নতুন তারকা লামিনে ইয়ামাল
নতুন তারকা লামিনে ইয়ামাল

ইয়ামাল ‘মেসি’ হবেন না, ইয়ামালই হবেন

বিদায় রাগিণীর মধ্যে কি লুকানো থাকে আগমনী সুর? হয়তো। শেষ মানেই তো নতুন শুরুর অপেক্ষা।

এই যে ফুটবলের একটা মৌসুম শেষ হলো, তারপর ইউরো-কোপা আমেরিকাও, সেখানে বিদায়ের গান শুনিয়েছেন কত তারকা। আনহেল দি মারিয়া, টনি ক্রুস, টমাস মুলার, অলিভিয়ের জিরু, জেরদান শাকিরিরা বিদায় বলেছেন, কেউ শুধু জাতীয় দল থেকে, কেউ ফুটবল থেকেই। কেউ সব পেয়ে শেষটাও রঙিন করে, কেউ অনেক পেয়েও শেষটা মনের মতো করতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে।

আবার এই বিদায় রাগিণীর মধ্যেই শোনা গেছে ফুটবলের আগামী দিনের মহাতারকার আগমনী গান। কলি থেকে ফুল হয়ে ফোটার আভাস দিয়েছেন কেউ কেউ। নতুন মৌসুমে যাঁদের দেখার জন্য থাকবে অধীর অপেক্ষা। তালিকাটা হয়তো খুব বেশি বড় হবে না, তবে সেই তালিকার ১ নম্বর নামটা নিয়ে মনে হয় না কোনো সন্দেহ আছে—লামিনে ইয়ামাল। ইউরোপের ফুটবল এ সময়ে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নাম।

আগমনী গান অবশ্য তিনি শুনিয়ে যাচ্ছেন বেশ কিছুদিন ধরেই। গত বছর ৩০ এপ্রিল যখন বার্সেলোনার জার্সিতে লা লিগায় অভিষেক হলো, হিসাব করে দেখা গেল সেদিন ইয়ামালের বয়স মাত্র ১৫ বছর ২৯০ দিন!

সবকিছু বাদ দিলে ওটাই একটা বিস্ময়। বার্সেলোনার মতো ক্লাব তো আর যেনতেন কাউকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে লা লিগায় খেলাবে না। বার্সেলোনার ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় যিনি, শৈশবেই যাঁর মধ্যে অমিত প্রতিভার সন্ধান মিলেছিল, মনে করা হচ্ছিল, একদিন এই ছেলে ফুটবল–বিশ্ব শাসন করবে, যেটা পরে সেই ছেলে করেছেও, সেই লিওনেল মেসির অভিষেক হয়েছিল প্রায় ১৭ বছর বয়সে। সেখানে বয়স ১৬ হওয়ারও আড়াই মাস আগে একজনকে বার্সেলোনার মতো ক্লাবের মূল দলে খেলানো, বিশেষ কেউ না হলে কি সেটা সম্ভব!

মেসির কোলে ছোট্ট ইয়ামাল

ইয়ামাল যে বিশেষ কেউ, সেটার আভাস অবশ্য এর আগেই কিছুটা মিলেছিল। মেসির মতোই যে বার্সেলোনার বিখ্যাত লা মাসিয়া একাডেমিতে তাঁর ফুটবলের প্রথম পাঠ। ৭ বছর বয়সে বিখ্যাত সেই একাডেমিতে যোগ দেওয়ার পর অনূর্ধ্ব-৯, ১০, ১১ সব দলেই তাঁর সদর্প উপস্থিতি। মিলও তো কম নয় মেসির সঙ্গে। মূলত বাঁ পায়ের খেলোয়াড়, খেলেন মাঠের ডান দিকে। তবে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, পুরোদস্তুর স্ট্রাইকার কিংবা ‘ফলস নাইন’ সব ভূমিকাতেই স্বছন্দ। গতি, ড্রিবলিং, নিয়ন্ত্রণ—সবকিছুতেই তাঁর মধ্যে মেসির ছায়া দেখেন অনেকেই।

বার্সার অনূর্ধ্ব-১৬ দলে যখন খেলেছেন, তখন তাঁর বয়স ১৪ হয়নি। নিজের চেয়ে বছর দুয়েক বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলা এবং নিজেকে আলাদা করে চেনানোর ওই সময়টাতেই হয়তো বার্সার বয়সভিত্তিক দলের কোচরা বুঝে ফেলেন, এই ছেলে মূল দলে খেলার জন্যও ভালোভাবেই তৈরি।

বার্সার তখনকার কোচ জাভিও তাই অপেক্ষা করেননি। নিজে লা মাসিয়ায় মেসির সঙ্গে বেড়ে ওঠা, সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডারদের একজনও, রত্ন চিনতে তাঁরও ভুল হয়নি। শুধু বার্সেলোনারই নয়, লা লিগার ইতিহাসেই সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হয়ে তাই অভিষেক হয়ে গেল ইয়ামালের।

১৫ মাস আগের ঘটনা সেটি। এরপর সেই ইয়ামাল বার্সেলোনার হয়ে লা লিগা জিতেছেন ১৫ বছর ৩০৫ দিন বয়সে, বার্সেলোনা ও লা লিগার রেকর্ড এটি। ১৬ বছর ৪৫ দিন বয়সে গোল করে হয়েছেন বার্সা ও লা লিগার ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী গোলদাতাও।

ইয়ামাল বার্সেলোনার হয়ে লা লিগা জিতেছেন ১৫ বছর ৩০৫ দিন বয়সে

স্পেন জাতীয় দল তখন ইউরোর বাছাইপর্ব খেলছে আন্তর্জাতিক বিরতিতে। আর এমন একজনকে জাতীয় দলে কোন কোচ না চাইবেন! একটা সন্দেহ অবশ্য ছিল স্পেন কোচ লুইস দে লা ফুয়েন্তের। ইয়ামালের জন্ম স্পেনের অভিবাসী পরিবারে। বাবা মরোক্কান, মা গিনির। গিনি হয়তো ফুটবলে তেমন বড় কোনো দল নয়, কিন্তু মরক্কো তখন ২০২২ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলে বেশ আলোচনায়। ইয়ামালের জন্ম স্পেনের মাতারো শহরে, বয়সভিত্তিক দলে স্পেনকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তবে জাতীয় দলের জার্সিতে চাইলে মরক্কোর হয়েও খেলতে পারতেন। শেষ পর্যন্ত বাবার দেশ নয়, ইয়ামাল নিজের জন্মভূমিকেই প্রতিনিধিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে জর্জিয়ার বিপক্ষে ইউরোর বাছাইপর্বে খেলতে নেমেই গড়েন নতুন রেকর্ড, ১৬ বছর ৫৭ দিন বয়সে হয়ে যান স্পেনের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়, তারপর সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতাও। তখন থেকেই তাঁকে ইউরোর মূল মঞ্চে দেখার অপেক্ষা।

ইয়ামাল নিরাশ করেননি। স্পেনের হয়ে ইউরো জেতার আগে ১৬টি গোলের সুযোগ বানিয়েছেন পুরো টুর্নামেন্টে, তিনটি গোল করিয়েছেন, আর ফ্রান্সের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ১৬ বছর ৩৬২ দিন বয়সে দুর্দান্ত এক গোল করে তো গড়েছেন আরও একটা রেকর্ড। ইউরোর ও বিশ্বকাপ মিলিয়েই তাঁর চেয়ে কম বয়সে গোল নেই আর কারও। টুর্নামেন্টজুড়েই দুর্দান্ত খেলা ইয়ামালকে সেরা তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে বেছে নিতে তাই খুব একটা ভাবতে হয়নি উয়েফার টেকনিক্যাল কমিটির। হতে পারতেন আসলে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও।

স্পেনের হয়ে ইউরো জিতেছেন ইয়ামাল

ফাইনালের আগের দিন ১৭তম জন্মদিনের কেক কেটেছেন, এর কয়েক দিন আগে মেসির সঙ্গে তাঁর ছোটবেলার একটা ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বাচ্চা ইয়ামালকে গোসল করাচ্ছেন মেসির। ২০০৭ সালে বার্সেলোনার হয়ে একটা চ্যারিটির প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে ক্যালেন্ডারের ছবির জন্য এই ছবিটা তোলা হয়েছিল। ইয়ামালের পরিবার ইউনিসেফের একটা লটারি জিতে অংশ নিয়েছিল সেই প্রোগ্রামে। বহু বছর পর যে ছবি প্রকাশ করেন ইয়ামালের বাবা। তখন কি আর জানতেন, তাঁর সেই ছেলেকেই একদিন মেসির সঙ্গে তুলনা করা হবে!

ইয়ামাল অবশ্য এই বয়সেই বেশ পরিণত। বলেছেন, ‘আমি মেসি না, ইয়ামাল হতে চাই।’

মেসি অবশ্য চাইলেই হওয়া যায় না। লা মাসিয়ার মেসি থেকে সর্বজয়ী মেসি হতে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিকে ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৭ বছর বয়সী ইয়ামাল এরই মধ্যে বার্সার হয়ে লা লিগা, স্পেনের হয়ে ইউরো জিতেছেন। সামনে দীর্ঘ ক্যারিয়ার, অফুরন্ত সম্ভাবনা। মেসি-রোনালদোরা শেষের পথে, এখন সময় এমবাপ্পে, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, জুড বেলিংহামদের। তাঁদের ছাড়িয়ে যেতে হলেও পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। তারপর হয়তো মেসি হওয়ার সুযোগ আসবে, কিংবা ‘ইয়ামাল’ হওয়ারও।