আর্জেন্টিনার উচ্ছ্বাসের বিপরীতে ছিল ব্রাজিলের কান্না
আর্জেন্টিনার উচ্ছ্বাসের বিপরীতে ছিল ব্রাজিলের কান্না

চেনা পথে আর্জেন্টিনা, বদলে মরিয়া ব্রাজিল

এ মুহূর্তে দুই মেরুতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী দুই ফুটবল পরাশক্তি আর্জেন্টিনাব্রাজিল। বিশ্বকাপ জিতে ‘আলবিসেলেস্তে’রা মধুর সময় পার করছে। আর ব্রাজিল খুঁজছে লম্বা সময়ের ব্যর্থতা কাটিয়ে পরিত্রাণের পথ। বিশ্বকাপের পর প্রথমবারের মতো প্রীতি ম্যাচের জন্য দল ঘোষণা করেছে দুই দল। তা দেখে এখনই ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ভবিষ্যৎ-দর্শন কঠিন হলেও ইঙ্গিত পাওয়াটা তো মোটেই দুরূহ কিছু নয়।

বিশ্বকাপ জয়ের পর এখনো উৎসবের আমেজে আছে আর্জেন্টিনা। তাদের ঘোষিত দলেও আছে সেই ছাপ। বিপরীতে ব্রাজিল দল যে বদলাতে মরিয়া, তাদের দলেও সেই আভাস পাওয়াটা দুষ্কর নয়। আর্জেন্টিনা যেখানে বিশ্বকাপ দলে থাকা ২৬ জনকেই স্কোয়াডে রেখে দিয়েছে, ব্রাজিল আবার বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ দিয়েছে ১৫ জনকে। নেইমার-সিলভাদের চোট এবং দানি আলভেজের ধর্ষণের দায়ে আটক হয়ে জেলে থাকার প্রসঙ্গ সরিয়ে রাখলেও ব্রাজিল দলে এ পরিবর্তন অনুমেয়ই ছিল।

৩৬ বছর অপেক্ষা পর অবশেষে গত ডিসেম্বরে মিটেছে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের তৃষ্ণা। ১৯৮৬ সালে ডিয়েগো ম্যারাডোনার পর লিওনেল মেসির হাত ধরে আবার বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ মেতেছে আর্জেন্টিনা দল। বিশ্বকাপ জয়ের সেই আমেজ এখনো থেকে গেছে। নানা কর্মকাণ্ড এবং সাক্ষাৎকারে উঠে আসছে সেসব প্রসঙ্গও। এর মাঝে আর্জেন্টিনা দলের জন্য বড় স্বস্তি কোচ লিওনেল স্কালোনির সঙ্গে ২০২৬ সাল পর্যন্ত চুক্তি নবায়ন হওয়া। এর মধ্য দিয়ে পরের বিশ্বকাপেও যে স্কালোনি কোচ থাকছেন তা নিশ্চিত হয়েছে।

বিশ্বকাপের আগে পরে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি ছিল লিওনেল মেসির ভবিষ্যৎ ঘিরে। কাতার বিশ্বকাপই যে নিজের শেষ বিশ্বকাপ, সে ঘোষণা মেসি নিজেই দিয়েছিলেন। সে সময় অনেকে বিশ্বকাপেই মেসির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন। তবে ১৮ ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতি বেশ বদলে গেছ। মেসির কোচ-সতীর্থদের আবদার তাঁকে ২০২৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত থাকতে হবে।

মেসির হাতের বিশ্বকাপ। এই ছবি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন আর্জেন্টাইনরা

আর্জেন্টিনা দলের এই গণদাবির সপক্ষে বা বিপক্ষে মেসি এখন পর্যন্ত স্পষ্টভাবে কোনো কিছু বলেননি। বিশ্বকাপের আগে আগামী বছর আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকার শিরোপা ধরে রাখার মিশনে নামবে, সে টুর্নামেন্ট দিয়েও অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। কোপার সাফল্য ও ব্যর্থতা বিশ্বকাপ পরিকল্পনায় যে বড় ধরনের প্রভাব রাখবে, তা বলাই বাহুল্য।

মেসি-দি মারিয়া-ওটামেন্দিদের বয়সের কারণে সরিয়ে রাখলেও গত বিশ্বকাপ দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়েরই আগামী তিন বছরের পরিকল্পনায় থাকা নিশ্চিত। কাতারে আলো ছড়ানো হুলিয়ান আলভারেজ, এনজো ফার্নান্দেজ কিংবা ম্যাক অ্যালিস্টাররা যে আগামী বিশ্বকাপেও স্কালোনির অন্যতম অস্ত্র হবেন তা একরকম নিশ্চিত।

তবে এই দলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আরও কিছু নতুন নাম। যাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য আলেহান্দ্রো গারনাচো। বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনা দলের হয় যাত্রা শুরু করলেও কাতার বিশ্বকাপের চূড়ান্ত স্কোয়াডে তাঁকে রাখেননি স্কালোনি। তাঁর বাদ পড়া নিয়ে সে সময় কিছু বিতর্কও সামনে এসেছিল। তবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর তাঁকে আর আড়ালে রাখতে পারেননি স্কালোনি।

গারনাচোর সঙ্গে অবশ্য আরও কিছু নতুন মুখকে এই প্রীতি ম্যাচে বাজিয়ে দেখতে পারেন স্কালোনি। গত জানুয়ারিতে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেওয়া ২০ বছর বয়সী ম্যাক্সিমো পেরোনেকেও দলে জায়গা দিয়েছেন স্কালোনি। তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে ধারণা পেতে একটি তথ্যই যথেষ্ট, পেরোনেকে দলে পেতে তিনবার ফোন করেছিলেন খোদ পেপ গার্দিওলা।

কাতার বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিল ছিটকে পড়ার পর নেইমারের এ কান্না কোটি ফুটবলপ্রেমীর হৃদয় ছুঁয়ে গেছে

এ ছাড়া উদীয়মানদের মধ্যে উদিনেসের নেহুয়ান পেরেজ, ব্রাইটনের ফাকুন্দো বুয়োনানত্তি, ইন্টার মিলানের ভ্যালেন্টাইন কার্বনিও জায়গা পেয়েছেন। মূলত, ২০২৬ বিশ্বকাপ সামনে রেখে অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের সমন্বয়ে কার্যকর একটি দল গড়ার ওপরই বেশি জোর দিচ্ছেন স্কালোনি। তবে দল নিয়ে স্কালোনির পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে সামনের দুটি প্রীতি ম্যাচেই সীমায়িত থাকবে না, তা বলায় যায়।

আর্জেন্টিনার ৩৪ সদস্যের দলের বিপরীতে ব্রাজিল দিয়েছে ২৩ সদস্যের দল। আর্জেন্টিনা যেমন বিশ্বকাপ জয়ের রেশ থেকে নিজেদের বের করতে পারেনি, ব্রাজিলও তাদের বিদায়ের ক্ষতে এখনো প্রলেপ দিতে পারেনি। এমনকি কোচ তিতের বিদায়ের পর নতুন কোচও তারা নিয়োগ দিতে পারেনি। দেশি-বিদেশি কোচের বিতর্কেই স্থবির হয়ে আছে সেলেসাওদের কোচ নিয়োগ। আপাতত দলটিকে চালিয়ে নিচ্ছেন অন্তবর্তীকালীন কোচ র‍্যামন মেনেজেস।

২৫ মার্চ মরক্কোর বিপক্ষে খেলতে যাওয়ার প্রীতি ম্যাচের দল থেকে বাদ পড়েছেন বিশ্বকাপ দলে ১৫ জন। এদের মধ্যে নেইমার বাদ পড়েছেন চোটে। কারও কারও হয়তো বয়স ও ছন্দ বিবেচনায় এসেছে।

ব্রাজিলের নতুন এই দলের সবচেয়ে আকর্ষণ ৯ মুখ। এই সংখ্যাটিই ভবিষ্যতের ব্রাজিল দল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিচ্ছে। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা হয়তো পুরোনোদের ওপর আস্থা রাখার চেয়ে নতুনদের তৈরিতে বেশি জোর দিতে চায়। আর মেনেজেস নিজে ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব-২০ দলের কোচের দায়িত্বে ছিলেন, তাই যেসব তরুণের ওপর তাঁর আস্থা আছে, তাঁদের রেখেই দল গড়তে চান এই কোচ। তাঁর কাছে অবশ্য এই ঝুঁকি নেওয়ার শক্ত ভিতও আছে। তাঁর অধীনেই যে এবার দক্ষিণ আমেরিকার অনূর্ধ-২০ চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৩ এর শিরোপা জিতেছে ব্রাজিল। সেই দলের বেশ কজনকে ঘোষিত দলে রেখেছেন মেনেজেস।

মেনেজেস নতুন যাঁদের সুযোগ দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে আতলেতিকো পারানায়েনেসের হয়ে আলো ছড়ানো ১৮ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড ভিতর রকি উল্লেখযোগ্য নাম। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে একই সঙ্গে ‘নতুন রোনালদো’ এবং ‘বিস্ময় বালক’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছেন রকি। তবে রকি একাই নন, আছেন চেলসিতে খেলা আরেক বিস্ময় বালক মিডফিল্ডার আন্দ্রে সান্তোসও।

অবশ্য নতুন কোচ হিসেবে অন্য কেউ আসলে মেনেজেসের নির্বাচিত দলের ওপর আস্থা রাখবেন কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। নতুন কোচ হয়তো মেনেজেসের এই নিরীক্ষার ওপর আস্থা না–ও রাখতে পারেন। তবে দ্রুত কোচ এবং সামনের দিনগুলোর কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে না পারলে তা ব্রাজিল দলের ঘুরে দাঁড়ানোর পথকেই শুধু লম্বা করবে।