ইউরো থেকে জার্মানির বিদায়ে শেষ হয়ে গেল ফুটবলের ক্রুস–অধ্যায়ও
ইউরো থেকে জার্মানির বিদায়ে শেষ হয়ে গেল ফুটবলের ক্রুস–অধ্যায়ও

টনি ক্রুস: সর্বজয়ী ‘স্নাইপারের’ শেষটা ব্যর্থ নিশানায়

স্টুটগার্টে সব উত্তেজনার পর্দা নামা শুরু হয়েছে। ১১৯ মিনিটে হার না–মানা স্প্যানিশ ‘ম্যাটাডোর’দের গোল তখন শেলের মতো বিদ্ধ হয়ে ছিল জার্মান যোদ্ধাদের বুকে। গ্যালারির কালো–সাদা অংশজুড়ে কবরের নীরবতা। যুদ্ধের যবনিকা পড়তে তখন মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি। জার্মানদের হয়ে শেষ শটটি নিতে এলেন বহু যুদ্ধের সেনাপতি টনি ক্রুস।

সবাই তাকিয়ে ক্রুস–ক্যারিয়ারের শেষ শট তথা শেষ ফ্রি–কিকটির দিকে। হয়ে যাক তবে ‘স্নাইপার’–এর আরেকটি অব্যর্থ নিশানা ভেদ! মানুষটির নাম ক্রুস বলেই হয়তো জার্মানদের আশার প্রদীপ তখনো মিটিমিটি জ্বলছিল। অলৌকিক কিছুর অপেক্ষা, যা শুধু তাঁর হাত ধরেই সম্ভব হতে পারে। তবে শেষটা কি আর সব সময় রূপকথার মতো হয়! হয় না। এবারও হলো না। রূপকথার গল্পে তাই কয়েক ফোঁটা অশ্রুও ঝরল। না পাওয়ার যন্ত্রণায় ভাঙল এক যোদ্ধার হৃদয়।

অবসর ভেঙে জার্মানিকে ইউরোপ সেরা করার স্বপ্ন নিয়ে ফিরে এসেছিলেন ক্রুস। সেই স্বপ্নটা শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে গেল, যা প্রায় সর্বজয়ী এক ফুটবলারের একমাত্র আক্ষেপও বটে। ক্যারিয়ারে সম্ভাব্য সব বড় শিরোপা জিতলেও কেবল ইউরোই আর জেতা হলো না। তাঁর নিখাদ ক্যারিয়ারে চাঁদের কলঙ্কের মতো একটু খাদ যেন রেখে দিতে চাইলেন ফুটবল–ঈশ্বরও। দেশের মাটিতে হলো না ইউরো জেতা। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে জার্মানির বিদায়ে আর দীর্ঘায়িত হলো না ক্রুসের ক্যারিয়ারও।

প্রায় ৩৪ বছর আগে ক্রুসের জন্মই তাঁর ভবিতব্য ঠিক করে দিয়েছিল। খেলার মাঠ যদি কোনো শিশুর কাছে স্বর্গের মতো হয়, তবে ক্রুসের জন্য নিজের ঘরটাই ছিল তেমন এক ‘নন্দনকানন’। মা একই সঙ্গে স্পোর্টস বায়োলজির শিক্ষক ও ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় এবং বাবা রেসলার ও ফুটবল কোচ। এমন পরিবারে যাঁর জন্ম, তাঁর জন্য খেলার মাঠটাই তো গোটা পৃথিবী। ফলে তিনি যে পূর্ব জার্মানির প্রথম ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ জিতে বার্লিন দেয়াল ভেঙে চূর্ণ করে দেবেন, এ আর নতুন কী!

ক্রুসকে সান্ত্বনা দিচ্ছে হোসেলু

খেলা–অন্তপ্রাণ পরিবারে জন্ম, ক্রুসের জীবনের ভেলাও ভিন্ন কোনো দিকে ভেসে যেতে পারত না। বুঝতে শেখার পর থেকে স্বাভাবিকভাবে খেলাই হয়ে গেল তাঁর জীবন এবং যাপন। এমন যাপনে শাপেবর হলো পড়াশোনায় দুর্বলতা। ফুটবলকে বেছে নিতে তাই দ্বিতীয়বারের মতো ভাবতে হয়নি। তবে ফুটবলেও প্রকৃতিপ্রদত্ত কোনো প্রতিভা ছিলেন না ক্রুস। কিন্তু পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা ধীরে ধীরে দুয়ার খুলে দেয় তাঁর জন্য। সে পরিশ্রমই একদিন তাঁকে নিয়ে যায় গ্রেইফসওয়াল্ডার ও হানসা রোসটোক হয়ে বায়ার্ন মিউনিখের যুব দলে। এরপর বাকি গল্পটা কেবল সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সেই পথচলার শুরুটা অবশ্য খুব একটা মসৃণও ছিল না।

বায়ার্ন তাঁকে নিজেদের জন্য যথেষ্ট যোগ্য মনে করেনি। তাই পারিশ্রমিকও দিয়েছে কম। এমনকি ধারে খেলেছেন বায়ার লেভারকুসেনের মতো ক্লাবে। সেই প্রত্যাখ্যানসুলভ আচরণই যেন ক্রুসের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় মাইলফলক হয়ে গেল। ভাগ্যিস বায়ার্ন ভুল ভেবেছিল! নয়তো পরের অজেয় গল্পটা কি আর লেখা হতো? বায়ার্ন যে হীরাকে কাচ ভেবেছিল, তাঁর ভেতরের হিরেটা ঠিকই চিনে নিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ।

২০১৪ সালের জুলাইয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ক্রুস এলেন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর আঙিনায়। সেই ক্রুস, যিনি কয়েক দিন আগে বেলো হরিজন্তের সবুজ গালিচাকে কসাইখানায় পরিণত করেছিলেন। ব্রাজিলকে ৭–১ গোলে বিধ্বস্ত করে ‘নতুন মারাকানাজ্জো’ উপহার দিয়েছিলেন। ব্রাজিলিয়ানদের চিরকালীন দুঃখের সেই ম্যাচে জার্মানরা যে রায়ট চালিয়েছিলেন, তার অগ্রভাগেই ছিলেন ক্রুস। ২ গোলের সঙ্গে করেছিলেন একটি অ্যাসিস্টও। কে জানে, ডেভিড লুইস–মাইকন–মার্সেলোদের ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্নে এখনো টনি ক্রুস হানা দেন কি না! শুধু ব্রাজিলকেই নয়, বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে হারানোর অন্যতম এই নায়ক লিওনেল মেসির দুঃস্বপ্নেও হয়তো অনেক দিন ফিরে এসেছিলেন।

বিশ্বকাপ জিতে রিয়ালে এসে শুরু করলেন নতুন এক গল্পগাথার। ধীরে ধীরে দখল নিলেন মাদ্রিদের মিডফিল্ডের, হয়ে উঠলেন মিডফিল্ড জেনারেল। রিয়ালের ‘দ্য ম্যান’ হিসেবে যাত্রা শুরু করে অচিরেই হয়ে উঠলেন ‘দ্য মিথ’ এবং গত মাসে রিয়ালকে ১৫তম চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়ে যখন বিদায় নিলেন, তখন তিনি ‘দ্য লিজেন্ড’।

শেষটা মনের মতো হলো না ক্রুসের

তাঁকে নিয়ে রিয়ালের সাবেক কোচ জিনেদিন জিদান বলেছিলেন, ‘বার্সেলোনা ৪০ পাসে যা করতে পারে, ক্রুস এক পাসেই তা করতে পারে।’ এমন বহু পাস ১০ বছর ধরে ম্যাচের পর ম্যাচে দিয়ে উদ্ধার করেছেন রিয়ালকে। বহু পাসে নতুন জীবন দান করেছেন জার্মানিকেও। সম্ভবত ক্রুস ঘুমের ভেতর পাস দিলেও সেই পাসও মাঠে এসে খুঁজে নেবে রোনালদো, ভিনিসিয়ুস কিংবা মুলারদের। যেন গজ–ফিতা দিয়েই সবকিছু মেপে নেওয়া।

ক্রুসের পাস কতটা নিখুঁত ছিল তার পক্ষে একটা তথ্য দেওয়া যাক। রিয়ালের হয়ে লা লিগায় কোনো মৌসুমেই তাঁর সঠিক পাসের হার গড়ে ৯২ শতাংশের নিচে নামেনি। কেবল যন্ত্রের পক্ষেই বোধ হয় এতটা যথার্থতা বজায় রাখা সম্ভব। ক্রুসও অবশ্য যন্ত্রের চেয়ে কম কিছু নন। বছরের পর বছর বিশেষ কোনো উত্থান–পতন ছাড়া এবং কোনো প্রণোদনা ছাড়া একই রকমভাবে পারফর্ম করে যাওয়া তো কেবল যন্ত্রের পক্ষেই সম্ভব। তবে এই যন্ত্রেরও কিন্তু মন আছে। সেই মনই তাঁকে বলেছে, এবার তবে বিদায় বলা যাক।

সহখেলোয়াড়েরা যখন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সৌদি আরবে গিয়ে ক্যারিয়ারকে আরেকটু দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছেন, যেকোনোভাবে নিজেদের টিকিয়ে রাখা চেষ্টা করছেন, ক্রুস সেখানেও খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে। বললেন, তিনি রিয়ালের বাইরে আর কোথাও খেলতে চান না।

জাতীয় দলে ফুলস্টপটা তো আগেই বসিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরও কোচ ইউলিয়ান নাগলসমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে এসেছিলেন। ঘরের মাঠে ইউরো খেলে মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার সুযোগটা হয়তো হাতছাড়া করতে চাননি ক্রুস। শিরোপা জিতে বিদায় নিতে পারলে তো আর কথাই নেই। যদিও সে আশা শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। জার্মানির জার্সি গতকাল রাতেই অতীত হয়ে গেছে তাঁর জন্য।

ইউরোতে স্পেনের কাছে জার্মানির হারে ঝরে পড়ল ফুটবল মহাকাশের একটি নক্ষত্রও। আজকের পর আর কেউ ফরোয়ার্ড লাইনে অলস বসে ক্রুসের জাদুকরি পাসের অপেক্ষা করবেন না। এমন পাস, যা ছাপিয়ে যাবে গোলের মাহাত্ম্যকেও। আজকের পর কেউ আর প্রত্যাশা করবেন না, ক্রুসের নিখুঁত ক্রস খুঁজে নেবে তাঁকে।

আজকের পর আর কোনো স্নাইপার অব্যর্থ নিশানায় ভেদ করে যাবেন না প্রতিপক্ষের রক্ষণব্যূহ। তবে না থেকেও শেষ পর্যন্ত ক্রুস রয়ে যাবেন। আরও অনেক বছর পর ফুটবল মাঠে কেউ যখন ‘আনসাং হিরো’ হয়ে চারপাশে আলো ছড়াবেন, তখন আড়ালে বসে তাঁকে উৎসাহ দিয়ে যাবেন একজন টনি ক্রুস। কারণ, সূর্য ডোবা শেষ হলেও সূর্যের যাত্রা বহুদূর।