মেসি, রোনালদো, জিদান: দেখা না–দেখার দুঃখ–সুখ

লিওনেল মেসিকে যখন প্রথম দেখি, তখন ও একেবারেই বাচ্চা একটা ছেলে। কথাটা লেখার পর আবার তা পড়তে গিয়ে আমার নিজেরই কেমন যেন লাগছে। আপনার তো লাগতেই পারে। তবে ঘটনা কিন্তু সত্যি।

মেসিকে প্রথম দেখি ২০০৬ বিশ্বকাপে। তখন মেসির আর কতই–বা বয়স! হিসাব করে দেখছি, ওই বিশ্বকাপের মধ্যেই মেসির ১৯তম জন্মদিন পড়েছিল। আর আমার বয়স? একটা হিন্ট দিই। মেসি তখন আমার সাংবাদিকজীবনের চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড়। মেসিকে আমার বাচ্চা ছেলে মনে হওয়াটা এখন আর নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক লাগছে না।

মেসির তখন কাঁধ পর্যন্ত নেমে যাওয়া লম্বা চুল। মুখে কৈশোর লেগে আছে। সে কারণে বয়স আরও কম বলে মনে হয়। দাড়িটাড়ি রেখে চেহারা একটু ভারিক্কি করার চেষ্টার সময়টা যদি বাদ দেন, মেসির মুখ দেখে অবশ্য কখনোই বয়স বোঝার উপায় নেই। ‌‘নতুন ম্যারাডোনা’ তকমা তত দিনে গায়ে লেগে গেছে, তবে ২০০৬ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা দলে মেসি নিছকই ‘বেবি’। সবচেয়ে বড় তারকা? অবশ্যই হুয়ান রিকুয়েলমে। পরে যেটিকে মেসি নিজের সম্পত্তি করে নিয়েছেন, সেই ১০ নম্বর জার্সিও তখন তাঁর। এমনকি কার্লোস তেভেজ ও হার্নান ক্রেসপোকে ঘিরেও অনেক বেশি তারকাদ্যুতি। এসব বলার কারণ আছে। মেসি তখনো মেসি হয়ে ওঠেননি বলেই তাঁর এত কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।

বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রথাগত সংবাদ সম্মেলনের বাইরেও ম্যাচের আগে-পরে খেলোয়াড়দের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা বলার সুযোগ মেলে। সেই সুযোগ আসে মিক্সড জোনের রূপ ধরে। সাংবাদিক-খেলোয়াড় মিথস্ক্রিয়া বোঝাতেই হয়তো এমন নাম, যার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল এর দুই বছর আগে প্রথম অলিম্পিক কাভার করতে গিয়ে। তা মিক্সড জোন জিনিসটা কী? মোটামুটি এ রকম: একটা বড় হলরুমে কোমর সমান উচ্চতার একটা ফেন্সিং, যার একপাশে সাংবাদিকেরা দাঁড়িয়ে থাকেন। খেলোয়াড়েরা ওপাশ দিয়ে ফেরেন ড্রেসিংরুমে। ফেরার পথে ইচ্ছা হলে একটু পরপরই থেমে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলা বাধ্যতামূলক নয়। তবে বলাটাই স্বাভাবিক বলে কেউ কথা না বললে সেটিও কখনো কখনো খবর হয়।

লিওনেল মেসিকে যখন প্রথম দেখি, তখন ও একেবারেই বাচ্চা একটা ছেলে।

মেসিকে কাছ থেকে প্রথম দেখা এমনই এক মিক্সড জোনে। সম্ভবত হামবুর্গেই। আইভরিকোস্টের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে জিতেছে আর্জেন্টিনা। মেসি মাঠে নামারই সুযোগ পাননি। তখন তো খেয়াল করার কোনো কারণই নেই যে, লিওনেল স্কালোনি নামে একজনও রিজার্ভ বেঞ্চে মেসির সঙ্গী ছিলেন। সেই ম্যাচ শেষে মিক্সড জোনে রিকুয়েলমে-তেভেজ-ক্রেসপোরাই মূল আকর্ষণ। এতটাই যে সাংবাদিকদের মধ্যে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ হচ্ছে। মানে, স্বল্পপরিসর ওই জায়গাটায় রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করে আরও কাছে যাওয়ার চেষ্টা আরকি! একে তো কথাবার্তা স্প্যানিশে হচ্ছে বলে কিছুই বুঝব না জানি, তার ওপর ঠেলা-ধাক্কার বাইরে বোনাস হিসেবে কনুইয়ের গুঁতোও খেয়েছি। তাই একটু নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ধাক্কাধাক্কিতে আমার মতোই খুব একটা পারঙ্গম নন বলেই হয়তো দুজন আর্জেন্টাইন সাংবাদিকও একই পথই অনুসরণ করেছেন। তাঁরাও আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। এর মধ্যেই দূরে উঁকি দিলেন মেসি। মিক্সড জোন ধরে হেঁটে এদিকেই আসছেন। আর্জেন্টাইন সাংবাদিকদের একজন তাঁর পূর্বপরিচিতই হবেন। নইলে তাঁকে দেখেই মেসির মুখে হাসি ফুটবে কেন?

মুখে সেই হাসি নিয়েই ওই আর্জেন্টাইন সাংবাদিকের সঙ্গে মেসি কথা বলতে শুরু করলেন। ঘটনাচক্রে ওই দুই সাংবাদিকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি বলে মেসি আমার ঠিক সামনে। মাঝখানের দূরত্ব এক হাতও না। কথার বিন্দুবিসর্গও অবশ্য বুঝতে পারছি না। কারণ, কথাবার্তা যা হচ্ছে, তা সবই স্প্যানিশে। এর আগেই ব্রাজিল দলের মিক্সড জোনে পর্তুগিজ ভাষাটা জানি না বলে আফসোস হয়েছিল। এখন আফসোস হচ্ছে স্প্যানিশ জানি না বলে। এখানে অবশ্য আফসোসের মাত্রা একটু কম। ব্রাজিলের মিক্সড জোনে সামনে ছিলেন রোনালদো আর রোনালদিনিও। একজন চার বছর আগে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। আরেকজনের দুই বছর ধরে এমনই পারফরম্যান্স যে, ওই বিশ্বকাপটা কার হবে—এই প্রশ্নে সবাই সমস্বরে তাঁর নাম বলছেন।

রোনালদো-রোনালদিনিওর তুলনায় মেসি তখন কিছুই নন। যে কারণে ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকদের কাছ থেকে দুই রোনালদো (রোনালদিনহো মানে তো ছোট রোনালদো-ই) কী বললেন, তা উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলাম, এখানে তা করিনি। মেসিকে নিয়ে আলাদা স্টোরি তখন পাঠকের চাহিদার তালিকায় মোটেই ওপরের দিকে নেই। এরপর সংবাদ সম্মেলন আর মিক্সড জোন মিলিয়ে মেসিকে অনেকবারই কাছ থেকে দেখেছি। পরে তো অপ্রত্যাশিতভাবে এই ঢাকাতেও। তারপরও মেসিকে দেখার কথা বললে প্রথম দেখার ওই স্মৃতিটা অবধারিতভাবেই মনে পড়ে।

ওই বিশ্বকাপের দুই বছর পর আবারও মেসির সঙ্গে দেখা। এবার তাঁর গলায় বিজয়ীর পদক ঝোলানো। দেখা বলতে আপনি নিশ্চয়ই ধরে নিচ্ছেন না যে এটা দ্বিপক্ষীয়। এই সব দেখাদেখির স্মৃতি আমিই শুধু মনে রেখেছি। আমার সঙ্গে কবে কোথায় দেখা হয়েছে, প্রথম দেখা কোথায়—মেসিকে কি এসব কোথাও বলতে শুনেছেন? আমি তো অন্তত শুনিনি।

মেসির গলায় বিজয়ীর যে পদকের কথা বলছিলাম, সেটি অলিম্পিক ফুটবলের স্বর্ণপদক। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে ফাইনালে নাইজেরিয়াকে হারিয়ে চার বছর আগে এথেন্সে জেতা সোনা ধরে রেখেছে আর্জেন্টিনা। পরপর দুই বছরে কোপা আমেরিকা আর বিশ্বকাপ জেতার আগপর্যন্ত আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মেসির একমাত্র সাফল্য হয়ে ছিল ওই বেইজিং অলিম্পিক। ২০০৬ বিশ্বকাপের পর একটা বিশ্বকাপ বিরতি দিয়ে ২০১৪ সালে যখন আবার বিশ্বকাপ কাভার করতে গেলাম, আর্জেন্টিনার অনেক সাংবাদিককে মজা করে বলেছি, মেসিকে তো তোমরা আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু জিততে দেখোনি, আমি কিন্তু দেখেছি। যাদের বলেছি, তারা যে বেইজিংয়ে ছিলেন না, তা বোধ হয় না বললেও চলছে।

২০০৬ বিশ্বকাপে মেসি। মেসিকে নিয়ে আলাদা স্টোরি তখন পাঠকের চাহিদার তালিকায় মোটেই ওপরের দিকে নেই

অলিম্পিকে সোনা জেতার পর আর্জেন্টিনার উৎসবটা মাঠের চেয়ে মিক্সড জোনেই বেশি হয়েছিল। একটা কারণ হয়তো অসম্ভব গরম। ফাইনালটা হয়েছিল ভরদুপুরে। প্রচণ্ড গরমকে আরও দুঃসহ করে তুলেছিল ভীষণ আর্দ্রতা। একটু পরপরই রেফারিকে তাই কুলিং ব্রেক দিতে হচ্ছিল। সেই বিরতিতে মাঠের পাশে গিয়ে ফুটবলাররা পানি খেয়ে, মাথায় পানি ঢেলে আবার খেলা শুরু করছিলেন। এসব রেকর্ড রাখার চল নেই, নইলে আন্তর্জাতিক ফুটবলে এতবার পানি পানের বিরতি নির্ঘাত রেকর্ড বইয়ে থাকত।

গলায় ঝোলানো পদক আর হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে মিক্সড জোনে মেসি-আগুয়েরোদের নাচানাচি এখনো চোখে ভাসে। আর্জেন্টাইন এক সাংবাদিককে দোভাষী বানিয়ে মেসিকে কী যেন একটা প্রশ্নও করেছিলাম সেদিন। পুরোনো পত্রিকার রিপোর্ট ঘাঁটলে হয়তো তা জানাও যেত। এ লেখায় তা এমন কিছু যোগ করবে না বলে সেই ঝামেলায় আর যেতে ইচ্ছা করল না।

লিওনেল মেসিকে নিয়ে এত কথা পড়তে পড়তে এরপর কার নামটা আসবে, আপনি তা অনুমান করে ফেলেছেন বলে মনে হয়। মেসি বললেই আরেকটা যে নাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে, সেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকেও কাছ থেকে প্রথম দেখা ২০০৬ বিশ্বকাপেই। মেসির চেয়ে দুই বছরের বড়, তবে রোনালদোও তখনো রোনালদো হয়ে ওঠেননি। সেই বিশ্বকাপে আরও অনেক তারার ভিড়ে মেসি-রোনালদো দুজনেরই পরিচয় ‌‘উদীয়মান প্রতিভা’। আমি কেন, কেউই তখন কল্পনা করতে পারেননি, পরের দেড় দশকেরও বেশি এই দুজনের দ্বৈরথ ফুটবল–বিশ্বকে এমন আন্দোলিত করবে। কীভাবে করবেন, ফুটবল ইতিহাসই তো এমন কিছু দেখেনি এর আগে। কল্পনারও তো একটা লাগাম থাকে!

ন্যুরেমবার্গে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পর্তুগালের ম্যাচ রীতিমতো যুদ্ধে রূপ নিয়েছে, ম্যাচ–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন আর মিক্সড জোনেও ছড়িয়ে পড়েছে সেই উত্তাপ। সেই মিক্সড জোনেই রোনালদোকে প্রশ্ন করেছিলাম, এমন ম্যাচ আগে কখনো খেলেছেন কি না।

আগেই তো বলেছি, প্রথম দেখার দিন মেসিকে সামনে পেয়েও কোনো প্রশ্ন করিনি। রোনালদোকে কিন্তু করেছিলাম। ন্যুরেমবার্গে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পর্তুগালের ম্যাচ রীতিমতো যুদ্ধে রূপ নিয়েছে, ম্যাচ–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন আর মিক্সড জোনেও ছড়িয়ে পড়েছে সেই উত্তাপ। সেই মিক্সড জোনেই রোনালদোকে প্রশ্ন করেছিলাম, এমন ম্যাচ আগে কখনো খেলেছেন কি না।

কেমন ম্যাচ, তা একটু মনে করিয়ে দেওয়া কর্তব্য বলে মনে হচ্ছে। ‌‘ব্যাটল অব ন্যুরেমবার্গ’ নামে কুখ্যাত হয়ে থাকা সেই ম্যাচে রুশ রেফারি ভালেন্তিন ইভানভকে চারবার লাল কার্ড বের করতে হয়েছিল, ১৬ বার হলুদ কার্ড। চার লাল কার্ডের রেকর্ড এখনো অটুট, হলুদ কার্ডের রেকর্ড ভেঙেছে গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস ম্যাচে। লাল কার্ডের সংখ্যা আরও একটি বাড়ত, যদি প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়কে মাথা দিয়ে গুঁতো দিয়েও পার পেয়ে না যেতেন লুইস ফিগো। ‌‌‘ব্যাটল অব ন্যুরেমবার্গ’ কথাটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, মাঠে যতটা না ফুটবল হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি যুদ্ধ।

সেই ম্যাচ শেষে পর্তুগালের সাংবাদিকদের সঙ্গে রোনালদো পর্তুগিজেই কথা বলছিলেন। ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে তত দিনে বছর তিনেক খেলা হয়ে গেছে। সেই সুবাদে রোনালদো যে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো ইংরেজি বলতে পারেন, তা আগেই জেনেছি। আমার ইংরেজিতে করা প্রশ্নের উত্তরটাও ইংরেজিতেই দিয়েছিলেন রোনালদো। তবে তা সীমাবদ্ধ ছিল দুটি শব্দেই, ‘নো, নেভার’।

২০০৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলেছিল পর্তুগাল। ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচটা হয়েছিল মিউনিখের আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায়। খেলা দেখার জন্য স্টেডিয়ামটা সাংবাদিকদের জন্য রীতিমতো স্বর্গ। জার্মানির বেশির ভাগ স্টেডিয়ামে প্রেসবক্স ছিল দোতলা-তিনতলা উচ্চতায়, কোনোটা তো মহাকাশের কাছাকাছি। আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় যেখানে মাঠ শেষ, সেখানেই প্রেসবক্স শুরু। ভাগ্যক্রমে মাঠ লাগানো প্রেসবক্সের দ্বিতীয় সারির একটা চেয়ারে পড়েছিল আমার সিট। যেখানে বসে প্রাণভরে ম্যাচটা দেখেছিলাম। একই সঙ্গে মাঠের বাইরেও চোখ রাখতে হচ্ছিল। পর্তুগালের ডাগআউট ছিল ঠিক আমার সামনে। সেখানে কোচ লুই ফেলিপে স্কলারির কাণ্ডকীর্তি থেকেও চোখ সরানো যাচ্ছিল না। ডাগআউটে অস্থির কোচ হিসেবে স্কলারির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এক মার্সেলো বিয়েলসাই আসতে পারেন। এবং বিয়েলসাও না। ডাগআউটের বিয়েলসাও যথেষ্টই বিনোদন। তবে তাঁর সিলেবাসে স্কলারির মতো প্রতিপক্ষের বেঞ্চের দিকে কটাক্ষ আর টিটকারি নেই।

‘নো, নেভার’।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো

রোনালদো প্রসঙ্গে স্কলারি এলেন, কারণ ওই ম্যাচটার কথা মনে হলে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে ‘ক্রিস্টিয়ানো, ক্রিস্টিয়ানো’ বলে স্কলারির চিৎকারটাও আমার কানে বাজে। ঘটনা হলো, ফ্রেঞ্চ ফুটবলারদের পায়ে বল গেলেই স্কলারি চাইছিলেন পর্তুগিজ খেলোয়াড়েরা সব প্রেসিং করুক। অন্তত প্রতিপক্ষের কাছের খেলোয়াড়কে মার্কিং। রোনালদোর এসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই দেখেই স্কলারির ওই ‌‘ক্রিস্টিয়ানো, ক্রিস্টিয়ানো’ চিৎকার। তাতেও খুব একটা কাজ হয়েছিল বলে মনে পড়ে না।

পর্তুগাল তখনো ‌‘রোনালদোর পর্তুগাল’ হয়ে ওঠেনি। রোনালদোও সিআরসেভেন না।

সেই বিশ্বকাপেও বেশ ভালো খেলেছিলেন রোনালদো। তবে পর্তুগাল তখনো ‌‘রোনালদোর পর্তুগাল’ হয়ে ওঠেনি। আট বছর পর ব্রাজিলে আমার দ্বিতীয় বিশ্বকাপ কাভার করতে যাওয়ার অনেক আগেই যা হয়ে গেছে। সেই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে হেরে পর্তুগাল খাদের কিনারায়। যেটির জের হিসেবে ঘানার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে কঠিন এক সমীকরণ। দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে শুধু জিতলেই চলবে না। বড় ব্যবধানে জিততে হবে, সঙ্গে পক্ষে আসতে হবে জার্মানি-যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচের ফল। সেই ম্যাচের আগে প্রথাগত প্রিভিউ না লিখে রোনালদোর কাছে একটা খোলা চিঠির মতো লেখা লিখেছিলাম। যেটির শিরোনাম ছিল—রোনালদো, আজ ইউসেবিও হয়ে ওঠার দিন। ইউসেবিও মানে রোনালদো-পূর্ব পর্তুগালের সেরা ফুটবলার। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা, উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে একাই চার গোল করে ৩-০-তে পিছিয়ে পড়ার পরও পর্তুগালকে জেতানোর নায়ক।

রোনালদো সেদিন ইউসেবিও হতে পারেননি, পর্তুগালও বিদায় নিয়েছিল প্রথম রাউন্ড থেকেই। মিক্সড জোনে রোনালদোকেই সবচেয়ে মনমরা লেগেছিল সেদিন। যেটির কাছাকাছি কিছু দেখেছিলাম কাতার বিশ্বকাপে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে কোচ ফার্নান্দো সান্তোস যখন তাঁকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখার অভাবনীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে এই ম্যাচেও বসেছিলাম পর্তুগালের ডাগআউটের পেছনে। মাঠের খেলার চেয়েও বেশি মনোযোগ ছিল মাঠের পাশে—দেখি, রোনালদো কী করেন!

বিশ্বকাপে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডই সব ম্যাচ কাভার করার নিশ্চয়তা নয়। প্রতিটি ম্যাচের জন্যই আলাদা ম্যাচ টিকিট লাগে। অনলাইনে আগেই সেটির জন্য আবেদন করতে হয়। কাতার বিশ্বকাপে সেই আবেদন করার সময় মাথায় রাখতে হতো, কোনটা না মেসি বা রোনালদোর শেষ ম্যাচ হয়ে যায়। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে কে না চায়! এটা মাথায় থাকার পরও কোনো লাভ হয়নি। মরক্কোর বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে হারার পর রোনালদোর কান্নাভেজা বিদায় টেলিভিশনেই দেখতে হয়েছে। একই দিনে যে আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস কোয়ার্টার ফাইনালও ছিল। মরক্কোর কাছে পর্তুগাল হেরে যাবে, এটা কল্পনাও করিনি বলে মেসি না রোনালদোর মধ্যে একটা বেছে নিতে দুবার ভাবিনি। ম্যাচের মতো মিক্সড জোনে যেতেও আলাদা টিকিট লাগে। কাতারে কপাল এতই খারাপ ছিল যে একদিনও তা পাইনি। কাতারে পর্তুগাল দলের আবাসই ছিল দোহা থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে। সেখানেও যাওয়া হয়নি বলে শেষ বিশ্বকাপে ম্যাচের বাইরে রোনালদোকে তেমন দেখাই হয়নি। ইদানীং অবশ্য মনে হয়, রোনালদোকে দেখা এমন কঠিন কী! সৌদি আরব তো আর তেমন দূরে নয়। অন্তত ইংল্যান্ড-স্পেন-ইতালির চেয়ে তো অনেক কাছে।

মেসি-রোনালদোর কথাই সবিস্তার বললাম। তবে মনে করার চেষ্টা করে দেখছি, তিনটি বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করার সুবাদে গত ২০–২২ বছরের বিশ্বসেরা ফুটবলারদের প্রায় সবাইকেই কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। একটা আফসোস অবশ্য রয়েই গেছে। কখনোই আলাদা করে কারও মুখোমুখি ইন্টারভিউ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। বিশ্বকাপের সময় সেই সুযোগ পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বিশ্বকাপের বাইরে আর তাঁদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগই–বা কই!

ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী দলের মিডফিল্ডার ক্রিস্টিয়ান কারেম্বু যখন ঢাকায়

সুযোগ অবশ্য এসেছিল দুবার। একবার তা কাজেও লাগিয়েছি। যদিও ক্রিস্টিয়ান কারেম্বুর ইন্টারভিউ করেছি—এটা ঠিক গর্বভরে ঘোষণা দেওয়ার মতো কিছু নয়। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন, ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ, ইউরো, কনফেডারেশন কাপ সবকিছু—এই বিবেচনায় অবশ্যই বড় ফুটবলার। তবে কিংবদন্তিসম কেউ তো নন। যদিও কারেম্বুর ইন্টারভিউ করে খুব মজা পেয়েছিলাম। তারকাসুলভ কোনো অহমিকা তো নেই-ই; বরং এমন হাসিখুশি যে আনুষ্ঠানিক ইন্টারভিউয়ের বদলে যেন আড্ডাই হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। ইন্টারভিউয়ের মাঝখানে একবার তো দুজনের ভূমিকাও অদল-বদল হয়ে গেল। যখন কারেম্বু মজা করে বললেন, তুমি শুধু আমাকে প্রশ্ন করছ, এবার আমি তোমাকে প্রশ্ন করি। তা করলেনও দু–তিনটা প্রশ্ন। আমিও হাসতে হাসতে সেগুলোর উত্তর দিলাম।

ক্রিস্টিয়ান কারেম্বুর বাংলাদেশে আসার উপলক্ষ ছিল ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফির ওয়ার্ল্ড ট্যুর। সেটি ২০২২ সালের জুন। ছয় মাস পর সত্যি প্রমাণিত হয়েছিল কারেম্বুর কথা দিয়ে করা ইন্টারভিউয়ের শিরোনামটা—ফাইনাল হবে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের মধ্যে, মেসি বনাম এমবাপ্পে

আমার সিভিতে বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলারের ইন্টারভিউ ওই একটাই। লিখতে লিখতেই পেশাদার সাংবাদিকজীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপটার কথা মনে পড়ে গেল। সেই আক্ষেপের একটা নামও আছে—জিনেদিন জিদান। পেলে-ম্যারাডোনা আর মেসি-রোনালদোর মাঝের সময়টায় সম্ভবত বিশ্বের সেরা ফুটবলার। রোনালদো বলতে এখানে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। যে সময়টার কথা বলছি, সেই সময়ে জিদানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যে একজনই বিবেচিত হতে পারেন, তাঁর নামও রোনালদো। মানে রোনালদো লুই নাজারিও দা লিমা।

মেসি-রোনালদোর মতো জিনেদিন জিদানকেও কাছ থেকে প্রথম দেখেছি ২০০৬ বিশ্বকাপেই। ফাইনালে তাঁর ওই পানেনকা পেনাল্টি আর মাতেরাজ্জিকে ঢুস মেরে লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়াও। কয়েক মাসের মধ্যে সেই জিদানকে ইন্টারভিউ করার এমন সুযোগ পেয়ে যাব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। ইন্টারভিউয়ের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পরও যেটিকে স্বপ্ন-স্বপ্নই লাগছিল।

মেসি-রোনালদোর মতো জিনেদিন জিদানকেও কাছ থেকে প্রথম দেখেছি ২০০৬ বিশ্বকাপেই। ফাইনালে লাল কার্ড পেয়ে বেরিয়ে যাওয়াও

এমন মনে হওয়ার কারণটা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে শুরু করার বেশ আগে থেকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাভার করতে শুরু করেছি। বিশ্ব ক্রিকেটের তারাদের কাছ থেকে দেখাটা ডালভাত হয়ে গেছে বহু দিনই। কথা বলা তো কোনো ব্যাপারই নয়, অনেকের একাধিকবার ইন্টারভিউও করা হয়ে গেছে। কারও কারও চার–পাঁচবার। যত বড় ক্রিকেটারই হোন না কেন, তার সঙ্গে কথা বলা বা ইন্টারভিউ করা অনেক দিনই তাই মনে আর রোমাঞ্চের ঢেউ তোলে না। বিশ্বসেরা ফুটবলারদের ঘটনা তো তা নয়। আমার কাছে যাঁরা এখনো দূর আকাশের তারা হয়েই আছেন। জিদানও তা-ই ছিলেন। বলতে গেলে এখনো আছেন। কিন্তু জিদান কেন আমার কাছে এমন আক্ষেপের নাম? সেই গল্প দিয়েই শেষ করি লেখাটা।

বার্লিনের ফাইনালে ওই ঢুস-কাণ্ডের মাস চারেক পরই জিদান ঢাকায়। সেটিও এমন এক কারণে, যার সঙ্গে ফুটবলের কোনো সম্পর্ক নেই। একটা প্রদর্শনী ম্যাচে মাঠে নেমে বাংলাদেশের অনেক তরুণ ফুটবলারকে বাকি জীবন গল্প করার রসদ উপহার দিয়েছিলেন সত্যি, তবে জিদানের বাংলাদেশে আসার মূল উপলক্ষ ছিল দই। ঠিকই পড়েছেন—দই-ই। সুনির্দিষ্টভাবে বললে ফরাসি এক কোম্পানির সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হতে যাওয়া শক্তি দই।

জিদান আসছেন শুনেই তাঁর একটা ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করলাম। যতটা কঠিন হবে ভেবেছিলাম, তার চেয়ে একটু সহজেই তা নিশ্চিত হয়ে গেল। এরপর থেকে সত্যিকার অর্থেই আমার ক্ষণগণনা শুরু। সকালে জিদানের সংবাদ সম্মেলনে উপচে পড়া ভিড়। সেখানে বসে মনে মনে আমি সন্ধ্যার ছবি আঁকছি। সন্ধ্যায় হোটেলে ইন্টারভিউয়ের সময় ঠিক হয়েছে। সময় বরাদ্দ ১৫ থেকে ২০ মিনিট। কথায় কথায় তা আরেকটু বাড়িয়ে নেওয়া কোনো ব্যাপারই হবে না। এই আত্মবিশ্বাসের উৎস জিদানের জীবন ও ক্যারিয়ারের একটু ব্যতিক্রমী এবং তুলনায় কম আলোচিত বিষয়গুলো নিয়ে সাজানো প্রশ্নমালা। ঢুস নিয়ে প্রশ্ন তো অবশ্যই করতে হবে। সেই সময়ে জিদানকে ইন্টারভিউ করতে বসে ঢুস নিয়ে প্রশ্ন না করা আর নিল আর্মস্ট্রংকে পেয়েও চাঁদে পা রাখার অনুভূতির কথা জিজ্ঞেস না করা সমান কথা। তবে শুরুতেই ঢুস প্রসঙ্গ তুললে ইন্টারভিউয়ের সুর কেটে যাবে। তাই ঠিক করে রেখেছি, অন্য সব প্রশ্ন করা হয়ে যাওয়ার পর এই প্রশ্নটা করব সবার শেষে। রেগেটেগে গেলেও ততক্ষণে ইন্টারভিউ তো দাঁড়িয়েই যাবে।

ঢাকার জিদানের সময়টা ছিল একেবারে ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা। এক মিনিট দেরি করলেও সব কেঁচে যেতে পারে। তা ছাড়া কিছু আনুষ্ঠানিকতাও আছে। সন্ধ্যায় নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই তাই জিদানের হোটেলে। একটা রুমে নিয়ে বসানো হলো আমাদের। আমাদের বলতে আমি আর আরেক পত্রিকার বন্ধুভাজন সাংবাদিক। দুজনের জন্য আলাদা সময় করা যায়নি। একসঙ্গেই ইন্টারভিউ করতে হবে। যৌথ প্রযোজনার ইন্টারভিউ আমার একদমই পছন্দ নয়। কিন্তু এখানে পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই। জিনেদিন জিদান বলে কথা।

জিদানের সফরসঙ্গীদের একজন, সম্ভবত তাঁর মিডিয়া ম্যানেজারই হবেন, সব বুঝিয়ে–টুঝিয়ে গেলেন। এমনকি কে কোথায় বসবেন, এটাও। দোভাষীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর একটা ছোট রিহার্সালমতোও হয়ে গেল। আমরা ইংরেজিতে প্রশ্ন করব, আর জিদান উত্তর দেবেন ফ্রেঞ্চে—দোভাষী তো লাগবেই।

জিদান যখন ঢাকায়

জীবনে এত ইন্টারভিউ করেছি, এমন রোমাঞ্চ নিয়ে কারও জন্য অপেক্ষা করিনি কখনো। সেই অপেক্ষা আর শেষ হচ্ছে না। অবশেষে দরজায় কার যেন ছায়া পড়ল। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। অবশেষে জিনেদিন জিদান তাহলে আসছেন। কিন্তু জিদান না, রুমে ঢুকলেন তাঁর মিডিয়া ম্যানেজার। পেছনেই তাহলে জিদান।

না, পেছনে কেউ নেই। মিডিয়া ম্যানেজার একাই এসেছেন। এসে যা বললেন, তা শোনার অব্যবহিত পরের অনুভূতিটা এখনো মনে করতে পারি। হতাশা, আশাভঙ্গ এসব দিয়ে যা ঠিক বোঝানো যাচ্ছে না। একটু বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, তবে আসলেই যা হয়েছিল, তা হলো, একটা শূন্যের অনুভূতি।

তা কী বার্তা নিয়ে এসেছিলেন ওই ভদ্রলোক? জিদান শারীরিকভাবে ভালো বোধ করছেন না। ইন্টারভিউ দিতে পারছেন না বলে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শুনেও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। দুঃখ আন্তরিক হলেই–বা কী, অনান্তরিক হলেই–বা কী আসে–যায়! আমি নিজেই তো তখন দুঃখে কাতর। যে দুঃখ বেশ কিছুদিন আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। এত বড় একটা সুযোগ, এভাবে হাত ফসকে যাওয়াটা মানতেই পারছিলাম না।

কোনো দিন যদি আবার জিদানের ইন্টারভিউ করার সুযোগ আসে, প্রথম প্রশ্ন এটা নিয়েই করব।