‘হেই জুড, ডোন্ট মেইক ইট ব্যাড/ টেক আ স্যাড সং অ্যান্ড মেইক ইট বেটার’
১৯৬৮ সালে রিলিজ হওয়ার পর ‘বিটলস’–এর গানটি গোটা দুনিয়া মাতিয়ে তুলেছিল। গত জুনে বেলিংহাম রিয়ালে যোগ দেওয়ার পর এই গানের দ্বিতীয় লাইন দিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল বেলিংহামকে। রিয়ালের জার্সিতে প্রথম চার ম্যাচে এই ইংলিশ মিডফিল্ডারের পারফরম্যান্স বলছে সেই স্বাগত বার্তাকে তিনি বেশি গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছিলেন।
গানের লাইনে যে স্যাড সং বা বিষণ্নতার গানের কথা বলা হচ্ছে, সেটাকে রিয়ালের গত মৌসুমের পারফরম্যান্সের প্রতীক ধরা যেতে পারে। লা লিগা কিংবা চ্যাম্পিয়নস লিগ কোনোটাই জিততে পারেনি ‘লস ব্ল্যাঙ্কোস’রা। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে তো রীতিমতো নাস্তানাবুদ হয়েছিল ম্যানচেস্টার সিটির কাছে। তার ওপর মৌসুম শেষে ক্লাব ছেড়ে যান করিম বেনজেমার মতো তারকা।
নতুন মৌসুমে রিয়ালের প্রয়োজন পড়ছিল নতুন কোনো ‘গীতিকার’ বা ‘সং রাইটারের’। আর নতুন সুর বাঁধার লক্ষ্যে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে নিয়ে আসা হয় বেলিংহামকে। যাঁর কাছে প্রথম দিনই নিজেদের প্রত্যাশাটা জানিয়ে দেয় রিয়াল, ‘একটি বিষণ্ন গান নাও এবং সেটিকে ভালো করে দাও।’ কিন্তু রিয়াল কর্তৃপক্ষও হয়তো ভাবেনি সেই গানটা শুধু ভালোই হবে না, বরং আরও দারুণ কিছু হবে।
এদিকে বেলিংহামের চোখধাঁধানো পারফরম্যান্সের পর ‘হেই জুড’ গানটা এখন রিয়ালের থিম সংয়েও পরিণত হয়েছে। গতকাল রাতে শেষ মুহূর্তে দলকে জেতানোর পর গোটা স্টেডিয়াম এক সুরে গেয়ে ওঠে গানটি। সেই মুহূর্তের অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেলিংহাম বলেছেন, ‘গোলের পরের মুহূর্তে আমি যে উল্লাসধ্বনি শুনেছি, তেমনটা আর কখনো শুনিনি। শেষে দর্শকেরা যখন ‘হেই জুড’ গাচ্ছিল আমার লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল, আমার পা নড়ছিল না।’
বেলিংহামের উত্থানপর্বের শুরুটা হয়েছিল ডর্টমুন্ডে। ২০২০ সালে বার্মিংহাম সিটি থেকে তাঁকে কিনে নেয় ডর্টমুন্ড। পরের দুই বছর আর্লিং হলান্ডের সঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছিলেন বিধ্বংসী এক জুটি। ফরোয়ার্ড লাইনে হলান্ড এবং মিডে নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেলিংহাম। হলান্ডকে নিয়ে গত মে মাসে এক নিবন্ধে বিশ্বকাপজয়ী জার্মান অধিনায়ক ফিলিপ লাম লিখেছিলেন, ‘বেলিংহাম একজন পরিপূর্ণ মিডফিল্ডার। সে ড্রিবল করতে পারে, পাস দিতে পারে, শট নিতে পারে এবং তার গোলক্ষুধাও আছে। বলের সঙ্গে তার প্রথম স্পর্শটি হয় অনন্য। …শারীরিকভাবে সে দারুণ ফিট এবং তার মধ্যে কোনো ভয়ও নেই। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সে লড়াই করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দায়িত্ব নিতে পারে।’
গত চার ম্যাচে রিয়ালের হয়ে বেলিংহামের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করলে লামের কথাগুলো পুরোপুরি মিলে যাবে। রিয়ালের জার্সিতে মাঠে নামার পর থেকে পুরো নিয়ন্ত্রণ যেন বেলিংহামের হাতে। বেলিংহাম যে শুধু গোল করছেন, তা নয়, কোন পরিস্থিতিতে গোলগুলো করছেন, তা–ও বিবেচনা করার মতোই।
শুরুতেই বিলবাওয়ের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচের চাপ সামলে প্রতিপক্ষের মাঠে নিজের প্রথম গোলটি আদায় করেন বেলিংহাম। আলমেরিয়ার বিপক্ষে শুরুতে পিছিয়ে পড়া দলকে প্রথমে গোল করে সমতায় ফেরান, পরে আবার গোল করে এগিয়েও দেন। সেদিন রিয়াল ম্যাচটি জেতে ৩-১ গোলে। সেল্তা ভিগোর বিপক্ষে রিয়াল যখন পয়েন্ট হারানোর শঙ্কায় কাঁপছিল তখন বেলিংহামের গোলেই জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে রিয়াল। আর এবার হেতাফের বিপক্ষে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দলকে জয় এনে দেন বেলিংহাম। অর্থাৎ রিয়ালের হয়ে এখন পর্যন্ত যে চার ম্যাচ বেলিংহাম খেলেছেন প্রতিটি ম্যাচেই বিশেষ কিছু করে দেখাতে হয়েছে তাঁকে।
বেলিংহামের এই বদলে যাওয়ার পেছনে ‘বড় দল’ তত্ত্বও বেশ ভালোভাবে কাজে লেগেছে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘রিয়ালে এসে খেলোয়াড় হিসেবে আগের মৌসুম থেকে আমি ১০ গুণ ভালো।’ এমন নয় যে, এই কদিনে বেলিংহাম দারুণ কিছু শিখে ফেলেছেন বা কোনো জাদুর কাঠির ছোঁয়া পেয়েছেন। মূলত রিয়ালের মতো চ্যাম্পিয়ন দলে খেলাটাই আমূল বদলে দিয়েছে বেলিংহামকে। তাঁর উন্নতি নিয়ে দ্য অ্যাথলেটিককে এক রিয়াল কর্তা বলেছেন, ‘গত কয়েক মাসে তার মৌলিক উন্নতি হয়েছে।… এমন নয় যে মাদ্রিদে এসেছে বলে তাঁর উন্নতি হয়েছে। বরং মাদ্রিদের উন্নতি হয়েছে সে এসেছে বলে।’
এ কথাগুলোতেই রিয়ালের বর্তমান দলের ওপর বেলিংহামের প্রভাবটা স্পষ্ট। তবে যে অল্প সময়ের মধ্যে রিয়ালের মধ্যমণি হিসেবে এই ইংলিশ মিডফিল্ডার আবির্ভূত হয়েছেন, তা অবাক করার মতোই। আর বিষয়টা একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে। পর্তুগিজ মহাতারকার পর আর কোনো ফুটবলার রিয়ালে এসে এতটা দাপটের সঙ্গে নিজে আবির্ভাবের ঘোষণা দেননি। আর পরিসংখ্যানের নিরিখেও একটি রেকর্ডে রোনালদোর পাশে বসেছেন বেলিংহাম। রোনালদোর পর রিয়ালের ইতিহাসের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম চার ম্যাচে গোল করলেন বেলিংহাম।
বেলিংহামের এমন দুর্দান্ত ছন্দে থাকার কৃতিত্ব দিতে হবে রিয়াল মাদ্রিদ কোচ কার্লো আনচেলত্তিকেও। বেনজেমাকে হারানোর পর বেলিংহামের সেরাটা বের করে আনতে নিজের কৌশলের পরিবর্তনও এনেছেন ইতালিয়ান এই কোচ। ৪-৪-২ ডায়মন্ড ফরমেশনে দলকে খেলিয়ে ইংলিশ মিডফিল্ডারের সেরাটা বের করে আনছেন আনচেলত্তি। প্রাক্–মৌসুমেই এই কৌশলে দলকে খেলানো শুরু করেন রিয়াল কোচ। সেখানে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগলেও লা লিগা শুরুর পর দারুণ সাফল্য পেয়েছে রিয়াল। বেলিংহামের জন্য বদলানো কৌশলটি আনচেলত্তির জন্যও নতুন।
আগের দুই মৌসুমে তিনি বেশির ভাগ সময় দলকে ৪-৩-৩ ফরমেশনে খেলিয়েছেন। এটি ব্যবহার করে ‘লা ডেসিমা’সহ একাধিক শিরোপা জিতেছে রিয়াল। গত মৌসুমেও এই কৌশলে স্থির ছিলেন আনচেলত্তি। কিন্তু বেনজেমার মতো স্কোরার চলে যাওয়ার পর চেনা এই ফরমেশন ভেঙে বেরিয়ে আসেন আনচেলত্তি। আর তখন তিনি সাহস করে রণকৌশল সাজান সদ্য আগত বেলিংহামকে ঘিরে। যা কিনা প্রথম চার ম্যাচেই এনে দিয়েছে দারুণ ফল। এখন মৌসুমের বাকি সময়ও এই ধারাবাহিকতা বেলিংহাম ও রিয়াল ধরে রাখতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।