রিয়াল মাদ্রিদের চলতি মৌসুমটা একরকম হতাশায় কেটেছে। কোপা দেল রে জিতলেও বড় দুই প্রতিযোগিতা চ্যাম্পিয়নস লিগ ও লা লিগাতে দর্শকের সারিতেই থাকতে হয়েছে রিয়ালকে। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে উঠে সম্ভাবনা জাগালেও সেখানেই শেষ হয়েছে রিয়ালের যাত্রা। চলতি মৌসুমটা ব্যর্থতায় পার করায় এখন নতুন মৌসুম সামনে রেখে বেশ মনোযোগী রিয়াল কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে আক্রমণভাগ নিয়ে আলাদাভাবে ভাবছে তারা। যেখানে নতুন খেলোয়াড় যোগ করতে বেশ মরিয়া অবস্থান নিয়েছে ক্লাবটি। সব মিলিয়ে রিয়াল আক্রমণের অবস্থা কেমন এবং আগামী মৌসুমে কেমন চেহারা নিতে পারে, তা দেখে নেওয়া যাক।
রিয়ালের বর্তমান স্কোয়াডে থাকা খেলোয়াড়দের কার অবস্থা কেমন:
ভিনিসিয়ুস জুনিয়র (চুক্তির মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত)
রিয়ালের স্কোয়াডে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়টি সম্ভবত ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। তবে গুরুত্বে উনিশ–বিশ হলেও সবেচেয়ে আলোচিত খেলোয়াড় যে ভিনিসিয়ুস, সে নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। পাশাপাশি এই মৌসুমে সবচেয়ে সফল খেলোয়াড়ও হলেন ভিনি। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৩ গোলের পাশাপাশি করেছেন ২১টি অ্যাসিস্টও। রিয়াল ড্রেসিংরুমে, কোচিং স্টাফদের মধ্যে এবং ক্লাব কর্তৃপক্ষের মধ্যে তাঁকে ধরে রাখা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হয়ে ভিনি ঠিকই ক্লাব ছাড়ার কথা ভেবেছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ভিনি হয়তো রিয়াল ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আগামী মৌসুমেও দলের আক্রমণে অন্যতম ভরসা হয়ে মাঠে নামবেন। তবে রিয়ালের প্রত্যাশা থাকবে ভিনি যেন তাঁর মনোযোগও মাঠে রাখেন। নয়তো তাঁর কাছ থেকে পুরোটা বের করে আনতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে রিয়াল কোচকে।
রদ্রিগো (চুক্তির মেয়াদ ২০২৮ পর্যন্ত)
এ মৌসুমের রিয়ালের আক্রমণের অন্যতম তারকা ছিলেন রদ্রিগো। দলকে শিরোপা এনে দিতে ব্যর্থ হলেও মাঠে ঠিকই পারফরম্যান্সে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা। ১৯ গোল করে তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলাদাতাও রদ্রিগো। পাশাপাশি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০টি অ্যাসিস্টও এসেছে তাঁর কাছ থেকে। দলে তাঁর অবস্থান নিয়ে কোচ আনচেলত্তিরও কোনো সন্দেহ নেই। যাঁকে রিয়াল কোচ কখনো রাইট উইং, কখনো ‘ফলস নাইন’ এবং কখনো দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কোপা দেল রের ফাইনালে ওসাসুনাকে হারিয়ে শিরোপা জয়ের পথে ম্যাচসেরাও হয়েছিলেন এই তরুণ তুর্কি। আগামী মৌসুমেও রিয়ালের আক্রমণভাগের অন্যতম ভরসা হবেন রদ্রিগো।
মার্কো আসেনসিও (এ মৌসুমে চুক্তি শেষ)
আসেনসিওকে রিয়াল চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আসেনসিও চুক্তি নবায়ন না করে আসছে দলবদলেই ক্লাব ছাড়তে চান। মূলত দলে নিয়মিত সুযোগ না পাওয়ার কারণেই ক্লাব ছেড়ে যেতে চান ২৭ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড। তাঁর সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে অ্যাস্টন ভিলা এবং পিএসজির কথা শোনা যাচ্ছে।
এডেন হ্যাজার্ড (চুক্তির মেয়াদ ২০২৪ পর্যন্ত)
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে আসার পর থেকেই একরকম বোঝা হয়ে আছেন এডেন হ্যাজার্ড। একের পর এক চোট তাঁকে রীতিমতো কোণঠাসা করে রেখেছে। রিয়ালে সামনের দিনগুলোতেও তাঁর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এরই মধ্যে শোনা গেছে, টটেনহাম নাকি হ্যারি কেইনকে দিয়ে হ্যাজার্ডকে দলে নিতে চায়। যদি তেমন প্রস্তাব আসে রিয়াল কর্তৃপক্ষে না করার সম্ভাবনা সামান্যই বলা যায়। আর দলে থেকে গেলেও তাঁর নিয়মিত হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।
সের্হিও আরিবাস (চুক্তির মেয়াদ ২০২৫ পর্যন্ত)
এই মৌসুমে খুব সামান্যই সুযোগ পেয়েছেন সের্হিও আরিবাস। মাত্র ৪ ম্যাচে তাঁকে খেলিয়েছেন আনচেলত্তি। তবে রিয়াল যদি তাঁকে রেখে দেয়, তবে সামনের দিনগুলোতে নিজেকে মেলে ধরার আরও সুযোগ আসতে পারে ২১ বছর বয়সী এই ফুটবলারের সামনে। যদিও দলের কৌশলে তিনি পুরোপুরি ফিট হবেন কি না, সে আশঙ্কাও আছে। এ কারণে তাঁকে যদি রিয়ালে ধারে কোথাও পাঠায় বা শেষ পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়, সেটিও অবাক করা ব্যাপার হবে না।
ব্রাহিম দিয়াজ (চুক্তির মেয়াদ ২০২৫ পর্যন্ত)
২০২০ সাল থেকে ধারে এসি মিলানে খেলেছেন ব্রাহিম দিয়াজ। যেখানে তিনি মিলানকে ১১ বছর পর লিগ শিরোপা জেতানোর পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে খেলতেও সহায়তা করেছেন। মিলানের হয়ে এ সময়ে ১২৩ ম্যাচ খেলে ১৮ গোল এবং ১৪টি অ্যাসিস্ট করেছেন দিয়াজ। তাঁকে মিলান এখন স্থায়ী চুক্তিতে পেতে চাইছে। তবে দিয়াজ নাকি রিয়ালের সঙ্গে ২০২৭ পর্যন্ত চুক্তি বাড়ানো নিয়ে আলাপ শুরু করেছেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও পরের মৌসুমে দিয়াজের রিয়ালে ফিরে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে রিয়ালের একাদশে তাঁর নিয়মিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই বললেই চলে।
রেইনিয়ের জেসুস (চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ পর্যন্ত)
জেনোয়ার হয়ে ধারে খেলে এ মৌসুমে বেশ আলো ছড়িয়েছেন রেইনিয়ের জেসুস। তবে চোটের কারণে তাঁর অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অবশ্য সুস্থ হলেও রিয়ালের পরিকল্পনায় না থাকার বিষয়টি নিশ্চয় জেসুস নিজেও বুঝতে পেরেছেন। তাই সেটিকে মাথা থেকে বাদ দিয়েই অন্য পরিকল্পনা করতে হবে জেসুসকে। তবে সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হচ্ছে তাঁর জেনোয়াতে আরেক মৌসুম থেকে যাওয়ার।
করিম বেনজেমা (এ মৌসুমে চুক্তি শেষ)
রিয়ালের একমাত্র কার্যকর স্ট্রাইকার করিম বেনজেমা। এককভাবে তাঁর ওপর নির্ভরশীলতা রিয়ালকে চলতি মৌসুমে বেশ ভুগিয়েছে। গত মৌসুমে ব্যালন ডি’অর জেতা বেনজেমা এ মৌসুমের বেশির ভাগ সময়ে চোটে ভুগেছেন। ছন্দহীনতাতেও ভুগেছেন বেশ। তবে যা গেছে তা তো গেছেই। এরপর কী হবে? নতুন খবর হচ্ছে সৌদি সরকার নাকি বেনজেমাকে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে সে দেশের লিগে খেলার জন্য। এরই মধ্যে বেনজেমার সাবেক সতীর্থ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সৌদি লিগে খেলছেন। মেসিরও সেখানে যাওয়ার জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বেনজেমাও কি সেই পথে হাঁটবেন? এসব ধোঁয়াশা কাটতে অবশ্য আরও সময় লাগবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে নিজের সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন বেনজেমা। রিয়ালেও তাঁর অবস্থান এখন নিরঙ্কুশ নয়। আরেক মৌসুম টিকে গেলেও এখনই তাঁর বিকল্প নিয়ে আলাদাভাবে ভাবছে ‘লস ব্লাঙ্কোস’ শিবির।
মারিয়ানো দিয়াজ (চলতি মৌসুম শেষেই চুক্তি শেষ)
আচরণগত সমস্যা ও পারফরম্যান্সের ঘাটতির কারণে এ মৌসুম শেষেই রিয়াল ছেড়ে যাবেন দিয়াজ। রিয়ালও তাঁকে রেখে দেওয়ার ব্যাপারটি বিবেচনা করেনি। তাই এই সেন্টার ফরোয়ার্ডকে এখন নতুন গন্তব্যেই আপাতত চোখ রাখতে হচ্ছে।
আলভারো রদ্রিগেজ (চুক্তির মেয়াদ ২০২৭ পর্যন্ত)
আগামী মৌসুমের রিয়ালের যেসব তরুণ তুর্কির ওপর চোখ থাকবে, তাদের মধ্যে আলভারো রদ্রিগেজ উল্লেখযোগ্য। কিংবদন্তি রাউল গঞ্জালেসের অধীনে নিজেকে দারুণভাবে প্রস্তুত করেছেন রদ্রিগেজ। এ মৌসুমে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে মাঠে নেমে নিজের প্রথম লা লিগা গোলও করেছেন রদ্রিগেজ। আগামী মৌসুমে নিজের পরিকল্পনায় তাঁকে রাখতে পারেন কোচ আনচেলত্তি। তবে রদ্রিগেজকে যদি নিয়মিত খেলানো হয়, তবে তাঁকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। নতুন মৌসুমে রিয়াল বস হয়তো রদ্রিগেজকে লুকোনো তাস হিসেবেই ব্যবহার করবেন।
নতুন যাঁরা আসতে পারেন
আগামী মৌসুমে স্কোয়াডকে শক্তিশালী করতে এরই মধ্যে আক্রমণভাগের একাধিক তারকার ওপর চোখ রেখেছে রিয়াল। যাদের মধ্যে সবার আগে আসছে জুড বেলিংহামের নাম। বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের এই ইংলিশ তারকার সঙ্গে রিয়ালের চুক্তি ঘোষণা নাকি শুধুই সময়ের ব্যাপার। বেলিংহাম আসলে সেটি রিয়ালের আক্রমণভাগকে আক্ষরিক অর্থেই সমৃদ্ধ করবেন। নিজের দিনে যেকোনো শক্তিশালী রক্ষণকে একাই শেষ করে দিতে পারেন বেলিংহাম।
শুধু বেলিংহামই নন, এই মৌসুমে আরও এক ইংলিশ স্ট্রাইকারের ওপর চোখ আছে রিয়ালের। তিনি আর কেউ নন, ইংলিশ স্ট্রাইকার হ্যারি কেইন। সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমেও লিগে একাই ৩০ গোল করে আলোচনায় এসেছেন কেইন। তবে টটেনহামের ঘরের ছেলে এখন ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে চান। প্রিমিয়ার লিগের বাইরে গেলে তাঁকে আটকাবে না স্পাররাও। তাই আগামী দিনগুলোতে মাদ্রিদে তাঁর নতুন যাত্রার খবর এলে তা মোটেই অবাক করা ব্যাপার হবে না।
কেইন না এলে রিয়ালের আক্রমণভাগেও দারুণ বৈচিত্র্য আসবে। কেইন ও বেলিংহামের বাইরে ব্যাকআপ তারকা হিসেবে লাওতারো মার্তিনেজ এবং রবার্তো ফিরমিনোর নামও নাকি রিয়ালের তালিকায় আছে। যদিও এসব আলাপ এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই আছে। চূড়ান্ত খবর জানতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।