লুসাইল স্টেডিয়ামে শেষ বাঁশি বাজার পর নিস্তব্ধ গোটা আর্জেন্টিনা, উৎসবে মেতেছে সৌদি আরব—কল্পনার মানসপটে এমন কিছু ভেবে নেওয়াই যায়। তবে বাস্তবতা আরও মারাত্মক কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠে গেছে, লুসাইলে সৌদি আরবের কাছে আজ আর্জেন্টিনার ২-১ গোলের হার বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা অঘটন কি না?
আর্জেন্টিনার এমন শুরু কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে তৃতীয় আর্জেন্টিনা হেরে গেল র্যাঙ্কিংয়ে ৫১তম সৌদি আরবের কাছে! আর্জেন্টিনা যেখানে বিশ্বকাপ মানেই ফেবারিট, আর স্কালোনির এই আর্জেন্টিনা অপরাজিত ছিল টানা ৩৬ ম্যাচ, অথচ এই দলটাই কি না, পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলতে আসা সৌদির কাছে হারল! তাও এমন একটি দল যাঁরা আগের চারবার বিশ্বকাপ খেলে মাত্র একবার দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে, সেটাও ২৮ বছর আগে ১৯৯৪ বিশ্বকাপে।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে অঘটন তো কম নেই। আসুন জেনে নিই, আগের অঘটনগুলো। আর্জেন্টিনার এই হার অবশ্যই সেসব অঘটনের কাতারে পড়বে। তবে সেরা কি না, সেটি তর্কসাপেক্ষ হলেও এতটুকু বলা যায়, এই গ্রহের কেউ সম্ভবত কল্পনাও করেননি আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ শুরু হবে সৌদি আরবের কাছে হার দিয়ে!
বেলো হরিজেন্তোয় দুঃস্বপ্ন দেখেছিল ইংল্যান্ড। বলা হয়, এটি বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অঘটন। গ্রুপপর্বে যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বিতীয় ম্যাচের আগে হট ফেবারিট ছিল ইংল্যান্ড। আর যুক্তরাষ্ট্রের দলটি ছিল ‘পার্ট টাইমার’দের নিয়ে গড়া। ১৫ মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গোলপোস্টে ৬টি শট নিয়ে নিজেদের শক্তি বুঝিয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু নাটকের তখনো বাকি ছিল। ম্যাচের ৩৮ মিনিটে হাইতিয়ান বংশোদ্ভূত জো গায়েতিয়েনস যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে গোলটি করেন। শেষ পর্যন্ত এই গোলেই জন্ম হয় বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অঘটনের। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে ইংল্যান্ডের এই হার এত আশ্চর্যের ছিল যে, তারা সংবাদ ছেপেছিল ইংল্যান্ড আসলে ১০-১ গোলে জিতেছে কিন্তু টেলিগ্রাফের ভুলে সেটিকে ০-১ মনে হচ্ছে। সেদিন খেলায় ইংল্যান্ডের পক্ষে বাজির দর ছিল ৫০০: ১।
এশিয়া মহাদেশ থেকে প্রথম কোনো দল হিসেবে ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে অংশ নেয় উত্তর কোরিয়া। বিশ্বকাপে নাম লেখানোর পরই যেন নিজেদের প্রমাণ করার মিশনে নামে উত্তর কোরিয়ানরা। ওই বিশ্বকাপে টপ ফেবারিট হিসেবে শিরোপা জয়ের লক্ষ্য নিয়ে ইংল্যান্ড এসেছিল ইতালি। চিলিকে প্রথম ম্যাচে ২-০ গোলে হারানোর পর উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি ড্র হলেই পরের রাউন্ডে উত্তীর্ণ হবে আজ্জুরিরা।
এমন সমীকরণ সামনে রেখেই উত্তর কোরিয়ার মুখোমুখি হয় ইতালি। ইউরোপ মাতানো ইতালির মহাতারকাদের সামনে উত্তর কোরিয়া শুধু অংশগ্রহণ বৈ আর কিছু ছিল না। অনেকেই মনে করেছিল, উত্তর কোরিয়া হয়তো উড়ে যাবে এই ম্যাচে; কিন্তু এমন ম্যাচেই কিনা বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অঘটনটির জন্ম দেয় কোরিয়ানরা।
প্রথমার্ধেই (৪২ মিনিটে) প্যাক ডু ইকের একমাত্র গোলে ইতালি পিছিয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আর খেলায় ফিরতে পারেনি তারা। প্যাকের সেই একটি গোলই ইতালিকে প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে দিয়েছিল। প্রথমবার বিশ্বকাপে নাম লিখেই ওই জয়ের কারণে কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট পেয়ে যায় উত্তর কোরিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ৩-০ গোলে হারলেও চিলির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করেছিল উত্তর কোরিয়া। কোয়ার্টারে অবশ্য ইউসেবিওর হ্যাটট্রিকের সামনে টিকতে পারেনি কোরিয়া উপদ্বীপের এই দেশটি। হেরে গিয়েছিল ৫-৩ গোলে।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনের কাছে শক্তিশালী আর্জেন্টিনার হারে চমকে গিয়েছিলেন নীল-সাদা ব্রিগেডের সমর্থকেরা। আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসাবে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়েছিল ক্যামেরুন। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচেই ডিয়েগো ম্যারাডোনার দলকে চমকে দিয়েছিল ক্যামেরুন। ম্যারাডোনাকে আটকানোই লক্ষ্য ছিল আফ্রিকার দলটির। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিকে ট্যাকলের পর ট্যাকল করে ক্যামেরুনের দুজন লাল কার্ডও দেখেন। ৬৭ মিনিটে ওমাম বিয়িক ক্যামেরুনের হয়ে যখন গোল করলেন তখন ১০ জন নিয়ে খেলছিল রজার মিলার দেশ। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ২ মিনিট আগে ক্যামেরুনের আরও এক খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখেন। কিন্তু সেদিন অঘটন এড়াতে পারেনি আর্জেন্টিনা।
১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল ফ্রান্স। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে উদ্বোধনী ম্যাচে সেনেগালের মুখোমুখি হয়েছিল ফরাসি ব্রিগেড। কিন্তু সেই ম্যাচে ফ্রান্সকে হারিয়ে চমক দেয় সেনেগাল। সে বছরই প্রথমবার বিশ্বকাপের আসরে নেমেছিল সেনেগাল। প্রথমবারেই বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারানোকে অঘটন ছাড়া আর কী বলা যায়।
স্পেন সেই বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ। হোসে আন্তনিও কামাচো, কার্লোস সান্তিলানাদের নিয়ে বেশ শক্তিশালী দল ছিল স্পেনের। আর উত্তর আয়ারল্যান্ড সেই বিশ্বকাপের আগে একবারই বিশ্বকাপ খেলেছিল (১৯৫৮)। যদিও সেই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল দলটি। কিন্তু ’৮২ বিশ্বকাপে শক্তিতে তাঁরা স্পেনের ধারেকাছেও ছিল না। অথচ সেই উত্তর আয়ারল্যান্ডই কি না স্পেনকে হারিয়ে চমকে দিয়েছিল সবাইকে। ৪৭ মিনিটে জেরি আর্মস্ট্রংয়ের ‘আইকনিক’ গোলে কপাল পুড়েছিল স্পেনের। ম্যাল দোনাঘি লাল কার্ড দেখায় ম্যাচের শেষ আধঘণ্টা ১০ জন নিয়ে খেলেছিল উত্তর আয়ারল্যান্ড। এই জয়ে পরের রাউন্ডে উঠেছিল উত্তর আয়ারল্যান্ড।
১৯৮৬ থেকে ১৯৯৮—বিশ্বকাপের এই চার আসরেই গ্রুপপর্বে জয়হীন থেকে বাদ পড়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু ২০০২ বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশটি নিজেদের গ্রুপে শীর্ষস্থান নিয়ে উঠে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে এবং সেখানে মুখোমুখি হয় ইতালির
স্বাভাবিকভাবেই এই ম্যাচে ইতালি ছিল নিরঙ্কুশ ফেবারিট। ১৮ মিনিটি ক্রিস্টিয়ান ভিয়েরির গোলে ম্যাচের একদম শেষ দিকে চলে গিয়েছিল ইতালি। কিন্তু ৮৮ মিনিটে সেওল কি হাইয়নের গোলে সমতায় ফিরতে হয় ‘আজ্জুরি’দের। আর অতিরিক্ত সময়ের ১১৭ মিনিটে আন জাং-হুয়ানের ‘গোল্ডেন গোল’-এ স্মরণীয় জয় তুলে নেয় দক্ষিণ কোরিয়া।