ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা
ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা

ইতিহাদে গার্দিওলার ‘স্বপ্নের দল’

‘আপনি তো বলতে পারবেন না, আপনার ছেলে বেশি ভালো নাকি মেয়ে।’

কথাটা মাসখানেক আগের। তখনো লিগ জয়ের লড়াইয়ে ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে দৌড়াচ্ছে আর্সেনাল। চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হওয়াও বাকি। দুটি বড় শিরোপার সম্ভাবনা যখন ‘ফিফটি-ফিফটি’, সেই সময়ে এক সংবাদ সম্মেলনে উঠেছিল প্রশ্নটা। স্পেন, জার্মানি নাকি ইংল্যান্ড-কোন দেশে কোন ট্রফিটা জেতা বেশি কষ্টকর ছিল?

ম্যানচেস্টার সিটি কোচের চেয়ারে বসা পেপ গার্দিওলার জবাবে ছিল দার্শনিক ওই মন্তব্য, ‘আপনি তো বলতে পারবেন না, আপনার ছেলে বেশি ভালো নাকি মেয়ে।’ সব ট্রফি জয়ের পথেই চ্যালেঞ্জ থাকে, বাধাবিপত্তি থাকে। তাই বলে একটা আরেকটার চেয়ে বেশি কঠিন বা সহজ হয়ে যায় না। যেমনটা একজন বাবার চোখে এক সন্তানের তুলনায় অন্যজন বেশি ভালো হয় না।

একেকটা ট্রফিকে সন্তানসম চোখে দেখা গার্দিওলা শনিবার পেয়েছেন ১১তম লিগ ট্রফি জয়ের সুখবর। এদিন ম্যানচেস্টার সিটির ম্যাচ ছিল না। প্রিমিয়ার লিগ পয়েন্ট তালিকার দুইয়ে থাকা আর্সেনাল খেলতে নেমেছিল নটিংহাম ফরেস্টের মাঠে। ম্যাচে মিকেল আরতেতার দল ১-০ ব্যবধানে হেরে গেলে ৩ ম্যাচ বাকি থাকতেই লিগের শীর্ষ স্থান নিশ্চিত হয়ে যায় সিটির। নিশ্চিত হয় টানা তৃতীয় প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা। গার্দিওলার অধীনে সর্বশেষ ছয় বছরের মধ্যে পঞ্চম!

এখানেই শেষ নয়। ২০২২-২৩ মৌসুম গার্দিওলার জন্য হয়ে উঠতে পারে ‘ট্রফি-প্রসবা’। হাতে এখনো এফএ কাপ ও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল বাকি। ৩ জুন ওয়েম্বলিতে প্রতিপক্ষ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ১০ জুনের ইস্তাম্বুলে ইন্টার মিলান।

ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ও ইউরোপ-শ্রেষ্ঠত্বের লিগ দুটিতে জিতলে গার্দিওলা ছুঁয়ে ফেলবেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে। কিংবদন্তি এই কোচের অধীনে ১৯৯৯ সালে ট্রেবল জিতেছিল ইউনাইটেড। দুই যুগ পর একই কীর্তির সুযোগ এখন গার্দিওলার সিটির সামনে।

প্রিমিয়ার লিগ ট্রফি হাতে পেপ গার্দিওলা

ইউরোপীয় ফুটবলে এক মৌসুমে মহাদেশীয় ট্রফিসহ ট্রেবল জেতার কীর্তি আছে মাত্র ৯টি দলের। এর মধ্যে ইংল্যান্ডে ইউনাইটেড ছাড়া অন্য কোনো দলের এই কীর্তি নেই। দুইবার ট্রেবল জয়ের রেকর্ড নেই কোনো কোচেরই। ২০০৮-০৯ মৌসুমে বার্সেলোনাকে ট্রেবল জেতানো গার্দিওলার সামনে এখন দুটি রেকর্ডেই নাম লেখানোর হাতছানি। যা শুধু গার্দিওলার নিজের অর্জনের ঝুলিকেই সমৃদ্ধ করবে না, এই ম্যানচেস্টার সিটিও নাম লেখাবে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ‘ড্রিম টিমে’।

খেলোয়াড়ি জীবনে একটি ‘স্বপ্নের দলে’রই অংশ ছিলেন গার্দিওলা। ছিলেন নব্বই দশকে ইয়োহান ক্রুইফের বার্সেলোনা ড্রিম টিমে। সেই দলটির উত্তরাধিকার কত বেশি বহন করেন, তা বোঝাতে গিয়ে ২০০৮-০৯ মৌসুমে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে ট্রেবল জয়ের সময় গার্দিওলা বলেছিলেন, ‘আমরা ড্রিম টিমের সন্তান। শুধু ওই দলটাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করছি।’

গার্দিওলা তখন চার মৌসুম কাটিয়েছেন বার্সেলোনায়। সাফল্যের বিচারে ছাড়িয়ে গেছেন ক্রুইফের সেই ড্রিম টিমকেও। তাঁর অধীনে ৩টি লিগ আর ২টি চ্যাম্পিয়নস লিগসহ মোট ১৪টি ট্রফি জিতেছিল বার্সেলোনা। এক বছর বিরতি দিয়ে গার্দিওলার পরের গন্তব্য ছিল বায়ার্ন মিউনিখ। জার্মান ক্লাবটিতে তিন বছর থেকে প্রতিবারই জিতেছেন বুন্দেসলিগা, একবার করে জেতেন ক্লাব বিশ্বকাপ আর উয়েফা সুপার কাপ ট্রফিও।

বার্সেলোনা, বায়ার্নে ৩টি করে লিগ জেতার কীর্তিটা গার্দিওলা প্রিমিয়ার লিগে তুলে নিয়েছেন অন্য উচ্চতায়। ইতিহাদে এ নিয়ে ষষ্ঠ মৌসুম চলছে তাঁর। মাঝে ২০২০ সালে লিভারপুলের ‘ক্ষণিক উত্থান’ বাদ দিলে পুরোটা সময় রাজত্ব চলছে গার্দিওলারই। যে রাজত্বের রত্নভান্ডারে সবশেষ সংযোজন প্রিমিয়ার লিগের পঞ্চম ট্রফি। প্রায় দেড় শ বছর বয়সী ম্যানচেস্টার সিটির ইতিহাসে ৯ লিগ শিরোপার মধ্যে ৫টি এনে দিয়ে এরই মধ্যে ক্লাব ইতিহাসে ‘লিগ্যাসি’ রেখে দিয়েছেন গার্দিওলা।

ইতিহাদ স্টেডিয়ামের বাইরে গার্দিওলার ম্যুরাল

বার্সেলোনা যদি ক্রুইফের আয়নায় সেজে থাকে, আগামীর ম্যানচেস্টার সিটি সাজবে গার্দিওলার আয়নায়। গার্দিওলার আদর্শ যদি হয় ক্রুইফের সেই স্বপ্নের দল, সিটির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কোচদের বেঞ্চমার্ক হতে পারে গার্দিওলার এই স্বপ্নের দল।
যে স্বপ্নের দল পূর্ণতা পাবে এই মৌসুমের বাকি দুটি ট্রফি জিতলে। হয়তো পাবে অমরত্বও!