এপিকটেটাস, সিসেরো ও সেনেকা—ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে এসব দার্শনিকের প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন মেক্সিকান ক্রীড়াসাহিত্যিক হুয়ান ভিলোরো। কিন্তু কেন? তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের সময়ে নানাভাবে নাজেহাল হয়েছিলেন। আর রোনালদো এখনো হয়ে চলেছেন। স্নায়ুযুদ্ধের এই যুগে হয়তো আঘাতের ধরন বদলেছে, কিন্তু লক্ষ্য ও শিকার এখনো একই থেকে গেছে।
দুই দিন আগের ঘটনাই ধরা যাক। আরব ক্লাব চ্যাম্পিয়নস কাপের সেমিফাইনালে রোনালদোর সঙ্গে ছবি তুলে আহমেদ জিরো নামের এক ইরাকি ফুটবলার পোস্ট দিয়েছিলেন, ‘ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা ফুটবলারের সঙ্গে।’ নাহ্, দ্বিতীয় সেরা বলে এই ইরাকি ফুটবলার রোনালদোকে সম্মানিত করেননি। এর মধ্যে বরং লুকিয়ে আছে সূক্ষ্ম অপমান ও কটাক্ষ। এমন ঘটনা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে প্রশংসা যেমন পায়ে লুটোপুটি খেয়েছে, তেমনি সমালোচনার তিরও বারবার বিদ্ধ করেছে তাঁকে।
রোনালদোর জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বরের পর। লিওনেল মেসি বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের পর সবাই যেন তাঁকে সপ্তম স্বর্গে তুলে দিয়েছিলেন! অন্যদিকে পর্তুগাল কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে যাওয়ার পর রোনালদোর ক্যারিয়ারের এপিটাফ লিখে ফেলেন অনেকেই। পিটার ড্রুরির সেই কথা—‘লিওনেলে মেসি শেইকেন হ্যান্ডস উইথ প্যারাডাইস’—যেন রোনালদোকে উল্টো রথে ঠেলে দেয় দান্তের ইনফার্নো বা নরকের দিকে, যেখানে অন্তহীন এক পীড়নই মানুষের সঙ্গী। এই ইনফার্নোয় রোনালদো প্রথম প্রবেশ করেন মূলত মেসির চূড়ায় ওঠার দিন কয়েক আগে; মরক্কোর কাছে হারের পর যেদিন মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে টানেল ধরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
রোনালদোর পরের গল্পটা আরও করুণ। মেসি যখন বিশ্বকাপ শিরোপা বুকে জড়িয়ে রোজারিওতে বড় দিনের উৎসবে মেতেছিলেন, রোনালদো প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ইউরোপ ছেড়ে সৌদি আরব যাওয়ার। যে অঞ্চলের ফুটবল সম্পর্কে সাধারণ দর্শকদের খুব কমই ধারণা বা আগ্রহ, রোনালদোর সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁর ভক্তদের যেন মানসিকভাবে আরও ধসিয়ে দেয়। আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েন তাঁরা।
এটুকুতে সব শেষ হলেও হতো। কিন্তু পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, প্রথম মৌসুমে আল নাসরের হয়ে রোনালদোর হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর। রোনালদো যাওয়ার আগে আল নাসর সৌদি প্রো লিগের শীর্ষ দলই ছিল। আশা ছিল আরও দুটি ঘরোয়া শিরোপা জয়ের। কিন্তু মৌসুম শেষ করেছে তারা শিরোপাহীন থেকে। তখন বিরোধীরা ‘এই রোনালদো অচল’ বলে শ্বেতদন্ত প্রদর্শন করেছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়েন ‘সি আর সেভেন’। একদিকে বিশ্বজয়ী মেসি যখন প্রতিনিয়ত প্রশংসার তোড়ে ভেসে যাচ্ছিলেন, রোনালদো সেখানে প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছিলেন ট্রলের। ৩৮ বছর বয়সী রোনালদোর শেষ হয়তো তাঁর ভক্তরাও দেখে ফেলেছিলেন।
কিন্তু তিনি যে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, সিআর সেভেন, যিনি নিজের গল্প নিজে লিখতে জানেন। প্রায় দুই দশক ধরে নিজের গল্পটা নিজেই লিখে আসা রোনালদোর শেষটা অন্যরা কীভাবে লিখবেন! কলমটা তাই নিজের হাতেই নিলেন রোনালদো। এপিটাফ লিখে ফেলার পর সেই কলমেই রচনা করলেন মেসির মতোই জীবন্ত হয়ে ওঠার গল্প।
রোনালদোর জন্য লড়াইটা কিছুটা সহজ করে দেন মেসি নিজেই। ইউরোপ ছেড়ে গ্রীষ্মের দলবদলে মেসি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। এবার দুজনের চ্যালেঞ্জটা দুটি ‘অপরিচিত’ লিগকে চেনানোর, তাদের ব্র্যান্ডিং করার। যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হলো মেসি-ম্যানিয়া। সঙ্গে অভিষেক ম্যাচ থেকেই একের পর এক গোল। মেসির পারফরম্যান্স এই লড়াইয়েও যেন রোনালদোর হার দেখাচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে কখনো ‘বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা তারকা’ মনে না করা রোনালদো যেন তা মানতে চাইলেন না।
রোনালদো অবশ্য শুরুটা করেছিলেন কথার লড়াই দিয়ে। বলেছিলেন, ‘এমএলএসের চেয়ে সৌদি লিগ এগিয়ে আছে।’ তাঁর এ কথা দিয়েই শুরু হলো আরেকটি যুদ্ধ, যা একই সঙ্গে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলল রোনালদোকেও। একই সময়ে আলাদা প্রতিযোগিতায় দুজনই টানা ৫ ম্যাচে গোল করেছেন। গতকাল রাতে প্রায় একক কৃতিত্বে রোনালদো শিরোপাও জিতে নিয়েছেন। ২০২১ সালের পর তাঁর প্রথম শিরোপা। এত লম্বা শিরোপা-খরার কথা হয়তো রোনালদো নিজেও ভাবতে পারেননি আগে। এটি আরব ক্লাব চ্যাম্পিয়নস কাপের ৪২ বছরের ইতিহাসে আল নাসরের প্রথম শিরোপাও বটে। অন্যদিকে মেসিও ৫ ম্যাচে ৮ গোল করে ইন্টার মায়ামিকে তুলেছেন লিগস কাপের সেমিফাইনালে। শিরোপা জয়ের ভিন্ন এ লড়াইয়ে রোনালদোকে মেসি জবাব দিতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।
মেসির সঙ্গে লড়াইটা এক পাশে সরিয়ে রাখলেও রোনালদো যা করে যাচ্ছেন, তা অবিশ্বাস্য। ৩৮ বছর বয়সে অন্যরা যখন নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হন, সেখানে রোনালদো সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার না পাওয়ায় আয়োজকদের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। রোনালদো এমনই! সাফল্যের জন্য যিনি নিজের ক্ষুধাটাকে কখনো আড়াল করেননি।
এরপরও বিশ্বকাপ জেতার কারণে মেসিকে হয়তো এখনো অনেকেই এগিয়ে রাখবেন, যা খুব স্বাভাবিকও। কিন্তু লড়াইটা আসলে জয়-পরাজয়ের নয়। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অমরত্ব পেয়েছে একটি সময় ও প্রজন্ম। এ লড়াই আমাদের শোনায় রূপকথার গল্প। যেন তা আরব্য রজনীর পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে। যেখানে শুধুই রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা। ভক্ত-সমর্থকদের ব্যক্তিগত পছন্দ ও ভোটে আলাদাভাবে তাঁদের যে কেউ জিততে পারেন। কিন্তু সময় তাঁদের দুজনকেই অমরত্ব দেবে। এখানে দিন শেষে কেউই হারে না। এখানে শুধুই আনন্দ আর রোমাঞ্চ রাখা সবার জন্য।
তাই ফুটবলের দর্শক হিসেবে আপনার কোনো হার নেই। ৩৮ বছর বয়সী মানুষটি যখন কয়েক ফুট ওপরে উঠে বাইসাইকেল কিক নেন, তখন তা শুধুই একটি ছবি নয়; এটি যেন ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে হয়ে চিত্রকর্ম, যা আপনার অবচেতনে ফিরে ফিরে আসবে। এমনকি আপনি যদি মেসিভক্ত হন, তবুও। এখানে তাই একজনকে হারিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটা অপ্রয়োজনীয়।
এই দুজনের লড়াই নিয়ে ভিলোরো লিখেছেন, ‘প্যারাডক্সিক্যালি ক্রিস্টিয়ানোর কারণে যে ফুটবলারটি সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন, তিনি হলেন তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসি।’ কথাটা অবশ্য মেসি-রোনালদো দুজনই স্বীকার করেছেন। তাঁরা দুজন মূলত শেষ পর্যন্ত একে অপরের আয়না। কারও প্রতিবিম্ব হয়তো একটু বেশি তীব্র আর কারওটা একটু কম। কিন্তু দিন শেষে তাঁরা ফুটবলের বিনোদনদায়ী প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছুই নন!