সময়টা ২০১০-২০১১ সাল। ফুটবল–দুনিয়ায় তখন লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর একচ্ছত্র দাপট। খুব শিগগির এ দাপটের অবসান ঘটবে তেমন কোনো ইঙ্গিতও নেই। ফুটবলের সমস্ত লড়াইকে দুজন চুম্বকের মতো টেনে আনছেন নিজেদের দিকে। তাঁদের সাফল্য-ব্যর্থতা তখন ফুটবলের সমার্থক। প্রশ্ন উঠেছিল, মেসি-রোনালদোর এই দাপট শেষ করার মতো কি কেউ নেই? বেশ কিছু সম্ভাব্য নাম সামনে এলেও কোনোটাই হালে পানি পেল না। সব নাম মুহূর্তের মধ্যে বাতাসে মিলিয়ে গেল।
এর মধ্যেই বাতাসে কানাঘুষা, সান্তোসের আঁতুড়ঘরে তৈরি হচ্ছে এক প্রতিভা। হ্যাঁ, সেই সান্তোস যেখানে খেলে গোটা দুনিয়ার ফুটবলের ‘রাজা’ হয়ে উঠেছিলেন পেলে। কিন্তু পেলের সেই যুগ তো শেষ। প্রতিভার পূর্ণ বিচ্ছুরণ দেখাতে হলে আসতে হবে ইউরোপে। সেখানেই ওড়াতে হবে শ্রেষ্ঠত্বের পতাকা। তাঁকে ঘিরেও তখন ইউরোপিয়ান জায়ান্টদের আগ্রহের গুঞ্জন। ওহ, সেই প্রতিভাবান খেলোয়াড়টির নামই তো এখনো বলা হলো না। সেই নামটি ছিল, নেইমার। যাঁকে দিয়েই মেসি-রোনালদোর ক্লিশে হয়ে পড়া বাইনারি ভাঙার স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকে।
১৯৯২ সালে ব্রাজিলের এক দরিদ্র পরিবারে নেইমারের জন্ম। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দারিদ্র্যের আঘাতটা অবশ্য নেইমার টের পেয়েছিলেন জন্মের আগেই। তাঁর মা যখন তাঁকে গর্ভে ধারণ করেন, তখন গর্ভাবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মতো অর্থসংস্থানও নেইমারের বাবার ছিল না। কী অদ্ভুত ব্যাপার, পৃথিবীতে আসার আগে যে মানুষটিকে অর্থনৈতিক সংকট দেখতে হয়েছিল, তিনিই পরে বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার হয়েছিলেন। অবশ্য সেই অর্থই শেষ পর্যন্ত নেইমারের কাল হলো কি না, সে প্রশ্নও চাইলে কেউ এখন তুলতে পারেন! যা–ই হোক, দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা নেইমার একসময় আশ্রয় হিসেবে বেছে নিলেন ফুটবলকে। সেই ফুটবলই ভাগ্য বদলানোর হাতিয়ার হয়ে নেইমারকে নিয়ে এল সান্তোসে। পায়ের জাদুতে ধীরে ধীরে নিজের ভাগ্যটা নিজেই লিখতে শুরু করলেন নেইমার।
লাতিন আমেরিকার বাইরে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল লিগের খেলা দেখার মতো দর্শক খুব বেশি ছিল না। কিন্তু ব্রাজিল জাতীয় দল ও ইউটিউবের কল্যাণে সেই প্রতিভার ঝলকের সঙ্গে তত দিনে পরিচিতি হয়ে গেছে ফুটবলপ্রেমীদের। ড্রিবলিংয়ে কখনো কখনো যিনি মেসিকেও ছাড়িয়ে যান, বলের নিয়ন্ত্রণ এবং স্কোরিং দক্ষতায় রোনালদোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তাঁর শরীরে ব্রাজিলিয়ান রক্ত। কেউ চাইলে ফুটবলের রক্তও বলতে পারেন। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ব্যাটনটাও তখন সবাই বিনা দ্বিধায় কৈশোর পেরোনো নেইমারের হাতে তুলে দিল। পেলে, রোমারিও এবং রোনালদোর পর নেইমারকে দিয়েই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন বুনতে শুরু করলেন ব্রাজিল ভক্তরা।
এর মধ্যে নেইমারকে ঘিরে ইউরোপিয়ান জায়ান্টগুলোর আগ্রহও উঠল বেশ তুঙ্গে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডসহ বেশ কিছু ক্লাবের আগ্রহ থাকলেও রেকর্ড দামে নেইমার এলেন বার্সেলোনায়। মেসি-জাভি-ইনিয়েস্তাদের নিয়ে বার্সা তখন ফুটবলের সবচেয়ে বড় শক্তি। এত সব বড় নামের ভিড়ে নিজের জায়গা তৈরি করতে খুব বেশি সময় লাগল না নেইমারের। এক মৌসুম পর মেসি, সুয়ারেজ এবং নেইমার মিলে তৈরি করলেন এমএসএন ত্রিফলা।
শুধু মাঠেই নয়, মাঠের বাইরেও এ তিনজনের মধ্যে জমে ওঠে দারুণ বন্ধুত্ব। আক্রমণভাগে এই ত্রিফলার জাদুতেই ২০১৪-১৫ মৌসুমে একই সঙ্গে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতল বার্সা। অনেকেই মনে করেন, সে মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতায় সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল নেইমারের। কিন্তু তখন বার্সা মানেই যেন মেসি। তাই হয়তো প্রাপ্য কৃতিত্ব না পেয়ে কিছুটা অভিমানও তৈরি হলো তাঁর। সঙ্গে হয়তো মেসির ছায়ায় ঢাকাও পড়ে যাওয়ার আতঙ্কও পেয়ে বসেছিল। সিদ্ধান্ত নিলেন বার্সা ছাড়ার।
২২ কোটি ইউরোতে বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় হিসেবে বার্সা ছেড়ে পিএসজিতে গেলেন নেইমার। অনেকেই তখন নেইমারের বার্সা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন, এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেইমার কি পাদপ্রদীপের আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেললেন কি না! যাঁরা সে সময় এমনটা ভেবেছিলেন, তাঁরা হয়তো এখন নিজেদের কথার সত্যতা দাবি করতে পারেন।
নেইমার আসার আগে পিএসজি কখনোই সে অর্থে পরাশক্তি ছিল না। একসময় রোনালদিনিও-জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের মতো তারকারা খেলেছেন বটে, কিন্তু তাঁরাও পারেননি পিএসজিকে চূড়ায় নিয়ে যেতে। নেইমার হয়তো সেই চ্যালেঞ্জটাই নিতে চেয়েছিলেন। নিজের কাঁধে ক্লাবের ভার নিয়ে নিজেকেও তুলবেন চূড়ায়। কিন্তু হায়! নেইমার কি আর জানতেন তিনি সিসিফাসের মতো ‘অভিশপ্ত’ একজন। সেই সিসিফাস যিনি একটি পাথরকে গড়িয়ে তুলতেন পাহাড়ের চূড়ায়, কিন্তু পাথরটি আবার সেখান থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যেত। নেইমারও পারলেন না পিএসজিকে সেই কাঙ্ক্ষিত চূড়ায় নিয়ে যেতে। উল্টো একের পর এক চোট, নারীকেন্দ্রিক বিতর্ক এবং ড্রিবলার বদলের ডাইভার ট্যাগ নিয়ে ধীরে ধীরে আড়ালে পড়ে যেতে শুরু করলেন।
যে নেইমারকে দিয়ে একসময় মেসি-রোনালদোর বাইনারি ভাঙার স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তিনি পিএসজিতেও আর শীর্ষ তারকা থাকতে পারলেন না। তাঁর জায়গা নিয়ে নিলেন এমবাপ্পে। পরে মেসি এসে আরও কোণঠাসা করে দিলেন তাঁকে। গত মৌসুম শেষে মেসির বিদায় এবং এমবাপ্পের সম্ভাব্য বিদায়কে সামনে রেখে নেইমারের কাঁধেই পিএসজির ভার দেখছিলেন অনেকে। কিন্তু সিসিফাসের ‘অভিশাপ’কে কাঁধ থেকে নামানোর সিদ্ধান্ত নিলেন নেইমার। পিএসজিকে জানিয়ে দিলেন তিনি থাকছেন না।
এরপর তাঁর বার্সায় ফেরার গুঞ্জনও শোনা যায়। ভক্তদের আশা ছিল, যে বার্সা দিয়ে ইউরোপে সুবাস ছড়ানো শুরু করেছিলেন, সেখানেই হয়তো নেইমার তাঁর অপূর্ণতা ঘোচাবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। উল্টো শোনা গেল, ৩১ বছর বয়সেই নেইমার পাড়ি জমাবেন সৌদি আরবে। সৌদি ক্লাব আল হিলালের সঙ্গে চুক্তিও পাকা। অর্থাৎ নতুন শুরু নয়, নেইমার বরং শেষের পথেই নিজেকে টেনে নিয়ে গেলেন।
কেউ চাইলে বলতে পারেন মেসি-রোনালদো ইউরোপ ছেড়েছেন, নেইমার সৌদি আরবে গেলে কী সমস্যা? রোনালদো যখন ইউরোপ ছেড়েছেন তখন তাঁর বয়স ৩৮ আর মেসি ইন্টার মায়ামিকে বেছে নিয়েছেন ৩৬ বছর বয়সে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, তাঁদের ক্যারিয়ার পূর্ণতা পেয়েছে আরও আগেই। মেসি ব্যালন ডি’অর জিতেছেন সাতবার। লিগ শিরোপা থেকে শুরু করে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন একাধিকবার। আর সর্বোপরি ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনাকে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। পাঁচ ব্যালন ডি’অর জেতা রোনালদো চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন পাঁচবার। তিনটি আলাদা আলাদা দেশে লিগ জিতেছেন। জাতীয় দলের হয়ে জিতেছেন ইউরোও।
সে তুলনায় একসময় এ দুজনের পর যাঁকে সেরা বিবেচনা করা হতো, সেই নেইমারের ভাঁড়ারটা বড্ড সাদামাটা। ব্যক্তিগত অর্জনের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা ব্যালন ডি’অর জেতা হয়নি কখনো। বার্সায় দুটি লিগ ও একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে যে আভাসটা দিয়েছিলেন, সেটাকে কখনো পূর্ণতা দিতে পারেননি। জাতীয় দলে পেলের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ (৭৭) গোলদাতা হয়েছেন বটে কিন্তু তাঁর বিপরীতে নেই বড় কোনো অর্জন। এমনকি কোনো কোপা আমেরিকার ট্রফিও নেই নেইমারের নামের পাশে।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার, যে প্রতিভা ও মেধা নিয়ে ফুটবল–মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁর কিছুই মাঠে অনুবাদ করতে পারেননি। প্রতিভার নিদারুণ অপচয় মেনে নিয়ে নেইমার আজ ছিটকে পড়লেন ইউরোপের কক্ষপথ থেকেও। এত দিন পর্যন্ত একটা ক্ষীণ আশা ভক্তদের মধ্যে ছিল, শেষ ধাপে এসে হয়তো নেইমার জ্বলে উঠবেন। বুঝে নেবেন নিজের প্রাপ্যটুকু। তাঁদের আশার সেই প্রদীপটুকুও আজ হয়তো নিভে গেল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এখন বসে বসে লিখছেন নেইমারের এপিটাফ।
কিছুই তো হলো না। পারলেন না মেসি-রোনালদোর ছেড়ে যাওয়া মসনদের দখল নিতে। পেলে-রোমারিও-রোনালদোদের উত্তরসূরি হওয়ার সম্ভাবনাটুকুও রয়ে গেল আকাশকুসুম কল্পনা হয়ে। ভক্তদের কৌতূহলী মনের একটাই প্রশ্ন—মাত্র ৩১ বছর বয়সে কেন নেইমারকে ইউরোপ ছাড়তে হচ্ছে? অর্থের কাছেই কি শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন? নাকি নেইমার ছিলেন ‘অতি মূল্যায়িত’ কেউ। যিনি আসলে সেই পর্যায়ের ছিলেনই না যেখানে তাঁকে ভক্তরা দেখতে চেয়েছিলেন? এসব প্রশ্নের সহজ-সরল কোনো উত্তর নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ফুটবলের মহাকাশে নেইমার শেষ পর্যন্ত সেই তারা হিসেবে থেকে যাবেন, যিনি কখনো নিজের শক্তিতে প্রজ্বলিত হতে পারেননি।