লিওনেল মেসি যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারের দল ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। প্যারিস ছাড়ার পর মেসির সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে মায়ামির নাম এসেছে বারবারই। কিন্তু সৌদি আরবের ক্লাব আল হিলালের অর্থের ঝনঝনানি আর আর্জেন্টাইন তারকার বার্সেলোনায় ফেরার ইচ্ছার ব্যাপারটি মাথায় রেখে অনেকেই মায়ামির প্রস্তাবকে খুব একটা পাত্তা দিতে চাননি।
গত কয়েক মাসে মেসির নামের সঙ্গে আল হিলাল কিংবা বার্সেলোনার নাম যতবার উচ্চারিত হয়েছে, মায়ামির নাম ঠিক ততবার উচ্চারিত হয়নি। অনেকটা চুপচাপ থেকেই মোক্ষম কাজটা করে ফেলেছে ফ্লোরিডাভিত্তিক যুক্তরাষ্ট্রের এই ফুটবল ফ্র্যাঞ্চাইজি। এই দলের মালিক ইংল্যান্ডের সাবেক মিডফিল্ডার তারকা ডেভিড বেকহাম।
যুক্তরাষ্ট্রের লিগে মেসিই ফুটবলের প্রথম বড় নাম নয়। বিশ্বখ্যাত তারকা ফুটবলারদের অনেকেই অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের লিগে খেলেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলে। সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকা ক্যারিয়ারে কখনো ইউরোপিয়ান লিগে না খেললেও যুক্তরাষ্ট্রে খেলেছিলেন। তখন অবশ্য এই লিগের নাম ‘মেজর লিগ সকার’ ছিল না। ১৯৭৫ সালে ৩৫ বছর বয়সে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোস ছেড়ে পেলে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সই করেন নিউইয়র্কের ক্লাব কসমসে। পেলের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলকে দারুণ জনপ্রিয় করে তোলে।
একটা সময় যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবল খেলা কেউই দেখতোন না। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটা পছন্দই করতেন না আমেরিকানরা। পেলে কসমসে সই করার পর বিষয়টি আমূল পাল্টে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপে খেলেছিল। ১৯৫০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের মতো দলকে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল গোটা দুনিয়াকে। তবে পেলের কসমসে আগমনকে মার্কিন ফুটবলের পুনরুজ্জীবন বলা হয়ে থাকে।
শুধু পেলেই নয়, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল লিগে নাম লিখিয়েছেন অনেক বিখ্যাত ফুটবলারই। সেখানে খেলতে গেছেন বিখ্যাত জার্মান কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, গার্ড মুলার। নেদারল্যান্ডস কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফও খেলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। খেলেছেন ব্রিটিশ তারকা ববি মুর, জর্জ বেস্টও। সাম্প্রতিক অতীতের অনেক বড় বড় তারকা ফুটবলারই খেলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
এঁদের মধ্যে আছেন ডেভিড বেকহাম, থিয়েরি অঁরি, গ্যারেথ বেল, ডেভিড ভিয়া, দিদিয়ের দ্রগবা, ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, বাস্তিয়ান শোয়েনস্টাইগার, জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, ওয়েইন রুনি, কাকা প্রমুখ।
পেলের মতো ইয়োহান ক্রুইফও নিউইয়র্ক কসমসে খেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি ১৯৭৯ সালে তাদের প্রস্তাব গ্রহণ না করে খেলেন লস অ্যাঞ্জেলস অ্যাজটেকা ক্লাবের হয়ে। একটা বিষয় উল্লেখ করে নেওয়া যেতে পারে, পেলে, ক্রুইফ, জার্ড মুলাররা যখন যুক্তরাষ্ট্রে খেলেছেন, সেটি কিন্তু ‘মেজর লিগ সকার’ ছিল না। ‘নর্থ আমেরিকান সকার লিগ’ নামে পরিচিত ফুটবল লিগে খেলেছেন পেলে, ক্রুইফরা।
বুন্দেসলিগার ক্যারিয়ার শেষ করে ১৯৭৯ সালেই গার্ড মুলার পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি সেখানে তিন মৌসুম খেলে ৩৮ গোল করেছিলেন। তিনি খেলেছিলেন ফোর্ড লর্ডারডেল স্ট্রাইকার্সের হয়ে। আরেক জার্মান কিংবদন্তি বেকেনবাওয়ার অবশ্য মুলারের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি কসমসে সই করেন। মজার ব্যাপার, নর্থ আমেরিকান সকার লিগে বেকেনবাওয়ারের কসমসের জার্সিতে অভিষেক ম্যাচটি ছিল কসমসের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পেলের শেষ ম্যাচ। পাঁচ বছর যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছিলেন বেকেনবাওয়ার।
১৯৬৬ বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড অধিনায়ক ববি মুরও পেলে, বেকেনবাওয়ারের ওই সময়ই যুক্তরাষ্ট্রে খেলেছেন। তিনিও ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে নাম লিখিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব টেক্সাস সান আন্তোনিও থান্ডারে। সেখানে ২৪ ম্যাচ খেলেছিলেন ববি মুর। আরেক বিখ্যাত ব্রিটিশ তারকা জর্জ বেস্ট ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে খেলতে যান, তিনি খেলেছিলেন সান জোসে আর্থকোয়েকসের পক্ষে।
১৯৯৩ সালে মেজর লিগ সকার চালুর পর যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের প্রতি তারকা ফুটবলারদের আগ্রহ আরও বেড়েছে। কারণ, এতে অর্থ বেড়েছে আরও। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ এখনো পর্যন্ত তারকা ফুটবলারদের অবসর প্রস্তুতি হিসেবেই থেকে গেছে।
মেসি ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেওয়ার আগে সাম্প্রতিক অতীতে যুক্তরাষ্ট্রে খেলা সবচেয়ে বড় তারকা ডেভিড বেকহামই। তিনি খেলেছিলেন লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যালাক্সির হয়ে। এরপর ইব্রাহিমোভিচও খেলেছেন এই লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যালাক্সির হয়ে।
বিশ্বকাপজয়ী ফরাসি তারকা থিয়েরি অঁরি খেলেছেন নিউইয়র্ক রেড বুলসের হয়ে। আরেক বিশ্বকাপজয়ী স্পেনের ডেভিড ভিয়া মাতিয়েছেন নিউইয়র্ক এফসি। কাকা খেলেছেন অরলান্ডো সিটির হয়ে, ওয়েইন রুনি ডিসি ইউনাইটেডের হয়ে, শোয়েইনস্টাইগার শিকাগো ফায়ার্সের হয়ে।
চেলসির দুই সাবেক তারকা ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড ও দিদিয়ের দ্রগবা খেলেছেন যথাক্রমে নিউইয়র্ক এফসি ও ফিনিক্স রাইজিংয়ের জার্সিতে। ২০২২-২৩ মৌসুমে সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ তারকা গ্যারেথ বেল নাম লিখিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেস সিটিতে।