দলবদলে যে ধরনের খেলোয়াড়ের দাম বাড়ছে

ফুটবল ও ফ্যাশনের সম্পর্কটা বেশ অদ্ভুত। একেবারে ভিন্ন জগতের তারকা হয়েও অনেক ফুটবলার রীতিমতো ফ্যাশন আইকন। আবার ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও নিজেদের ব্যাপ্তি বাড়াতে কাজে লাগায় খেলোয়াড়দের জনপ্রিয়তাকে। অবশ্য মাঠের বাইরেই শুধু নয়, মাঠেও ফুটবল ও ফ্যাশন অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে। সম্পর্কটা কেমন, তা শোনা যাক ফুটবল কোচ জোয়াও নুনো ফনসেকার কাছ থেকে।

রেঁস, বেনফিকা বি ও নঁতের সাবেক সহকারী কোচ এবং ম্যানচেস্টার সিটির মেথডোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান ফনসেকা বলেছিলেন, ‘ফুটবলে একধরনের ট্রেন্ড আছে, যা কিনা ফ্যাশনের মতো। কেউ যখন নির্দিষ্ট একটা জুতা পরেন, তখন সেটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।’ ফুটবল মাঠে ফরমেশন এবং কৌশলের ব্যাপারটাও অনেকটা তেমন। নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে সাফল্য পেলে তা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

পেপ গার্দিওলার কথাই ধরা যাক, যিনি শুধু ট্যাকটিকসের অগ্রদূতই নন, বরং একজন দার্শনিকও বটে। তবে গার্দিওলা কিন্তু এ তালিকায় একমাত্র বা শেষজন নন। ১৯৩০–এর দশকে কাউন্টার অ্যাটাকে উন্মাদনা ছড়ানো হার্বার্ট চাপম্যানের আর্সেনাল কিংবা রাইনাস মিশেল ও ইউহান ক্রুইফের ‘টোটাল ফুটবল’ অথবা হালের ইয়ুর্গেন ক্লপের ‘গেগেনপ্রেসিং ফুটবল’ কিন্তু তেমনই। ফুটবলের বিবর্তনে এই সব আবিষ্কার খেলাটিকে খোলনলচে বদলে দিয়েছে।

এরপরও ২০ শতকের শেষ দিকে এবং ২১ শতকের শুরুর দিকে ফুটবলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি ছিল এর একরৈখিকতা ঘিরে। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট কৌশলের ফাঁদে আটকে যাওয়া। প্রিমিয়ার লিগের প্রথমদিককার ফরমেশন শুরুতে দুই স্ট্রাইকার এবং ক্রসিং উইঙ্গারের ৪–৪–২—এর মধ্যেই আটকে ছিল অনেক দিন। এরপর এল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, ফলস নাইন এবং ইনভার্টেড উইঙ্গার (বাঁ পায়ের উইঙ্গার যখন ডান পাশে খেলেন এবং ডান পায়ের উইঙ্গার যখন বাঁ পাশে খেলেন, তাকে বলা হয় ইনভার্টেড উইঙ্গার) নিয়ে গড়া ৪–৩–৩ ফরমেশন।

লিভারপুল তারকা মোহাম্মদ সালাহ

তবে আপাতদৃষ্টে ফুটবল ফাঁদে পড়ে গেছে মনে হলেও কিছুটা ভিন্ন বাস্তবতাও আছে। ফুটবল কিন্তু ঠিকই ভেতরে ভেতরে বিকশিত হয়েছে। তাই উপরোক্ত কৌশলের ভেতর দিয়েই ফুটবল আরও গতিময় হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্কের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে খেলার গতি বেড়েছে ১৫ শতাংশ এবং প্রতি মিনিটে পাসের সংখ্যা বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।

কে জানে, ২০৩০ সালে গিয়ে এটি হয়তো আরও ১০–১২ শতাংশ করে বাড়তে পারে। দ্রুতগতির ফুটবল সামনে নিজের গতি আরও বাড়াবে। ফনসেকাও তেমনটাই মনে করেন, ‘দ্রুতগতির ফুটবল ভবিষ্যতেও এগিয়ে যাবে। এটি ফুটবলে হওয়া সবচেয়ে বড় বিবর্তনগুলোরও একটি। এটা শুধু ইংল্যান্ডে ঘটেছে এমন নয়, গোটা পৃথিবীতেই এমনটা ঘটতে দেখা গেছে।’

তবে এত সব বদলের পরও আমরা যদি গত মৌসুমে ম্যান সিটি, চেলসি, ব্রাইটন, লিভারপুল এবং আর্সেনালেরখেলার দিকে তাকাই, দেখব যে দলগুলো মোটা দাগে সেই একরৈখিক ফুটবলই খেলছে। গত মৌসুমেও চাপম্যানের সেই ‘ডব্লিউএম’ ফর্মুলাকে ভেঙেচুড়েই সব হয়েছে। এমনকি অনেক বড় দলকেও মৌলিকভাবে প্রায় একই ধরনের ফুটবল খেলতে দেখা গেছে। অবশ্য সে ক্ষেত্রে হয়তো শার্লক হোমসের জনক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের সেই কথাটি আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘নতুন বলে কিছু নেই। সবকিছু আগে হয়ে গেছে।’

আর বড় দলগুলো যে একই ধরনের ফুটবলই খেলছে, তা আরেকটি বিষয়ে স্পষ্ট। দলগুলো মূলত একই কিংবা একই ধরনের ফুটবলারদের দলে ভেড়ানোর পথে ছুটছে। যে কারণে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের খেলোয়াড়ের দাম অনেক বেড়ে গেছে। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হচ্ছে, বাঁ পায়ের সেন্টার ব্যাক। এর মূল কারণ, তাঁদের একই সঙ্গে ব্যাক থ্রি এবং ব্যাক ফোরে ব্যবহার করা যায়, যার ফলে গত মৌসুমে চেলসি মার্ক কুকুরেল্লার জন্য ৬ কোটি ইউরো এবং বেনোইট বাদিয়াশিলের জন্য ৩ কোটি ৫০ লাখ ইউরো করেছে। কুকুরেল্লাকে নিয়ে ব্রাইটনের প্রধান নির্বাহী পল বার্বার বলেছিলেন, তিনি এমন বাঁ পায়ের ডিফেন্ডার, যিনি ফুল ব্যাক এবং সেন্টার ব্যাক হিসেবে খেলতে পারেন। যে কারণে তাঁর দামও অনেক বেশি।

সিটি তারকা জ্যাক গ্রিলিশ

একই কারণে এরিক টেন হাগও আয়াক্স থেকে লিসান্দ্রো মার্তিনেজকে ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিয়ে এসেছেন। টেন হাগ বলেছিলেন, ‘বাঁ পায়ের সেন্টার ব্যাক বল দখলে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর কারণ, বাঁ পায়ের খেলোয়াড়েরা বাঁদিকে ভালোভাবেই অবস্থান নিতে পারেন।’ আর মাইকেল আরতেতা বলেছেন, ‘বাঁ পায়ের সেন্টার ব্যাক অনেক বেশি বিকল্প দেয় এবং সমাধানও বেশি দেয়।’

একইভাবে ইনভার্টেড উইঙ্গাররাও ২০১০ সালের পর থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। এর কারণ, মূলত সহজাত নম্বর নাইন থেকে দলগুলোর সরে আসা। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে উসমান দেম্বেলে, কিলিয়ান এমবাপ্পে, নেইমার, গ্যারেথ বেল, এডেন হ্যাজার্ড, নিকোলাস পেপে, আনহেল দি মারিয়া, রহিম স্টার্লিং এবং রিয়াদ মাহারেজদের কথা বলা যায়। যাঁরা সর্বকালের সেরা দামি ৫০ খেলোয়াড়ের তালিকায় অবস্থান করছেন। এ ছাড়া ২০২০ সালের পর থেকে তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন জ্যাক গ্রিলিশ, আন্তোনি এবং জাদন সানচোরা। এই ভূমিকায় সবচেয়ে সাফল্য দেখা গেছে সম্ভবত ২০২১–২২ মৌসুমে। যখন মোহাম্মদ সালাহ এবং সন হিউং–মিন যৌথভাবে ২৩ গোল করে প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতেছিলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে এসে নম্বর নাইন তথা স্ট্রাইকারের পজিশন সম্ভবত আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আর্লিং হলান্ড, আলেক্সান্দার ইসাক, জিয়ানলুকা এসকামাককা, রিচার্লিসন এবং দুসান ভ্লাহোভিচের মতো তারকাদের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এর বড় নিদর্শন। নম্বর নাইনের আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সঙ্গে অবশ্য সেন্টার ব্যাকের বল প্লেয়িং দক্ষতা বাড়ার সংযোগও রয়েছে।

দলবদলে তরুণ খেলোয়াড়দের গুরুত্বও বেশ চোখে পড়ার মতো। ফুটবল পরিসংখ্যানবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআইইএসের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২১ সালের দলবদলে ৫৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে অনূর্ধ্ব–২৪ বছর বয়সী খেলোয়াড়দের পেছনে। ২০২২–২৩ মৌসুমের শীর্ষ ১০টি দলবদলের ৮টি ছিল অনূর্ধ্ব–২৩ বছর বয়সী খেলোয়াড়দের। দলবদলে তারুণ্যের গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। তরুণদের ক্ষেত্রে কোচদের বেশ কিছু বাড়তি সুবিধাও থাকে। একজন তরুণ খেলোয়াড়কে যত সহজে বদলে দেওয়া যায়, একজন পরিণত খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে সেই কাজ বেশ কঠিন। জ্যাক গ্রিলিশের কথাই ধরা যাক। দ্বিতীয় মৌসুমে ভূমিকা বদলে গ্রিলিশকে আমূল পাল্টে দিয়েছেন পেপ গার্দিওলা।

চেলসি তারকা এনজো ফার্নান্দেজ

কোচের কৌশলগত ভূমিকার কারণে গোলরক্ষক, সেন্টার ব্যাক, ফুল ব্যাক এবং মিডফিল্ডারদের দলবদলের অঙ্ক বাড়লেও, ফরোয়ার্ডরাই কিন্তু ২০১৩–২৩ পর্যন্ত প্রায় ৫০ শতাংশ ফি দখল করে ছিলেন। এ ছাড়া ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এবং সেন্ট্রাল মিডফিল্ডাররাও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছেন। যেখানে উদাহরণ হিসেবে ডেক্লান রাইসকে নিয়ে আর্সেনাল ও ম্যান সিটির লড়াইয়ের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। অন্যদের মধ্যে উদাহারণ হিসেবে এনজো ফার্নান্দেজ, জুড বেলিংহাম, চুয়ামেনি, ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং ও কাসেমিরোর কথা বলা যেতে পারে। এরা সবাই ২০১৯ সালের পরই দলবদল করেছে এবং যাঁরা সবাই শীর্ষ ৫০–এ আছেন। এসব নামের মধ্যে কাসেমিরোর বয়সই শুধু দলবদলের সময় ২৫–এর ওপরে।

এমনকি দলবদলে গোলরক্ষকদের গুরুত্বও এখন বদলে গেছে। শুধু বল থামানোর বা গোল বাঁচানোর দক্ষতাই এখন আর সব নয়। বিল্ড আপ, বল প্লেয়িংয়ের মতো বিষয়গুলোও এখন সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একজন গোলরক্ষক আক্রমণে কীভাবে ভূমিকা রাখছেন, সেটিও এখন কোচের পরিকল্পনার অংশ। যদি সেরা ৫০–এ এখনো মাত্র ২ জন গোলরক্ষক জায়গা পেয়েছেন। চেলসির কেপা আরিজাবালাগা এবং লিভারপুলের অ্যালিসন বেকার।

তবে বর্তমান সময়ে কোচদের ট্যাকটিকসে গোলরক্ষকদের ভূমিকা যেভাবে বাড়ছে, তা আগামী দিনে তাঁদের দাম বাড়ার ইঙ্গিতই যেন দিচ্ছে। গোলরক্ষকদের গুরুত্ব প্রসঙ্গে ফনসেকা বলেন, ‘সেরা দল ১১ জন নিয়ে খেলে, ১০ জন নিয়ে নয়। দলগুলো ভুলে যায়, তাদের একজন গোলরক্ষক আছেন।’ সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমেও গোলরক্ষকেরা আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ফুটবলের কৌশলগত বিকাশ বলছে, সামনের দিনে এ ভূমিকা আরও বাড়ছে।

*দ্য অ্যাথলেটিক অবলম্বনে