‘আশা করি আমাদের নাচ সবার ভালো লেগেছে’— জর্জিয়ার বিপক্ষে গোলের পর লামিনে ইয়ামালের সঙ্গে যুগল নৃত্য নিয়ে এমনটাই বলেছিলেন নিকো উইলিয়ামস। আজ শিরোপা জিতে ইউরো অভিযান শেষ করে এ দুজন এখন বলতেই পারেন, ‘আমাদের খেলাও আশা করি আপনাদের সবার ভালো লেগেছে।’ ভালো লেগেছে বললে অবশ্য অন্যায়ই করা হবে! রীতিমতো যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন তাঁরা।
গোল করে নিজেরা নাচলেও মূলত পুরো টুর্নামেন্টেজুড়ে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের নাচিয়ে ছেড়েছেন ইয়ামাল ও উইলিয়ামস। আজ রাতে ইংলিশ রক্ষণকেও নাচিয়েছেন এ দুই বন্ধু। এ দুজনের পায়ে ফ্ল্যামেঙ্কোর তালে তালে এসেছে স্পেনের চতুর্থ ইউরো শিরোপা। আর শিরোপা জিতেও পুরো দলকে সঙ্গে নিয়ে আরেকবার নাচলেন তাঁরা।
স্প্যানিশদের উদ্যাপনের নাচ অবশ্য শুরু হলো বলে! আজ রাতের পর হয়তো আরও কয়েকদিন চলবে স্প্যানিশ নৃত্যে। এই নাচ অবশ্য শুধু ইয়ামাল, উইলিয়ামস কিংবা স্পেন দলের নয়, এই নাচের সঙ্গী এখন গোটা স্পেন। মাদ্রিদ–বার্সেলোনার রাস্তা থেকে শুরু করে যে নাচের ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে আরও দূর দিগন্তে।
স্পেনের হয়ে ইয়ামাল ও উইলিয়ামস দুই উইংয়ে খেললেও, দলের প্রয়োজনে জুটি গড়তে সময় নেননি এ দুজন। সেই জুটির ফলাফলই হলো আজকে ইয়ামালের সহায়তায় করা উইলিয়ামসের গোলটি।
দলকে জেতানোর জন্য জুটি গড়ার পাশাপাশি এ দুজনের আছে কাকতালীয় কিছু মিলও। এমনিতই অবশ্য বলা হয়, স্প্যানিশ ফুটবলে ইয়ামাল ও উইলিয়ামসের সম্পর্ক দুই ভাইয়ের মতো। এমনকি কদিন আগে একদিনের ব্যবধানে দুজন জন্মদিনও পালন করেছেন। উইলিয়ামস ১২ জুলাই এবং ইয়ামাল জন্মদিন পালন করেছেন ১৩ জুলাই। এ দুজনের মধ্যে আরেকটি বড় মিল, দুজনের কারওই আদি ভূমি কিন্তু স্পেন নয়। এ দুজনের পূর্বপুরুষ স্পেনে এসেছেন আফ্রিকা মহাদেশ থেকে।
হয়তো স্পেনের এক যুগ পর শিরোপা এনে দেবেন বলেই প্রকৃতি তাঁদের এনেছে একই ছায়াতলে। ফাইনালের আগে তাঁদের নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির লিডারশিপ এবং কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মোজেস রুইজ বলেছিলেন, ‘তারা স্পেনের গর্ব। যারা নতুন স্পেনের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্তও বটে। এই দুই স্প্যানিয়ার্ড পারিবারিক সংগ্রাম ও প্রতিকূলতার বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। বিনয় এবং প্রতিভা বিবেচনায় যারা দুজন বাকিদের জন্য আদর্শও বটে।’
মাঠের বাইরে আদর্শ হয়ে ওঠার সঙ্গে মাঠেও স্পেনের আক্রমণভাগে গতি ও শৈল্পিক ফুটবলের রোমাঞ্চ ছড়িয়েছেন এ দুজন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, তাঁদের পারফরম্যান্স নিছকই সুন্দর ফুটবলের প্রতীকী রূপ হয়ে থাকেনি। গতিময় ও সুন্দর ফুটবল যে এখনও কার্যকরী হতে পারে সেটাও যেন প্রমাণ করেছেন এ দুই বন্ধু।
স্পেন ফাইনালে ওঠার পর থেকেই অবশ্য আলোচনায় ছিলেন এ দুজন। পুরো দেশ অপেক্ষায় ছিল এ দুজনের জ্বলে ওঠার। কারণ, ইংলিশ রক্ষণের কড়া পাহাড়া ভেঙে জিততে হলে এ দুজনকেই এগিয়ে এসে কিছু করতে হতো। ম্যাচের শুরুতে অবশ্য এ দুজনকে আটকে রাখার কাজটা ভালোভাবেই করেছিলেন দুই ইংলিশ ডিফেন্ডার লুক শ এবং কাইল ওয়াকার।
প্রথমার্ধে খুব একটা জায়গা নিয়েও খেলতে পারেননি তাঁরা। কিন্তু বড় মঞ্চের খেলোয়াড়রা তো প্রতিকূলতা জয় করেই সাফল্যের চূড়ায় ওঠেন। হয়তো বিরতির সময় সেটাই তাঁদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন কোচ দে লা ফুয়েন্তে। আর বিরতি থেকে ফিরেই ইংলিশদের রক্ষণ জাল ছিন্নভিন্ন করে এনে দেন দুর্দান্ত এক গোল। যে গোল স্পেনকে গড়ে দিয়েছে শিরোপা জয়ের ভিতও। তবে এই গোলই নয়, দ্বিতীয়ার্ধজুড়ে দুর্দান্ত খেলেছেন এ দুজন।
বিশেষ করে ইয়ামালের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। বিরতির পর একের পর আক্রমণে ইংল্যান্ডের রক্ষণকে একাই কাঁপিয়েছেন এ উইঙ্গার। ইংলিশ গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ড দেয়াল তুলে না দিলে পেতে পারতেন একাধিক গোলও। ফাইনালে স্বপ্নের সেই গোলটি না আসলেও, তাতে আটকায়নি শিরোপা জয়।
এর আগে ফাইনালে মাঠে নামতেই ইয়ামাল গড়েন ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে বড় টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলার রেকর্ড। আর এখন হয়েছেন সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে বড় শিরোপা জেতা খেলোয়াড়ও। এরপর ইউরোর সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতেছেন এই বার্সেলোনা উইঙ্গার।
ইয়ামালের ১৭ ও উইলিয়ামসের ২২, বয়সই বলে দিচ্ছে ক্যারিয়ারটা সবে শুরু হলো তাঁদের। আর শুরুতেই ব্লকবাস্টার পারফরম্যান্সে জিতলেন দুর্দান্ত এক শিরোপা। এখন পথ চলতে চলতে সামনের দিনে এ দুজন একসঙ্গে স্পেনকে আরও কত মনি–মুক্তোর খোঁজ এনে দেন সেটাই দেখার অপেক্ষা।