লাইপজিগের মাঠে চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোর প্রথম লেগে ১-১ গোলে ড্র করার পর পেপ গার্দিওলার মজা করে বলেছিলেন, পরের লেগে ৯ জন স্ট্রাইকার খেলাবেন। কে জানে, কোচের কথা শুনে আর্লিং হলান্ড হয়তো মনে মনে হেসেছিলেন! হয়তো ভেবেছিলেন, আমি থাকতে আবার ৯ জন লাগে নাকি!
সত্যিই হলান্ডের মতো কেউ থাকলে আর কোনো স্ট্রাইকার না থাকলেও চলে। ঘরের মাঠে লাইপজিগকে পেয়ে হলান্ড যেন একাই ৯ স্ট্রাইকারের শক্তিতে জেগে উঠলেন। গোল-উন্মাদনায় ইতিহাদকে উপহার দিয়েছেন স্মরণীয় এক রাত। একে একে করলেন ৫ গোল। মৌসুমের ৫ম হ্যাটট্রিক আদায় করে নেন বিরতিতে যাওয়ার আগেই। ৬৩ মিনিটে ‘বেরসিক’ কোচ পেপ গার্দিওলা বদলি হিসেবে নামিয়ে না ফেললে পরের ৩০ মিনিটে হয়তো আরও কিছু রেকর্ড গুঁড়িয়ে দিতেন।
শুরুতে ম্যাচের পর ম্যাচে গোল করলেও, মাঝে ছন্দ হারিয়ে খুঁজেছিলেন নিজেকে। তখন অনেকে হলান্ডের নামের পাশে ইতিও টেনে দিয়েছিলেন। ‘সাময়িক-চমক’ বলতেও দ্বিতীয়বার ভাবেননি অনেকে। সব প্রশ্নের জবাব দিতে চ্যাম্পিয়নস লিগের আজ রাতের ম্যাচটাকেই যেন বেছে নেন হলান্ড। আর ফুটবলের সবুজ গালিচায় যা করলেন তা ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকবে আরও অনেক দিন। সিটির ৭-০ গোলে জেতা (দুই লেগ মিলিয়ে ৮-১) ম্যাচে অন্য দুই গোল আসে ইকেই গুন্দোয়ন ও কেভিন ডি ব্রুইনের কাছ থেকে।
প্রথম লেগে ১-১ গোলে সিটিকে রুখে দিলেও আজ প্রথমার্ধের শুরুর খেলাটা ছিল একপেশে। ম্যান সিটির একের পর এক আক্রমণ হজম করে যাচ্ছিল লাইপজিগ। এর মধ্যে ১১ মিনিটের মাথায় বল পেয়ে দারুণভাবে লাইপজিগ রক্ষণে ঢুকে পড়েছিলেন হলান্ড। কিন্তু গোলরক্ষককে শেষ পর্যন্ত ফাঁকি দিতে পারেননি এই নরওয়েজীয় স্ট্রাইকার। গোল না পেলেও লাইপজিগের ওপর চেপে বসেছিল সিটি। ১৯ মিনিটে আরও একবার কাছাকাছি গিয়ে গোল পাওয়া হয়নি সিটির।
কিন্তু সিটির আক্রমণের মুখে তাল রাখতে না পেরে ডি-বক্সের ভেতর হ্যান্ডবল করে স্বাগতিকদের পেনাল্টি উপহার দেন হেনরিখস। স্পট কিকে হলান্ডের শট ঠেকাতে সঠিক দিকে লাফ দিয়েও বলের স্পর্শ পাননি লাইপজিগ গোলরক্ষক। প্রথম গোলের মাত্র ৭৭ সেকেন্ড পরেই ব্যবধান দ্বিগুণ করেন এ মৌসুমে একের পর এক গোল করা হলান্ড। প্রথমে ডি-বক্সের বাইরে থেকে কেভিন ডি ব্রুইনার বুলেট শট বারে লেগে ফিরে আসলে ফিরতি বলে হেড দিয়ে বল জালে জড়ান হলান্ড। এটি ছিল এ মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে হলান্ডের ৩৬তম গোল।
পরপর গোল খেয়ে জেগে ওঠার চেষ্টা করে লাইপজিগ। যদিও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি তারা। উল্টো ৩১ মিনিটে গোল খেতে খেতে বেঁচেছে জার্মান ক্লাবটি। লাইপজিগ গোলরক্ষক ঠেকিয়ে না দিলে হ্যাটট্রিক পেয়ে যেতে পারতেন হলান্ড। একটু পর অবশ্য নিজেদের ভুলে গোল খেতে খেতে বাঁচে সিটি। প্রতি-আক্রমণ থেকে হুটহাট বিপদ তৈরির চেষ্টা ছাড়া প্রথমার্ধে সিটিকে বিপদে ফেলার মতো আর কিছুই করতে পারেনি লাইপজিগ।
অন্য দিকে বিরতিতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে নিজের হ্যাটট্রিক ঠিকই পূরণ করে নেন হলান্ড। ডি ব্রুইনের কর্নারে জোরালো হেডে গোল প্রায় করেই ফেলেছিলেন রুবেন দিয়াজ। কিন্তু দিয়াজের হেড গোললাইন থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন এক লাইপজিগ খেলোয়াড়। দৌড়ে এসে বলকে জালের দিকে ঠেলে দেন হলান্ড। হ্যাটট্রিক নিয়েই বিরতিতে যান সাবেক বরুসিয়া ডর্টমুন্ড তারকা।
বিরতির পর নিজেদের চতুর্থ গোলের দেখা পেতে সিটির লাগে ৪ মিনিট। জ্যাক গ্রিলিশের সহায়তায় গোল করেন ইকেই গুন্দোয়ান। এরপর ৫৩ মিনিটে যা হয়েছে তা ঐতিহাসিকই বটে। জটলার ভেতর প্রথমবার বঞ্চিত হলেও, ফিরতি শটে বল জালে জড়িয়ে দলের ৫ম ও নিজের চতুর্থ গোলটি আদায় করে নেন হলান্ড। এটি ছিল মৌসুমে হলান্ডের ৩৮তম গোল। এর আগে প্রায় এক শ বছর আগে ১৯২৮-২৯ মৌসুমে সিটির হয়ে মৌসুমে ৩৮ গোল করেছিলেন টমি জনসন।
রেকর্ডটাকে এককভাবে নিজের করে নিতে হলান্ড সময় নেন মাত্র ৪ মিনিট। ইতিহাদকে উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিজের ৫ম গোলটিও আদায় করে নেন এই স্ট্রাইকার। এর মধ্য দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে এক ম্যাচে ৫ গোল করা তৃতীয় খেলোয়াড় হলেন হলান্ড। এর আগে ২০১২ সাালে বেয়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে বার্সেলোনার হয়ে লিওনেল মেসি এবং ২০১৪ সালে বরিসভের বিপক্ষে শাখতার দোনেৎস্কের হয়ে এই কীর্তি গড়েছিলেন লুইজ আদ্রিয়ানো।
৬৩ মিনিটে হুলিয়ান আলভারেজকে নামিয়ে হলান্ডকে তুলে নেন গার্দিওলা। তাঁকে বদলি না করলে ৯০ মিনিট শেষে কোথায় গিয়ে থামতেন কে জানে! অবশ্য এ সময়ের মধ্যে যা করেছেন তা আরও অনেকদিন লাইপজিগ খেলোয়াড়দের ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসবে। শেষ মুহূর্তে প্রাপ্য গোলটি পেয়ে যান ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা ডি ব্রুইনাও।
শেষ আটে ইন্টারও
এফসি পোর্তোর সঙ্গে গোল শূন্য ড্র করেও শেষ আটের টিকিট নিশ্চিত করেছে ইন্টার মিলান। প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ১-০ গোলে জিতেছিল ইন্টার। পরের লেগে ঘরের মাঠে চেষ্টা করেও পারেনি পোর্তো। কাছাকাছি গিয়েও ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। শেষ পর্যন্ত কেউ গোল না পেলে দুই লেগ মিলিয়ে ১-০ গোলে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে গেছে ইন্টার।