অ্যানফিল্ডে সমর্থকদের সামনে সালাহর গোল উদ্‌যাপন
অ্যানফিল্ডে সমর্থকদের সামনে সালাহর গোল উদ্‌যাপন

লিভারপুলের অ্যানফিল্ড যে কারণে প্রতিপক্ষের কাছে ‘নরক’

দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামের চেয়ে ‘শূন্য’ আর কিছুই নাকি নেই। দর্শকদের বিরহে খাঁ খাঁ করা স্টেডিয়ামে কান পাতলেই নাকি শোনা যায় বিগত দিনের উৎসবের প্রতিধ্বনি, পরাজয়ের হতাশা, সোনালি সময়ের জন্য কান্না এবং ভরপুর নস্টালজিয়া। কিন্তু কোনো কোনো স্টেডিয়াম জানেই না শূন্যতা কী। প্রতিপক্ষের জন্য ‘কবর খোঁড়ার’ শব্দ এত বেশি যে বাকি সব চাপা পড়ে যায়। তেমনই একটি মাঠ অ্যান‍ফিল্ড। প্রতিপক্ষের কান্না ও বিষাদ আচ্ছন্ন করে রাখে লিভারপুলের এই মাঠটিকে। অ্যানফিল্ড মানেই তাই প্রতিপক্ষের আতঙ্ক।

কে জানে, এমন আতঙ্ক এখনো ঘুমের ভেতর লিওনেল মেসিকে তাড়া করে কি না! লিওনেল মেসি কেন? ২০১৮–১৯ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল লিভারপুল ও বার্সেলোনা। ক্যাম্প ন্যুর প্রথম লেগে বার্সেলোনার কাছে ৩–০ গোলে উড়ে যায় লিভারপুল। সেই ম্যাচে ফ্রি–কিক থেকে নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গোলটিও করেন মেসি।

ঘরের মাঠে ৩–০ গোলে জয়ের পর ফাইনালের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল বার্সা। এমন জয়ের পর দ্বিতীয় লেগে কেউ হারে নাকি! তা–ও যে দলে আবার মেসি–সুয়ারেজ–পিকেদের মতো খেলোয়াড়েরা আছেন। অন্যদিকে চোটের কারণে দ্বিতীয় লেগের সেই ম্যাচ থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন লিভারপুলের আক্রমণভাগের দুই প্রাণভোমরা মোহাম্মদ সালাহ ও রবার্তো ফিরমিনো। ফলে উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি নিয়েই অ্যানফিল্ডে গিয়েছিলেন বার্সা–সমর্থকেরা। কিন্তু কে জানত, অ্যানফিল্ডে লেখা হচ্ছিল ভিন্ন এক চিত্রনাট্য। যে চিত্রনাট্যে অ্যানফিল্ডে সমর্থকদের গর্জনের মধ্যেই গুনে গুনে চারবার বার্সার জালে বল জড়াবে লিভারপুল। আর শেষ গোলটি ‘কর্নার টেকেন কুইকলি’ নামে আলাদা পরিচয়ই পেয়ে যাবে।

সেদিন ম্যাচ শেষে সালাহ যে টি–শাটর্টি পরে মাঠে নেমেছিলেন, সেখানে লেখা ছিল, ‘নেভার গিভ আপ (কখনো হাল ছেড় না)’। যেন অ্যানফিল্ডের আত্মপরিচয়কেই বুকে ধারণ করে নিয়ে এসেছিলেন সালাহ। অ্যানফিল্ডে লিভারপুল যে সত্যি হাল ছাড়ে না! আর এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে লিভারপুল। ‘অল রেড’দের সেই হার না মানা গল্পগুলো রূপকথার মতো ডালপালা ছড়িয়ে টিকে আছে বছরের পর বছর।
সর্বশেষ রোববার রাতের কথাই ধরা যাক। অ্যানফিল্ডে শেষবারের মতো লিগ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিলেন ইয়ুর্গেন ক্লপ ও পেপ গার্দিওলা।

অ্যানফিল্ডে সমর্থকদের গর্জন

ইতিহাসের সেরা দুই কোচের এই লড়াই সামনে রেখে গর্জে উঠেছিল মার্সিসাইড অঞ্চলের লাল দুর্গ। ক্লপ–গার্দিওলার ম্যাচে লিভারপুল দাপট দেখালেও শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি কেউই। ম্যাচটি শেষ হয় ১–১ ড্রয়ে। তবে ম্যাচটিতে গার্দিওলা স্নায়ুর ওপর যে ঝড় বয়ে গেছে, সেটি স্পষ্ট হবে তাঁর কথায়, ‘আমরা জানতাম ১০-১৫ মিনিট সময় আসবে, যখন সুনামি হবে। আমাদের সেখান থেকে উদ্ধার হতে হবে।’ শেষ পর্যন্ত গার্দিওলার দল অবশ্য ঠিকই উতরে গেছে এ পরীক্ষা। অন্তত এক পয়েন্ট নিয়ে ফিরতে পেরেছে। কিন্তু অ্যানফিল্ডে ক্লপের লিভারপুলের বিপক্ষে নিজের ম্লান পারফরম্যান্সের খুব বেশি উন্নতি হয়নি। এই মাঠে গার্দিওলার অধীন ৯ ম্যাচ খেলে সিটি জিতেছে মাত্র ১টি, হেরেছে ৫ ম্যাচে। ড্র হয়েছে বাকি ৩ ম্যাচ।

শুধু সিটি বা বার্সেলোনার জন্যই নয়, অ্যানফিল্ড যেকোনো প্রতিপক্ষের জন্য আতঙ্কের নাম। এই মাঠে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচে হারেনি লিভারপুল। অ্যানফিল্ডে ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত লিগে টানা ৬৮ ম্যাচে হারের দেখা পায়নি দলটি। এই মাঠে লিভারপুল কতটা ভয়ংকর তা বোঝা যাবে আর্সেনাল কোচ মিকেল আরতেতার কথায়ও, ‘লিভারপুলকে (অ্যানফিল্ডে) হারানো খুবই কঠিন। আমার খেলোয়াড়ি জীবনেও অ্যানফিল্ড ছিল এমন এক মাঠ, যেখানে গেলে হতবুদ্ধি হয়ে থাকতাম।’

আরতেতা আরও যোগ করেন, ‘এটা আর্সেনালেও আমার সঙ্গে হয়েছে। সেখানে কী হয়, আমি বুঝতেই পারি না। একবার মনে হয় বলি, খেলা থামাও। আমি কোথায় আছি? এই অনুভূতি ব্যাখ্যা করা কঠিন। অ্যানফিল্ড ছাড়া আর কোথাও এমনটা হয় না। বার্সা তাদের কিছু গোলে আমাকে বিস্মিত করেছে। কিন্তু অ্যানফিল্ডে কোনো কিছু বোঝার আগেই আমরা ৫ গোল খেয়ে বসতে পারি। স্পেন, গ্রিস কিংবা জার্মানিতে আমার এমন অনুভূতি হয় না। এমনকি ওল্ড ট্রাফোর্ডেও না।’

গতকাল লিভারপুল–সিটি মহারণে কেউ জেতেনি

আরতেতার মতো সময়ের অন্যতম সেরা কোচের কথাগুলোই কি অ্যানফিল্ডের ভয়াল রূপ বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়? তবুও শোনা যাক আর্সেনালের কিংবদন্তি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের ভাষ্যও, ‘ইউরোপে ফিরতি লেগের জন্য সবচেয়ে উত্তপ্ত স্টেডিয়াম হচ্ছে অ্যানফিল্ড। ইউরোপে তারা (লিভারপুল) ভালো করে, কেন? কারণ, অ্যানফিল্ড।এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে আপনি কখনো যেতে চাইবেন না। এখানকার পরিবেশ, সবকিছু খুবই বিশেষ।’

একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের কণ্ঠেও, ‘এখানকার পরিবেশ অসাধারণ। এমনকি আপনি যদি হারেনও, এই উত্তাপ আপনি আশা করবেন।’ অন্যদের মধ্যে কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ বলেছেন, এ মাঠে এলে তাঁর ‘গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।’ আনচেলত্তির কাছে এই মাঠ ‘বিশেষ’, জোসে মরিনহোর কাছে ‘অসাধারণ।’

১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত অ্যানফিল্ড নিয়ে এমন ভয় কিংবা প্রশংসাসূচক মন্তব্য চাইলে আরও অনেক দেওয়া যাবে। আর এমন নয় যে এটি সাম্প্রতিক কোনো বিষয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০–এর দশকে লিভারপুল যখন ইংলিশ এবং ইউরোপিয়ান ফুটবল শাসন করছিল, তখন থেকেই অ্যানফিল্ড হয়ে উঠে স্বাগতিকদের ‘অভয়ারণ্য’ প্রতিপক্ষের ‘ভয়ের রাজ্য’। এমনকি লিভারপুল যখন দুঃসময়ের বৃত্তে ছিল, তখনো অ্যানফিল্ড ছিল তাদের টিকে থাকার অনুপ্রেরণা। এই স্টেডিয়ামের গর্জে ওঠা পরিবেশ সব সময় ভরসা দিয়ে গেছে—কখনো হাল ছেড়ো না!

নির্দিষ্ট ম্যাচের কথা বললে, ১৯৬৫ সালে ইন্টার মিলান, ১৯৭৭ সালে সাঁত এতিয়েন, ২০০১ সালে বার্সেলোনাসহ অনেক ক্লাব অ্যানফিল্ডের উত্তাপ টের পেয়েছে। আর প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো তো হামেশাই টের পাচ্ছে। ম্যাচ দিবসে অ্যানফিল্ড যে প্রতিপক্ষের জন্য একখণ্ড ‘নরক’! পুরো গ্যালারি যখন ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’র সুরে গর্জে ওঠে, তা অন্য পক্ষে থাকা খেলোয়াড়–কোচদের শিঁড়দাড়ায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তাই তো অ্যানফিল্ডে গর্জন কম শোনা গেলে মন খারাপ হয় ক্লপেরও।

এ মৌসুম শেষে বিদায় নেবেন ক্লপ। অ্যানফিল্ডে সোনালি যুগ ফিরিয়ে এনেছিলেন এই কোচ। মাঝে কিছুটা ‘কোমল’ সময় গেলেও ৯ বছর ধরে আবার এই মাঠ প্রতিপক্ষের আতঙ্কের নাম। ক্লপ বিদায় নিলে লিভারপুলের খারাপ সময় আসতে পারে, কিন্তু অ্যানফিল্ডের গর্জন কি আর এতটুকু কমবে? লিভারপুল জানে, দুঃসময় কখনো শেষ কথা নয়। তাই হাল ছাড়া যাবে না। দলটিকে জীবন্ত রাখতে আর ভরসা দিতে সদাজাগ্রত অ্যানফিল্ড তো আছেই, যার মূল জ্বালানি কোপাইট বা লিভারপুলের কট্টর সমর্থক গোষ্ঠী। তারা জানে, কীভাবে প্রিয় দলকে ভরসা দিতে হয়, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইতে হয়—ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন!