মহাদেশীয় আন্তর্জাতিক ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই প্রতিযোগিতা ইউরো ও কোপা আমেরিকার আগে-পরে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন বেশ কয়েকজন কিংবদন্তি ও তারকা ফুটবলার। কেউ দেশের হয়ে আর না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আবার কেউ খেলোয়াড়ি জীবনকেই বিদায় বলে দিয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে আছেন আর্জেন্টিনার আনহেল দি মারিয়া, জার্মানির টনি ক্রুস ও টমাস মুলার এবং ফ্রান্সের অলিভিয়ের জিরুর মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। ইতালির লিওনার্দো বোনুচ্চি, উরুগুয়ের এদিনসন কাভানি, সুইজারল্যান্ডের জেরদান শাকিরি, কোস্টারিকার কেইলর নাভাস, স্পেনের থিয়াগো আলকান্তারার মতো তারকারাও আছেন অবসরের তালিকায়।
অলিম্পিক, কোপা আমেরিকা, ফিনালিসিমা, বিশ্বকাপ—আন্তর্জাতিক ফুটবলে বড় এই চারটি টুর্নামেন্টের প্রতিটির ফাইনালে গোল করা একমাত্র ফুটবলার আনহেল দি মারিয়া। আর্জেন্টিনার হয়ে জিতেছেন একটি বিশ্বকাপ, দুটি কোপা ও একটি ফিনালিসিমা। আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি তাঁকে ২০২৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু আগের ঘোষণা অনুযায়ী, কোপা শেষেই আর্জেন্টিনার জার্সি তুলে রেখেছেন। তবে চালিয়ে যাবে ক্লাব ফুটবল। বেনফিকার সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় কিংবদন্তি এই ফরোয়ার্ড আপাতত মুক্ত খেলোয়াড় (ফ্রি এজেন্ট)।
সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডারের সংক্ষিপ্ত তালিকা করলেও টুনি ক্রুসের নাম ওপরের দিকেই রাখতে হবে। ক্রুসকে শুধু জার্মানির জার্সিতেই নয়; পেশাদার ফুটবলেই আর কখনো দেখা যাবে না। ৩৪ বছর বয়সেই সব ধরনের ফুটবলকে বিদায় বলে দিয়েছেন। অবসরের ঘোষণাটা তিনি গত মৌসুমের শেষ দিকেই দিয়ে রেখেছিলেন। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ক্লাব ফুটবলকে বিদায় বলেছেন। জার্মানির ২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী দলের এই সদস্য ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ফুটবলের সম্ভাব্য বাকি সব শিরোপাই জিতেছেন, শুধু ইউরো ছাড়া। এবার জার্মানির ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়ায় সেই হতাশা নিয়েই অবসরে যেতে হয়েছে।
ইউরোর শেষ আট থেকে জার্মানির বিদায় টমাস মুলারকে হয়তো একটু বেশিই যন্ত্রণা দিয়েছে। স্পেনের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পর থেকে মুলারেরও বিদায়ের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত গুঞ্জনটাই সত্যি হয়েছে। গত পরশু এক ভিডিও বার্তায় জার্মানির জার্সি তুলে রাখার ঘোষণা দিয়েছেন ৩৪ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি। ১৪ বছরের দীর্ঘ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে জার্মানির হয়ে খেলেছেন তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩১ ম্যাচ। ৪৫ গোল নিয়ে দেশটির সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় হয়ে আছে যৌথভাবে পঞ্চম। ২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী দলের অপরিহার্য এই সদস্য বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ক্লাব ফুটবল চালিয়ে যাবেন। বায়ার্নের সঙ্গে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত চুক্তি আছে তাঁর।
ফ্রান্সের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৫৭টি)। ফরাসিদের হয়ে জিতেছেন বিশ্বকাপ ও নেশনস লিগ। তবু অলিভিয়ের জিরু যেন সব সময়ই তারকায় ঠাসা দলটার আড়ালে পড়ে থাকতেন। বয়স ৩৮ ছুঁই ছুঁই। নিজের সময় যে ফুরিয়ে আসছে, তা বুঝতে পেরেছিলেন। সে কারণেই ইউরোর আগে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এবারই শেষ। জাতীয় দলের হয়ে বিদায়টা অবশ্য স্মরণীয় করে রাখতে পারেননি। ফ্রান্স বিদায় নিয়েছে সেমিফাইনাল থেকে। ৬ ম্যাচ মিলিয়ে তিনি খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ৫৬ মিনিট। পেশাদার ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে চলে আসা জিরু এ মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারের ক্লাব লস অ্যাঞ্জেলেস এফসিতে যোগ দিচ্ছেন।
বিশ্ব ফুটবলে জেরদান শাকিরি হয়তো খুব বড় নাম নয়। কিন্তু সুইজারল্যান্ড ফুটবলের অবিসংবাদিত কিংবদন্তি তিনি। ৩২ বছর বয়সী শাকিরি গত পরশু আচমকা আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় বলে দিয়েছেন। সুইসদের হয়ে ১৪ বছরে ১২৫ ম্যাচ খেলেছেন, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তাঁর চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন শুধু গ্রানিত জাকা (১৩০টি)। শাকিরির আন্তর্জাতিক গোল ৩২টি, সুইজারল্যান্ডের ইতিহাসে যা চতুর্থ সর্বোচ্চ। সর্বশেষ তিনটি বিশ্বকাপ ও তিনটি ইউরোতেই গোল করার ঈর্ষণীয় কীর্তি সঙ্গী করেই তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবল ছেড়েছেন। ক্লাব ফুটবলে বর্তমানে খেলছেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ফায়ারে। এ বছরের শেষ দিনে শিকাগোর সঙ্গে তাঁর চুক্তির মেয়াদ ফুরাবে।
২০১১ সালে সর্বশেষ কোপা আমেরিকা জিতেছিল উরুগুয়ে। চ্যাম্পিয়ন সেই দলের সদস্য ছিলেন এদিনসন কাভানি। তবে এবারের কোপা আমেরিকা শুরুর আগে উরুগুয়েকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন ৩৭ বছর বয়সী এই সেন্টার ফরোয়ার্ড। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩৬ ম্যাচ। ৫৮ গোল নিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকাতেও কাভানির অবস্থান দুইয়ে। তাঁর ওপরে আছেন শুধু লুইস সুয়ারেজ (৬৯ গোল)। মার্সেলো বিয়েলসা উরুগুয়ের কোচ হওয়ার পর থেকে একবারও কাভানিকে দলে ডাকেননি। বিয়েলসার পরিকল্পনায় যে তিনি নেই, সেটা আন্দাজ করতে পেরেই হয়তো কোপা শুরুর আগেই অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। কাভানি বর্তমানে খেলছেন প্রয়াত কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে।
১৩ বছর ইতালির রক্ষণদুর্গ আগলে রেখেছেন। দেশের হয়ে জিতেছেন ২০২০ ইউরো, খেলেছেন চতুর্থ সর্বোচ্চ ১২১ ম্যাচ। ওয়েম্বলিতে ২০২০ ফাইনালের প্রসঙ্গ তুললে তাঁর নাম নিতেই হবে। ফাইনালে নির্ধারিত সময়ের পর টাইব্রেকারেও গোল করেছিলেন। সেই লিওনার্দো বোনুচ্চি স্বাভাবিকভাবেই সদ্য সমাপ্ত ইউরোর ইতালি দলেও নিজেকে দেখছিলেন। কিন্তু কোচ লুসিয়ানো স্পালেত্তি তাঁকে রাখেননি ইতালির প্রাথমিক দলেও। কিংবদন্তি এই ডিফেন্ডার হয়তো সেই অভিমানেই গত মে মাসে সব ধরনের ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছেন।