লেবাননের বিপক্ষে মঙ্গলবার ১-১ গোলে ড্র করেও বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় আক্ষেপের সুর। ম্যাচটা যে জিততেই পারতেন জামাল ভূঁইয়ারা। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডে ‘আই’ গ্রুপে নিজেদের প্রথম হোম ম্যাচে বাংলাদেশ অসাধারণ ফুটবলই খেলেছে। খেলার ধারা অনুযায়ী একাধিক গোলের ব্যবধানেই জেতার সুযোগ ছিল। কিন্তু কয়েকটি সহজ সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। লেবানন যে গোলটি করেছে, সেটি নিয়েও আছে আক্ষেপ, হাহাকার। মিতুল মারমার বদলি হিসেবে গোলবার আগলাতে মাঠে নামা মেহেদী হাসানের ‘স্কুলবালক-সুলভ’ ভুলটি যথেষ্টই পোড়াচ্ছে। শেখ মোরছালিন অসাধারণ এক গোলে সমতা ফিরিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু তিনিও গোলের সুযোগ নষ্ট করেছেন একাধিক। একটি সুযোগ তো মোরছালিনকেও অনেক দিন পোড়াবে—এতে সন্দেহ নেই।
কোচ হাভিয়ের কাবরেরা অবশ্য এই মিসগুলোকে ‘খেলার অংশ’ই বলেন সব সময়। ম্যাচের শেষেও বলেছেন। তিনি লেবাননের বিপক্ষে ম্যাচে অনেক ‘ইতিবাচক’ দিক খুঁজে পেয়েছেন। তবে একটা কথা তিনি বলেছেন, সেটি ‘বড় স্বপ্ন’, ‘বড় লক্ষ্য’ নিয়ে। লেবাননের বিপক্ষে ড্র বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের স্বস্তি দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু ম্যাচটা জিতলে সেটি হতো অসাধারণ এক অর্জন। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে একটা ম্যাচ জেতা, পয়েন্ট তালিকার ভালো অবস্থানে উঠে যাওয়া—এই ব্যাপারগুলোই আসলে সেই ‘বড় স্বপ্ন’, ‘বড় লক্ষ্য’। কাবরেরা এখন তাঁর শিষ্যদের কাছ থেকে সেগুলোই চান, ‘আমরা লেবাননের সঙ্গে ড্র করেছি। ম্যাচটা খুবই কঠিন ছিল। তারা শক্তিশালী দল। আমি খুশি আমার খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সে। তবে এখন আমাদের বড় স্বপ্নের দিকেই এগোতে হবে।’
গত জুন থেকেই অন্য রকম এক বাংলাদেশ দলকে দেখছেন ফুটবলপ্রেমীরা। বেঙ্গালুরুর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে লেবানন, কুয়েতের মতো দলের সঙ্গে লড়াকু ফুটবল, মালদ্বীপ ও ভুটানকে উড়িয়ে দেওয়া—১৪ বছর পর সাফের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করার সেই আসর যেন নতুন দিনেরই সূচনাটা করে দিয়েছিল। এরপর কয়েক মাস বিরতি দিয়ে সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দেশের মাটিতে দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচেও একই ধরনের ফুটবল খেলেছে কাবরেরার দল। এরপর মালদ্বীপের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দুটি ম্যাচ। মালেতে হার এড়ানো ড্র, এরপর ঢাকায় অসাধারণ জয়—সব মিলিয়ে দেশের ফুটবলের ভালো একটা সময়ই যাচ্ছে। ফুটবলাররা এখন আগের চেয়ে ধারাবাহিক। এ দলটার মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। হারের আগেই হেরে না যাওয়া, গোল খেয়ে গেলে ঘাবড়ে না যাওয়া, প্রতিপক্ষের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে টক্কর, পুরো ৯০ মিনিট একই দমে খেলে যাওয়া—এসবই এই দলের বৈশিষ্ট্য। মাঝখানে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচটিতে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ৭-০ গোলে উড়ে যাওয়াটা একটা ছন্দপতন। কিন্তু ফিফা বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলা অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের সঙ্গে এমন ফল একেবারেই অপ্রত্যাশিত কিছু ছিল না। মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে স্কোরলাইনটাকে ‘ভদ্রোচিত’ রাখার সামর্থ্য যে কাবরেরার দলের ছিল, সেটা বোঝা গেছে লেবাননের সঙ্গে ম্যাচেই। এখন কাবরেরার সেই ‘বড় লক্ষ্য’ পূরণ হবে কীভাবে, সেখানেই দৃষ্টি দেওয়ার সময়।
ভালো ফুটবলের পাশাপাশি বাংলাদেশ দল ধারাবাহিকভাবে জেতা শুরু করবে কবে থেকে—বড় প্রশ্ন এটিই। এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হতে পারে, যেদিন থেকে ফরোয়ার্ডরা গোলের সুযোগ কাজে লাগানো শুরু করবেন, বাংলাদেশ জেতা শুরু করবে সেদিন থেকেই। কিন্তু কাবরেরার ‘বড় স্বপ্ন’ পূরণে বাফুফে কতটা প্রস্তুত?
স্প্যানিশ কোচ কাবরেরা বাংলাদেশে আসার পর খুব একটা জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি নিজের কাজের ছাপ রাখা শুরু করেছেন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর অধীনে ২১টি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে জয় এসেছে ৬টি, ড্র–ও ৬টি, হার বাকি ৯ ম্যাচ। গত কয়েক মাসেই জাতীয় দলের পারফরম্যান্স সবচেয়ে উজ্জ্বল। এ সময় ১৪টি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ জিতেছে ৫টিতে। কাবরেরার অধীন বাংলাদেশ ড্র করেছে ইন্দোনেশিয়া, লেবাননের মতো দলের সঙ্গে। বিশেষ করে তিনি জাতীয় দলের খেলার নিজস্ব একটা ধরন তৈরি করতে পেরেছেন, যেটি আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। এই কিছুদিন আগপর্যন্ত বাংলাদেশ একটু শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে রক্ষণ সামলে প্রতি–আক্রমণে গিয়ে খেলার চেষ্টা করত। ওই সময় ‘নিরাপদ ফুটবল’ খেলার একটা প্রবণতা ছিল বাংলাদেশ দলে। কোচের হাতে পর্যাপ্ত ‘বিকল্প’ ছিল না বললেই চলে। পারফরম্যান্স থাকুক আর না থাকুক, নির্দিষ্ট কিছু খেলোয়াড়কে দলে নিতেই হতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। এই যে বসুন্ধরা কিংসের হয়ে মালদ্বীপে খেলতে গিয়ে শৃঙ্খলাজনিত সমস্যায় দলের দুই ‘অপরিহার্য’ সদস্য তপু বর্মণ আর গোলকিপার আনিসুর রহমান জিকো নিষিদ্ধ হয়েছেন, যাঁদের অনুপস্থিতিকে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বড় ধাক্কা হিসেবেই দেখা হচ্ছিল, কিন্তু বাস্তবে তাঁদের অনুপস্থিতি খুব বড় প্রভাব রাখছে না। তার মানে, কাবরেরার হাতে এখন বিকল্প একাধিক। কিছুদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে কোচ বলেছিলেন, বাংলাদেশ দলে এখন বিভিন্ন পজিশনে ২২-২৫ জন খেলোয়াড় তাঁর হাতে আছে, যাঁরা সবাই একজন আরেকজনের বিকল্প।
এই যে মোরছালিনের মতো তরুণ প্রতিভাকে মালদ্বীপের সঙ্গে দুটি ম্যাচে পাওয়া যায়নি, সেটি অনুভূত হতে দেননি আরেক তরুণ ফয়সাল আহমেদ ফাহিম। মঙ্গলবার দুই হলুদ কার্ডের কারণে একাদশে ছিলেন না রাকিব হোসেন ও সাদউদ্দিন। এই দুজনের বদলে যাঁরা খেলেছেন, তাঁরা বুঝতেই দেননি, মাঠে নিয়মিত একাদশের দুই সেরা খেলোয়াড় নেই। কাবরেরার হাত ধরে বাংলাদেশের ফুটবলের পরিবর্তন এগুলোই।
এখনকার কাজটা আরও গুরুত্বপূর্ণ—জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা। যা সবচেয়ে কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। কোচ বলেছেন, ‘সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। আমরা উন্নতির সিঁড়িতে আছি। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। আমাদের দল নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। আরও পরিশ্রম করতে হবে।’
জাতীয় দলের টিম ম্যানেজমেন্ট নিজেদের কাজটা করে যাচ্ছেন। খেলোয়াড়েরা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। উন্নতিও হচ্ছে। কিন্তু পরের ধাপে যেতে হলে করণীয়র পরিধি আরও বাড়াতে হবে—এটা ফুটবলসংশ্লিষ্ট সবাই জানেন, বোঝেন। লেবাবন, ফিলিস্তিন কিংবা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান অথবা ভারত—এমন প্রতিপক্ষের সঙ্গে আমরা সেদিন থেকেই ভালো খেলতে পারব, ‘বড় স্বপ্ন’ দেখতে পারব, জেতা শুরু করব, যখন আমাদের খেলোয়াড়েরা নিজেদের আরও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক’ হিসেবে তৈরি করতে পারবেন। সেই পুরোনো কথা, তৃণমূল পর্যায় থেকে আরও প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুঁজে বের করা, শীর্ষ ক্লাবগুলোর আরও পেশাদারি উদ্যোগ ও খেলোয়াড় তৈরিতে ভূমিকা রাখা এবং প্রিমিয়ার লিগকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করা।
‘করণীয়’ চিহ্নিত। এই পথে দেশের ফুটবল হাঁটবে কি না, সেটি এখন সংগঠকদের দায়িত্ব। মনোযোগ শুধু জাতীয় দলেই নয়, জাতীয় দলের বাইরে, ঘরোয়া ফুটবলে আর তৃণমূলে দিতে হবে—সেটি হলেই ‘বড় স্বপ্ন’ বাস্তব হবে। সংগঠকেরা কি প্রস্তুত এ ব্যাপারে?