউন্ডেই দেখা হচ্ছে দুই দলের। রিয়ালের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে মুখোমুখি হবে এই দুই দল। আর প্রাসঙ্গিকভাবেই ম্যাচটির আগে বারবার ফিরে আসছে চার মাস আগের সেই ফাইনাল। সঙ্গে আছে ডর্টমুন্ডের প্রতিশোধের প্রসঙ্গও।
এই চার মাসে অবশ্য বদলে গেছে অনেক কিছু। বিশেষ করে রিয়ালের চেয়ে ডর্টমুন্ডেই বদলের ধাক্কাটা বেশি লেগেছে।
এই চার মাসে অবশ্য বদলে গেছে অনেক কিছু। বিশেষ করে রিয়ালের চেয়ে ডর্টমুন্ডেই বদলের ধাক্কাটা বেশি লেগেছে। এই লেখার শুরুতে যে তিনজনের নাম নেওয়া হয়েছিল, সেই ফুলক্রুগ-হুমেলস–রয়েসদের কেউই এখন আর ডর্টমুন্ডের সঙ্গে নেই। পরিচিত এই মুখগুলো গত মৌসুম শেষে দল ছেড়েছেন। এমনকি কোচ এদিন তেরজিচও বিদায় নেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে হারের পর। তাঁর জায়গা এখন দলটির দায়িত্ব পালন করছেন ক্লাবটির সাবেক ফুটবলার ৩৬ বছর বয়সী নুরি সাহিন। তিনিই মূলত এখন ডর্টমুন্ডকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছেন। ফলাফল বিশ্লেষণ করলে প্রাপ্তিটা এখনো অম্ল–মধুর। বুন্দেসলিগায় ৭ ম্যাচ শেষে ডর্টমুন্ডের অবস্থান ৭ নম্বরে।
আর চ্যাম্পিয়ন লিগে দুই ম্যাচের দুটিতেই জিতে এ মুহূর্তে সবার ওপরে আছে তারা। দুই ম্যাচের দুটিতেই জিতেছে এমন দল আছে ৭টি। কিন্তু গোল ব্যবধানে ডর্টমুন্ডে ধারেকাছেও নেই অন্যরা। ২ ম্যাচে ১০ গোল করার বিপরীতে দলটি হজম করেছে মাত্র ১ গোল, অর্থাৎ গোল ব্যবধান ৯। আর দুই ম্যাচ শেষে এই তালিকায় রিয়ালের অবস্থান ১৭ নম্বরে। প্রথম ম্যাচে আতলান্তার বিপক্ষে ২–০ গোলে জিতলেও পরের ম্যাচে লিলের বিপক্ষে রিয়াল হেরে গেছে ১–০ গোলে।
এমনকি মাঠের খেলাতেও এখনো পুরোপুরি নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি দলটি। ডর্টমুন্ডের মতো পরিবর্তন অবশ্য রিয়ালেও এসেছে। রিয়াল ছেড়েছেন বহু যুদ্ধের কাণ্ডারি টনি ক্রুস। বিপরীতে দলে তারুণ্য শক্তি বাড়াতে এসেছেন কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। চার মাসে ঘটে যাওয়ার এই বদলগুলো এখন বদলে দিচ্ছে দুই দলের দ্বৈরথের অভিমুখও। যদি চ্যাম্পিয়নস পয়েন্ট তালিকার দিকে তাকাই, তবে এই ম্যাচে ফেবারিট ডর্টমুন্ডই। তবে শুধুই খাতা–কলমে। আর রিয়ালকে নিয়ে আগাম রায় দিতেও নেই। এই মঞ্চে যেকোনো পর্যায় থেকে জেগে উঠতে পারে তারা। ফলে প্রথম দুই ম্যাচ দেখে দলটিকে যাচাই করতে বসা হবে স্রেফ বোকামি।
এরপরও ডর্টমুন্ডের প্রতিশোধ মিশন সফল হতে পারে কেবল একজন ব্যক্তির কারণে, তিনি কোচ নুরি সাহিন। ডর্টমুন্ডের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে ২০১১–১২ মৌসুমে রানার্সআপ হওয়া এই ফুটবলার এর আগে খেলেছেন রিয়ালেও। খুব বেশি ম্যাচ খেলা না হলেও দলটির মাঠ এবং পরিবেশ–পরিস্থিতির অনেক কিছুই তাঁর জানা। আজ মাঠে নামার আগে শিষ্যদের নিশ্চয় সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর দুর্বলতাগুলো জানিয়ে দেবেন তিনি।
সাহিনকে অবশ্য রিয়ালের দুর্বলতা জানানোর পাশাপাশি নিজের কৌশলের ওপরও আস্থা রাখতে হবে। ডর্টমুন্ডের হয়ে এখন পর্যন্ত দলকে হাইপ্রেসে খেলানোর চেষ্টা করেছেন এই তুর্কি কোচ। তবে প্রেসিংয়ের ধরন কেমন হবে, তা অবশ্য অনেকটাই নির্ভর করে প্রতিপক্ষ দলের শক্তির ওপর। সাধারণত তিনি ৪–১–৩–২ ফরমেশনে দলকে খেলিয়ে অভ্যস্ত। এই ফরমেশনে প্রেসিং স্ট্রাইকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফরোয়ার্ড লাইনের একজন খেলোয়াড়। তিনি প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাককে বোকা বানিয়ে এক পাশে টেনে নিয়ে জায়গা বের করার চেষ্টা করেন।
এভাবে প্রতিপক্ষকে এক পাশে সরিয়ে নেওয়া গেলে বাকিরা আগ্রাসী হয়ে উঠেন এবং প্রেসিংয়ের ঝড় আরও বাড়িয়ে দেন। রিয়ালের বর্তমান ডিফেন্স লাইনের বিপক্ষে সাহিনের এই কৌশল সফল হতে পারে। তবে তাতে অন্য বিপদও আছে। রিয়ালের মিডফিল্ড ও ফরোয়ার্ড লাইন তারকায় ভরপুর। ফলে হাইপ্রেসিংয়ের কৌশল রিয়ালের তারকা খেলোয়াড়দের ওপর প্রয়োগ করা কঠিন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সাহিনকে অবশ্যই প্ল্যান ‘বি’ প্রস্তুত রাখতে হবে। নয়তো উল্টো বিপদে পড়ার ঝুঁকি থাকবে।
রিয়ালের জন্য অবশ্য বিপদটা অন্য জায়গায়। বলা যায়, এখন দলটিতে ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট’ অবস্থা। বিশেষ করে কিলিয়ান এমবাপ্পে আসার পর এখনো সঠিক ছন্দ পুরোপুরি খুঁজে পায়নি তারা। আনচেলত্তি নানাভাবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখেছেন বটে, কিন্তু এখনো পুরোপুরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি দলটি। এর মধ্যে খেলোয়াড়দের আবার পজিশন বদলানোর কথা শোনা যাচ্ছে। এখন নতুন কৌশল এবং ফরমেশনে রিয়াল নিজেদের চিরায়ত ছন্দ খুঁজে পায় কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা। আর এই ছন্দ ফিরে পেতে গতবারের ফাইনালিস্টদের চেয়ে যোগ্য প্রতিপক্ষ আর কে হতে পারে!