মোহামেডানের উজবেক ফুটবলার মোজাফফরদিন মোজাফফরভ
মোহামেডানের উজবেক ফুটবলার মোজাফফরদিন মোজাফফরভ

মোহামেডানের ‘বড় অস্ত্র’ এখন মোজাফফরভ

আজামত আবদু রহিমভ নামটা এই প্রজন্ম সেভাবে জানে না। মোহামেডানের পাঁড় সমর্থক আর এ দেশের ফুটবল ইতিহাসের নিবেদিত অনুসারী না হলে নামটা শোনার কথাও নয়।

উজবেকিস্তানের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই তারকা ৩১ বছর আগে খেলে গেছেন মোহামেডানের সাদাকালো জার্সিতে। ১১ ম্যাচে ১৭ গোল করে তিনি হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। আজও তিনি প্রবীণ মোহামেডান সমর্থকদের নস্টালজিয়ার অংশ। রহিমভের জাদু ভুলতে পারেন না মোহামেডান–অন্তঃপ্রাণেরা।

গত দুই যুগের বেশি সময়ে মোহামেডানে খেলে গেছেন অনেক বিদেশি ফুটবলার। কিন্তু উজবেকিস্তান থেকে রহিমভের পর আর কেউ আসেননি। ২০২২ মৌসুমে মোজাফফরদিন মোজাফফরভ নামটি যুক্ত হলো মোহামেডানের খেলোয়াড় তালিকায়।

কিন্তু এ নিয়ে খুব একটা আলোচনা ছিল না। রহিমভের দেশের এই মিডফিল্ডার এমন কিছু করতে পারেননি যে তিনি তাঁর পূর্বসূরির স্মৃতি উসকে দিতে পারেন। কিন্তু নিজের দ্বিতীয় মৌসুমের শুরুতে সেই মোজাফফরভই এখন মোহামেডানের অন্যতম সেরা অস্ত্র। দলের সাফল্যের প্রাণভোমরা। উজবেকিস্তান জাতীয় দলে খেলা এই ফুটবলারকে ঘিরেই এখন ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখছে মোহামেডানের সমর্থকেরা।

স্বাধীনতা কাপ ফুটবলের কোয়ার্টার ফাইনালেই ২৫ গজ দূর থেকে দুর্দান্ত এক ফ্রি–কিকে গোল করে তিনি আলোচনায় আসেন। গতকাল গোপালগঞ্জে প্রথম সেমিফাইনালে তাঁর আরেকটি বুদ্ধিদীপ্ত ফ্রি–কিক গোলেই রহমতগঞ্জকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে মোহামেডান। মে মাসে আবাহনীকে টাইব্রেকারে হারিয়ে মোহামেডানের ফেডারেশন কাপ জয়ের সেই ফাইনালেও উজবেকিস্তানের এই ফুটবলার রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

মোহামেডানকে স্বাধীনতা কাপের ফাইনালে তোলার নায়ক মোজাফফরভ গতকাল ম্যাচসেরা হয়েছেন

বেশ কয়েক বছর ধরেই দারুণ কয়েকজন বিদেশি ফুটবলার এ দেশের ফুটবলে তারকা হয়ে উঠেছেন। সাদাকালো জার্সিতে মোজাফফরভও যে সেই তারকা দলের অংশ হয়ে উঠছেন, সেটি বলতেই হচ্ছে।

মোজাফফরভ নিজেও দারুণ উপভোগ করছেন সময়টা। পরপর দুটি নকআউট ম্যাচে তাঁর দুর্দান্ত দুটি গোল মোহামেডানকে জয় এনে দিয়েছে—ব্যাপারটা ভালো লাগছে তাঁর কাছেও, ‘আমি দলের সাফল্যে অবদান রাখতে পেরে আনন্দিত। সামনেও এভাবেই খেলে যেতে চাই।’

গত মে মাসে ফেডারেশন কাপ ফাইনালে মোজাফফরভের পারফরম্যান্স তাঁকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি করেছিল প্রথম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই উজবেক মিডফিল্ডারকে খুব ভালোভাবেই চিনেছিলেন আবাহনীতে সদ্যই সাবেক হয়ে যাওয়া পর্তুগিজ কোচ মারিও লেমোস। তিনি গত আগস্টে আবাহনীর এএফসি কাপ অভিযাত্রায় মোজাফফরভকে দলের অংশ বানিয়েছিলেন। সিলেটে মালদ্বীপের ক্লাব ইগলসের সঙ্গে প্রাথমিক রাউন্ডের ম্যাচ আর প্লে–অফে ভারতের মোহনবাগানের বিপক্ষে মোজাফফরভ খেলেছিলেন আবাহনীর জার্সিতে। দুটি ম্যাচেই মাঝমাঠের চালিকা শক্তি ছিলেন তিনি।

লেমোস সেই সময় প্রথম আলোকে বলেছিলেন মোহামেডান থেকে মোজাফফরভকে ধার করে নিয়ে আসার কারণটা, ‘এমন খেলোয়াড় দলে থাকাটা স্বস্তির। মাঝমাঠে খুবই পরিশ্রম করে খেলতে পারে মোজাফফরভ। সেট পিসে সে দারুণ।’

মোহামেডান দলের প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছেন মোজাফফরভ (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)

আবাহনীর সাবেক পর্তুগিজ কোচ রত্ন চিনেছিলেন। মোজাফফরভকে মোহামেডানও নিয়েছিল তাঁর পরিশ্রমী ফুটবল খেলার সামর্থ্য আর সেট পিসের কারণেই। কোচ আলফাজ আহমেদ বললেন সেটিই, ‘এজেন্টের মাধ্যমে মোজাফফরভকে আমরা খুঁজে পাই। তখনই দেখি ফ্রি–কিক থেকে গোল করার সামর্থ্য দুর্দান্ত। মাঝমাঠে বল প্লে, দলকে খেলানোর ব্যাপারটিও ওর আছে। মোহামেডানে সে এই ভূমিকাই পালন করছে।’
যে ফ্রি–কিক নিয়ে এত আলোচনা, মোজাফফরভ অবশ্য সেটিকে অনুশীলনের ফলই বলছেন, ‘আমি প্রচুর অনুশীলন করি। আপনারা হয়তো সেটিরই ফল দেখছেন। ফ্রি–কিক অনেকভাবেই নেওয়া যায়। অনুশীলনের মাধ্যমেই এর সফল প্রয়োগটা খুঁজে পাওয়া যায়।’

মোজাফফরভ জানেন তাঁর দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার রহিমভ বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের স্মৃতির অংশ। বাংলাদেশে আসার আগেও নাকি রহিমভের সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর, ‘আমি জানি, রহিমভ মোহামেডানে খেলে গেছেন। তিনি উজবেকিস্তানের অন্যতম সেরা ফুটবলার। এখন কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। মোহামেডানের প্রস্তাব পাওয়ার পর আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি এ দেশের ফুটবল সম্পর্কে বলেছেন আমাকে। মোহামেডান সম্পর্কে বলেছেন।’

উজবেকিস্তানে রিয়াল মাদ্রিদের একটা ফুটবল একাডেমি আছে। দেশটির শহর বেকাবাদে রিয়াল মাদ্রিদ ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় গড়ে ওঠা এই একাডেমিতে ফুটবলের পাঠ নিয়েছেন মোজাফফরভ। তবে তাঁর ফুটবল–জীবনের শুরুটা পাখতাকোরে অবস্থিত দেশটির সর্ববৃহৎ ফুটবল একাডেমিতে। বাবা ছিলেন ফুটবল কোচ, বড় ভাইও। তাঁদের হাত ধরেই তাঁর ফুটবলার হয়ে ওঠা। উজবেকিস্তানের পেশাদার ফুটবল খেলেছেন কয়েকটি ক্লাবে। সোগদিয়ানা থেকে নেফচি। এরপর এজিএমকে ও তুরোন। সর্বশেষ দিনামো সামারকান্দের হয়ে। সব কটিই উজবেকিস্তানের শীর্ষ লিগের দল।

উজবেকিস্তানে রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল একাডেমিতে পাঠ নিয়েছে মোহামেডানের মোজাফফরভ

উজবেক জাতীয় দলের হয়ে তিনটি ম্যাচ খেলেছেন ২০২০ সালে। এরপর চোটের কারণে ছিটকে পড়েন দল থেকে। ব্যাপারটি খুবই পোড়ায় মোজাফফরভকে। তবে তিনি আত্মবিশ্বাসী শিগগিরই জাতীয় দলে ফেরার ব্যাপারে, ‘দেশের হয়ে মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলেছি। সেটা ২০২০ সালে। হঠাৎ করেই চোটে পড়ে ছিটকে যাই জাতীয় দল থেকে। খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি শিগগিরই জাতীয় দলে ফিরতে চাই।’

আপাতত তাঁর সব মনোযোগ মোহামেডান নিয়ে। গত মৌসুমে এলেও খুব ভালো করতে পারেননি বলে আক্ষেপ তাঁর, ‘গত বছর প্রথম মৌসুমে আমি ভালো করতে পারিনি। আমার কাছ থেকে ক্লাবের যে প্রত্যাশা ছিল, সেটি পূরণ করতে পারিনি। নতুন জায়গা, খাপ খাইয়ে নিতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। তবে এবার আমি ভালো কিছু করতে চাই। মোহামেডানকে সাফল্য এনে দিতে চাই।’

১৯৯২ সালে রহিমভ লিগ জেতাতে পারেননি মোহামেডানকে। কিন্তু যা করে গেছেন, সেটি স্মরণীয় হয়েই আছে। মোজাফফরভও স্মরণীয় হয়ে রইবেন রহিমভের কাছাকাছিও যদি কিছু করতে পারেন।