রেসিফে ম্যাচটি ছিল আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। ১৯৯৪ সালের ২৩ মার্চ—চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে সেদিন ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষেক ঘটেছিল রোনালদো নাজারিওর। ১৭ বছর ৬ মাস ২ দিন বয়সী রোনালদোর পর এই শতাব্দীতে ১৮ বছরের নিচে আর কেউ ব্রাজিলের হয়ে খেলতে পারেননি।
ভিতর রকি ১৮ পেরিয়েছেন গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে রোনালদোর সেই কীর্তি ভাঙার সুযোগ নেই। তবে অন্য একটি দ্বার খোলা আছে। মরক্কোর বিপক্ষে অভিষেক হলে এ শতাব্দীতে রকি হবেন ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষিক্ত সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়।
রোনালদোর পর সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবেও ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষেকের সুযোগ থাকছে রকির। আর মরক্কোর বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচটিও রোনালদোর অভিষেকের মতোই মার্চে—২৫ তারিখের জন্য নিশ্চয়ই দিন গুনছেন রকি!
রকি—নামটা শুনলে কারও কারও সিলভ্যালেস্টার স্ট্যালোনকে মনে পড়তে পারে। সত্তরের দশকে হলিউড কিংবদন্তি অভিনীত ‘রকি’ সিনেমার আলাদা একটা তাৎপর্য আছে। মুষ্টিযুদ্ধ নিয়ে বানানো এই সিরিজ সিনেমার চিত্রনাট্য স্ট্যালোনের লেখা। ‘আমেরিকান ড্রিমস’—এর স্বপ্নে বিভোর তরুণদের জাগিয়ে তোলার প্রেরণা হিসেবে ‘রকি বালবোয়া’ চরিত্রের জন্ম দিয়েছিলেন স্ট্যালোন। ব্রাজিলের এই রকিও তেমন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।
রোনালদো লুইস নাজারিও দি লিমা অবসর নেওয়ার পর হন্যে হয়ে তাঁর মতো ‘নাম্বার নাইন’ খুঁজছে ব্রাজিল। বছর যায়, বছর আসে, স্ট্রাইকার যায়, স্ট্রাইকারও আসে—কিন্তু মনের মতো কেউ মেলে না। প্রতিপক্ষের বক্সে বল পায়ে ব্রাজিলিয়ানদের মনে সেই আস্থা কেউ জাগিয়ে তুলতে পারেননি। কাতার বিশ্বকাপে রিচার্লিসনে ভরসা রাখা হয়েছিল। প্রতিদান মিলেছে সামান্যই। আর খেলার ধরন ও দক্ষতায় রিচার্লিসনকে সরাসরি ‘রোনালদোর মতো’ বলা যায় না। তবু স্বপ্ন দেখা তো থেমে থাকে না।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা অবসর নেওয়ার পর যেমন প্রায় প্রতি মৌসুমেই ‘নতুন ম্যারাডোনা’ তকমার কেউ না কেউ আলোচনায় উঠে আসেন, তেমনি ব্রাজিলেও ৯ নম্বর জার্সিতে সম্ভাবনাময় কাউকে দেখলে বলা হয় ‘নতুন রোনালদো।’
ভিতর রকিকেও এই তকমার ‘বোঝা’ বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু সেটি মোটেও চাপিয়ে দেওয়া নয়। মাত্রই ১৮ পূর্ণ করা রকির প্রতিভাই তাঁকে ধীরে ধীরে সর্বকালের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। কতটা এগোতে পারবেন, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু স্বপ্ন তো দেখাই যায়!
ব্রাজিল এই স্বপ্নই দেখছে গত ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আমেরিকার অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয়ের পর। কোচ র্যামন মেনেজেসের অধীনে সে টুর্নামেন্টে ৬ গোল করে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন রকি। এরপর মেনেজেস জাতীয় দলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব পাওয়ার পর কাল প্রথম স্কোয়াড ঘোষণাতে ডেকেছেন তাঁকে। বাকি পথটা নির্ভর করছে তাঁর, অর্থাৎ রকির নিজের ওপর।
এরই মধ্যে শুধু রোনালদো নয়, ব্রাজিলের ‘লুইস সুয়ারেজ’ ও ব্রাজিলের ‘সের্হিও আগুয়েরো’ বলেও রকিকে ডাকছেন কেউ কেউ। হ্যাঁ, প্রত্যাশার বোঝাটা দিন দিন ভারী হচ্ছে। তবে রকি যেহেতু অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন ৯ নম্বর জার্সিতে এবং শক্তিশালী শরীরের সঙ্গে পা দুটোও চলে চাকুর মতো—তাই ‘ফেনোমেনন’–এর স্মৃতিই ভেসে ওঠে সবার আগে।
রোনালদোর পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ক্রুজেইরোয়। বলা হয়, সব ফুটবলারই পেশাদার ক্যারিয়ারে প্রথম গোল মনে রাখেন। ১৬ বছর বয়সে ক্রুজেইরোর হয়ে প্রথম গোলটি নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন রোনালদো? তাহলে রকিরও মনে থাকার কথা।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে রোনালদো তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম ক্লাবের (ক্রুজেইরো) মালিকানায় যখন এলেন, তার দুই মাস আগে ক্রুজেইরোর হয়েই পেশাদার ফুটবলে অভিষেক রকির। রোনালদোর মতোই ১৬ বছর বয়সে ক্রুজেইরোয় অভিষেক, ১৬ বছর বয়সেই (২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে) পেশাদার ক্যারিয়ারের প্রথম গোল! সেই গোলের পর রকি বলেছিলেন, ‘প্রথম গোলটি তো কেউ ভোলে না। খুব ভালো লাগছে। তার (রোনালদো) দলে থাকাটা আমার জন্য খুব আনন্দের।’
তবে রোনালদোর খারাপ লাগতে পারে। আতলেতিক মিনেইরো ও ক্রুজেইরোর ‘ডার্বি’তে সবচেয়ে কম বয়সী পাঁচ গোলদাতার তালিকা থেকে ‘ফেনোমেনন’ ছিটকে পড়েছেন এই রকির কারণেই। কথাটা মজা করে বলা। প্রতিভা আগলে রাখতে কার না ভালো লাগে! কিন্তু রোনালদো তা পারেননি। এই ক্রুজেইরোতেই রোনালদো থাকতে তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়েছিল। পরে তো পিএসভি আইন্দহভেনে চলে গেলেন।
রকির ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তেমন নয়। ক্রুজেইরোর অভিযোগ, গত বছর রকিকে তাঁর এজেন্ট ফুসলিয়ে ক্লাব থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অ্যাথলেটিকো পারানায়েনসের হাতে তুলে দিয়েছে। রকিকে অবশ্য মুফতে পায়নি ক্লাবটি। ক্রুজেইরোর কাছে তুলে দিতে হয়েছে ৪৪ লাখ ইউরো, যা তাদের ক্লাব–রেকর্ড। পারানায়েনস নতুন রিলিজ ক্লজ দাঁড় করায় ২৪ মিলিয়ন ব্রাজিলিয়ান রিয়াল।
রিলিজ ক্লজের অঙ্কটা কেন এত বড়, রকি সেটি বোঝানো শুরু করেন ছয় সপ্তাহ পর। লিগ ও কোপা লিবার্তোদোরেসে অ্যাথলেটিকো পারানায়েনসের হয়ে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড গড়েন। যার সুবাদে বড়সড় প্রশংসা জুটল লুই ফেলিপে স্কলারির কাছ থেকে। ‘বিগ ফিল’ গত বছর মে মাসে পারানায়েনসের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। ম্যানেজারের দায়িত্বেও ছিলেন। ব্রাজিলকে ২০০২ বিশ্বকাপ জেতানো এ কোচ রোনালদোর সেরা সময়টা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ২১ বছর আগে তাঁর অধীনেই বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে তুলেছিলেন রোনালদো।
সেই রোনালদোর সঙ্গে রকির মিল কেমন, সেটা স্কলারির মুখেই শুনুন, ‘আমরা তাকে যা-ই বলি, সে সেটাই করতে পারে। তবে তার সেরা জায়গা হলো ৯ নম্বর। সেখানে কীভাবে খেলতে হবে, সে জানে। জায়গা বের করতে পারে। আমি অন্তত খেলোয়াড়ি জীবনে এমন ৯ নম্বরের মুখোমুখি হতে চাইতাম না।’
বার্সেলোনা কিংবা ইন্টার মিলানে শুরুর দিকে রোনালদোর খেলা মনে থাকলে কিছুটা মিল খুঁজে পেতে পারেন। চোটের কারণে গতি কমে যাওয়ার আগে মাঝমাঠ থেকে বল টেনে বক্সে ঢোকাটা প্রায় অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছিলেন রোনালদো। নিখাদ ৯ নম্বরের প্রসঙ্গ পরে, ওয়াইড স্ট্রাইকার হিসেবে এই কাজটা ভালো পারেন রকি। রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা তাই পিছু ছুটছে।
রকির নিজের ইচ্ছা বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ‘স্পোর্ত’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে কথাই বলেছেন। রোনালদো নিজেও বার্সায় এক মৌসুম আলো ছড়িয়েছেন, স্যার ববি রবসনের অধীনে সে মৌসুমেই নিজেকে পূর্ণমাত্রায় মেলে ধরেছিলেন রোনালদো। রকির সামনে এখনো দীর্ঘ পথ বাকি। কিন্তু রোনালদো মনে করেন, ‘ছেলেটি অনেক উঁচুতে উঠবে।’
উচ্চতাটা ঠিক কোথায়, রোনালদোর ক্যারিয়ারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তবে ‘গাছে কাঁঠাল’ দেখে ব্রাজিলিয়ানদের এখনই ‘গোঁফে তেল’ মাখতে নিষেধ করেছেন রকির বাবা জুভেনাল। রোনালদোর সঙ্গে তুলনাকে ‘অযৌক্তিক’ বলে মনে হয় তাঁর, ‘কোনো ব্যাখ্যা নেই। এটা অযৌক্তিক। বিশ্বসেরা কারও মুখে ছেলের প্রশংসা শুনতে ভালোই লাগে। সবাই বলছে সে ফেনোমেননের পথেই আছে।’
রোনালদোর পথে কিন্তু শুধু সাফল্য নেই। ভয়ংকর দুটি চোটও আছে, যে কারণে তাঁর পুরোটা বেশি দিন দেখা যায়নি। ভিতর রকি নিশ্চয়ই তা জেনেই পথে নেমেছেন!