মা এনতা মান্দার সঙ্গে মারিয়া মান্দা। সাফ জয়ের পর ঢাকায় এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে
মা এনতা মান্দার সঙ্গে মারিয়া মান্দা। সাফ জয়ের পর ঢাকায় এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে

মারিয়ার মা এনতা মান্দার গল্প এবং...

মারিয়ার মা এনতা মান্দার মুখ আমরা ভুলিনি। ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র অদম্য মেয়েরাতে আমরা তাঁকে দেখি।তিনি নিজ বাড়ির দাওয়ায় মারিয়াকে ভাত তুলে খাওয়াচ্ছেন।

ভাতের থালা মুছে খাওয়াচ্ছেন। মায়েরা ভাত মুছে খাওয়ান, সেই মোছা ভাত খেয়েই তো সন্তানেরা বড় হয়। পরিচালক রেদওয়ান রনি ভাত খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরের শূন্য থালাটার ক্লোজ শট ধরেন। ধারাবিবরণী শুনি, আছে প্রতিকূলতা, আছে দারিদ্র্য।

সাত বছর আগে ওই ভিডিও যখন বানানো হয়েছিল, তখন এএফসি কাপের অনূর্ধ্ব–১৪ দলের ১০ জন খেলোয়াড় ছিল কলসিন্দুর নামের এক গ্রামের। ময়মনসিংহ থেকে ৫০ কিলোমিটারের বেশি দূরে ধোবাউড়া উপজেলায় গারো পাহাড়ের পাদদেশে সেই দুর্গম গ্রাম। এনতা মান্দা সেই প্রামাণ্যচিত্রে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন। নেপালে খেলতে গিয়েছে মেয়েরা। নেপালে তখনই ঘটল ভূমিকম্প। মায়েরা মেয়েদের দুশ্চিন্তায় কাতর।

বিমানে সতীর্থের সঙ্গে মিষ্টিমুখ করছেন মারিয়া মান্দা

তারপর মেয়েরা ফিরে আসছে গ্রামে। উদ্বেগাকুল মায়ের মুখ হিসেবে আমরা দেখেছিলাম মারিয়ার মায়ের মুখ। তিনি এত সুন্দর ‘অভিনয়’ করেছিলেন কী করে? কিশোর আলো ২০১৫ সালের এপ্রিল সংখ্যায় বদিউজ্জামানের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিই, ‘ছোটবেলা থেকেই মারিয়া মাঠে লড়াই করছেন প্রতিপক্ষের সঙ্গে। মাঠের বাইরেও লড়ছেন জীবনের সঙ্গে।

যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন, তখন মারিয়ার বাবা মারা যান। বাবার চেহারা কেমন ছিল, একটুও মনে নেই। বাবার একটা ছবিও নেই যে দেখবেন মারিয়া। কখনো বাবাকে দেখতে ইচ্ছা করলে মায়ের মুখটা সবার আগে মনে পড়ে মারিয়ার। বাবা বীরেন্দ্র মারাত যখন মারা যান, তখন ছোট ভাই দানিয়েল মান্দা ছিল মায়ের গর্ভে। সেই থেকে মারিয়াদের চার ভাইবোনকে নিয়ে মা এনতা মান্দার লড়াইটা শুরু। এখনো সেই একইভাবে লড়ে যাচ্ছেন মারিয়ার মা। মারিয়ার মা এনতা মান্দা ধানের মৌসুমে ধান লাগান, মৌসুম শেষে ধান কাটার কাজ করেন। এ জন্য দিনে ২০০ টাকা পারিশ্রমিক পান। এর বাইরে অন্যের বাড়িতে গিয়েও গৃহকর্মীর কাজ করেন।’

মারিয়া, সানজিদা, তহুরা…সাফ ফুটবলজয়ী মেয়েদের আটজন কলসিন্দুর গ্রামের। কলসিন্দুরের ফুটবলার মেয়েদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ঢাকায়, সোনারগাঁও হোটেলে। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আমন্ত্রিত ছিল তারা। তারা আমাকে ঘিরে ধরে বলল, ‘আপনারা যে আমাদের নিয়ে ভিডিও বানাইছেন, আমরা দেখব কেমন করে। আমাদের গ্রামে তো বিদ্যুৎ নাই।’ আমি বললাম, ‘যাও, ছয় মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ যাবে তোমাদের গ্রামে।’ ওরা বলল, ‘না না, এক মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ চাই।’

মায়ের সঙ্গে মারিয়া মান্দা

সেই কাহিনি লিখলাম। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম শাহরিয়ার আলম। দেড় মাসের মধ্যে এই গ্রামের ৮০০ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেল। সেই বিদ্যুৎ–সংযোগের অনুষ্ঠানে নসরুল হামিদের সঙ্গে আমিও গিয়ে হাজির হলাম। প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনসহ গণ্যমান্য মানুষেরা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সানজিদা-মারিয়ারা তখন ঢাকায়, প্রশিক্ষণ শিবিরে।

মারিয়ার মা এনতা মান্দার সঙ্গে তখনই দেখা। তিনি এসেছেন কলসিন্দুর স্কুলের মাঠে। আমি একজন বাংলার চিরায়ত মাকেই দেখেছিলাম সেদিন। তাঁর দুই চোখে মায়া এবং বজ্র ছিল। মুখে সংগ্রামের চিহ্ন ছিল, আশার ঝলকও ছিল। ঢাকায় ফিরে এরপর দেখতে গেলাম এএফসি কাপের একটা খেলা, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে।

সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে মেয়েরা জয়লাভ করল। প্রথম আলো বৃত্তি দিল কলসিন্দুরের ১৯ জন আর জাতীয় দলের ৬ জন খেলোয়াড়কে। টাঙ্গাইলের কৃষ্ণা রানীও ছিল বৃত্তিপ্রাপ্তদের একজন। মানে প্রথম আলোর বৃত্তির আওতায় আসে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের সব খেলোয়াড়+ কলসিন্দুরের খেলোয়াড় মেয়েরা।

সাফজয়ী ফুটবলার মারিয়া মান্দা

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে এসে কলসিন্দুরের গৌরবচিত্র দেখলেন নিজের চোখে। একটার পর একটা সুখবর আসতে লাগল কলসিন্দুর গ্রাম থেকে। স্কুল ভবন পাকা হচ্ছে। ওই স্কুলের ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্ন নিচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রী।

ওই গ্রামের, স্কুলের বা কলেজের কোনো সুখবর সবার আগে আসে আমার কাছে। মেয়েরা ঈদে–পূজায় খোঁজ নেয়। সানজিদারা ভীষণ চৌকস। ‘স্যার, কেমন আছেন। আন্টি কেমন আছে। আপু কেমন আছে’— ঈদের আগের রাতে এই ফোনগুলো খেলোয়াড় মেয়েদের কাছ থেকে পাই।

অনেক দিন পর সেই এনতা মান্দাকে ছবিতে দেখলাম ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। মারিয়ারা সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরেছেন। এনতা মান্দা ঢাকায় এসেছেন। অনেকগুলো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের একটাতে বিশাল সৌকর্যময় দুটো সোফায় মারিয়া আর তাঁর মা বসে আছেন। এনতা মান্দার চোখেমুখে এবার গৌরবের আলোকচ্ছটা।

মারিয়ারা সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরেছেন। এনতা মান্দা ঢাকায় এসেছেন। অনেকগুলো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের একটাতে বিশাল সৌকর্যময় দুটো সোফায় মারিয়া আর তাঁর মা বসে আছেন। এনতা মান্দার চোখেমুখে এবার গৌরবের আলোকচ্ছটা।

এ তো আমার মায়েরই মুখ। আমাদের আম্মা সারাটা জীবন সংসার-সংগ্রাম করেছেন। একটাই ব্রত ছিল, ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে হবে। আমরা বড় হওয়ার পর তাঁর ক্লান্ত অবয়বে ছিল একটা তৃপ্তির ছোঁয়া। এনতা মান্দার মুখেও আমি জয়ের জ্যোতি দেখতে পাই।

আবার যাচ্ছি কলসিন্দুরে। এনতা মান্দার সঙ্গে দেখা করতে চাই। যুদ্ধজয়ী সন্তানের মায়ের পাশে দাঁড়ালে আগুনের পরশমণির স্পর্শ পাব। সেই কাহিনি বলতে পারব ফিরে আসার পর। ওদের যখন জিজ্ঞেস করি, ‘এই, তোমাদের জন্য কী আনব?’ ওরা বলে, ‘কিছু লাগবে না, স্যার। আমাদের বাড়িতে আসবেন, বেশিক্ষণ থাকবেন।’ আমাদের কন্যারা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। কন্যাসন্তানের পিতা হওয়ার অনুভূতি আমি বুঝি, আপনাদের যাঁদের মেয়ে আছে, তাঁরাও নিশ্চয়ই বোঝেন।

আর এনতা মান্দার অনুভূতি বুঝতে চাইলে আমাদের নিজেদের মায়ের মুখের দিকে তাকানোই যথেষ্ট।