নেদারল্যান্ডসের ডিফেন্ডার ভার্জিল ফন ডাইক
নেদারল্যান্ডসের ডিফেন্ডার ভার্জিল ফন ডাইক

ফন ডাইকের নেতৃত্বেই তবে ডাচ-পুনরুত্থান

১৯৭৪, ১৯৭৮, ২০১০—তিনটি ফাইনাল, তিনবারই হার। নেদারল্যান্ডসের বিশ্বকাপ জিততে না পারা ফুটবলের দুঃখগাথাগুলোরই একটি। ‘টোটাল ফুটবলের’ জনকদের এই অপ্রাপ্তি যুগের পর যুগ বয়ে নিতে বেড়াতে হচ্ছে। চিরতারুণ্যের প্রতীক কমলা তাই ফুটবলে বেদনার রং হয়ে গেছে।

রাইনাস মিশেলসের মস্তিষ্কপ্রসূত, ইয়োহান ক্রুইফ ও তাঁর সতীর্থদের বাস্তবায়িত ‘টোটাল ফুটবলকে’ অনেকখানি পরিমার্জন করে নতুন কাঠামোয় দাঁড় করিয়েছেন আরিয়েন রোবেন–ওয়েসলি স্নাইডার–রবিন ফন পার্সিরা। খুব কাছে গিয়েওছিলেন। কিন্তু শেষটা রাঙাতে পারেননি।

এরপর ডাচ ফুটবলের ক্রান্তিকাল। সেটা এতটাই যে ২০১৬ ইউরো ও ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি দলটি।

দুঃসময় পেছনে ফেলে দ্রুত অবশ্য ঘুরিয়ে দাঁড়িয়েছে নেদারল্যান্ডস। আট বছরের বিরতি দিয়ে ফিরেছে বিশ্বমঞ্চে। এবার কী হবে? কাতারে কি ১৮ ডিসেম্বর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই শেষে পত পত করে উড়বে কমলা কেতন? ভার্জিল ফন ডাইকের নেতৃত্বে হবে কি ডাচ–পুনরুত্থান? উত্তরটা আপাতত সময়ের হাতেই তুলে রাখতে হচ্ছে।

তবে সাফল্যের শিখরে উঠতে গেলে যেভাবে সিঁড়ি বাইতে হয়, নেদারল্যান্ডসের আজ সেটারই প্রথম ধাপ। দোহার আল তুমামা স্টেডিয়ামে রাত ১০টায় ফন ডাইকদের প্রতিপক্ষ সেনেগাল।

যুগে যুগে অনেক রথী–মহারথীর জন্ম দিয়েছে নেদারল্যান্ডস। এবারের দলেও তারকার কমতি নেই। তবু কথায় কথায় কেন ফন ডাইকের নাম নেওয়া? কারণ, ডাচ অধিনায়ক যে পাথরেও ফুল ফোটাতে জানেন! জোড়াতালি দেওয়া দলটাকে এক সুতোয় গেঁথে ইস্পাতদৃঢ় মনোবল গড়ে তোলার কারিগর তো তিনিই। বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডারের ওপর তাই চোখ বন্ধ করে ভরসা রাখছেন নেদারল্যান্ডস সমর্থকেরা। তাঁর নেতৃত্বেই ২০১৯ উয়েফা নেশনস ফাইনালে খেলেছে ডাচরা।

আস্থার প্রতিদান তো সেই শুরু থেকেই দিয়ে আসছেন ফন ডাইক। ক্লাব হোক কিংবা জাতীয় দল—দুই ক্ষেত্রেই তিনি নিবেদিতপ্রাণ। ২০১৮ সালের হাড়–কাঁপানো শীতে সাউদাম্পটন থেকে লিভারপুলে আসেন ফন ডাইক। তবে অভিষেকেই কাঁপিয়ে দেন এভারটনকে। এফএ কাপের ম্যাচটিতে তাঁর শেষ মুহূর্তের গোলেই ‘মার্সিসাইড ডার্বি’ জেতে লিভারপুল। একজন ডিফেন্ডারকে এনে অলরেডদের কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ যেন ‘পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ’ পেয়ে যান!

কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে অনুশীলনে নেদারল্যান্ডস ফুটবলাররা

রক্ষণ তো সামলানই, দলের প্রয়োজনে আক্রমণেও উঠে গিয়ে গোল করে আসেন। পরিসংখ্যানও সে কথাই বলছে। লিভারপুলের হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২০২ ম্যাচ খেলেছেন ফন ডাইক। গোল করেছেন ১৭টি। তিনি গোল করেছেন, এমন সব ম্যাচেই জিতেছে লিভারপুল! নেদারল্যান্ডসের জন্যও তিনি ‘সৌভাগ্যের দূত’। যে ৬টি গোল করেছেন, তার কোনোটিতেও হারেনি ডাচরা।

তবে ওপরে উঠে গিয়ে গোল করে আসার দায়িত্বটা পালন করতে গিয়েই ফন ডাইকের ক্যারিয়ারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। এভারটনের বিপক্ষে সেই ‘মার্সিসাইড ডার্বিতে’।

২০২০ সালে ১৭ অক্টোবর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচের তখন ৬ মিনিট। হুট করে নিজেদের বক্সে ফন ডাইকের হাঁটুতে পাগলাটে এক ট্যাকল করে বসেন এভারটনের ইংলিশ গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ড। ক্রাচে ভর দিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে। স্ক্যান রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর জানা যায়, হাঁটুর সংযোগস্থল ছিঁড়ে গেছে! এরপর যা হওয়ার তাই। মৌসুমটাই শেষ হয়ে যায় ফন ডাইকের।

সেই চোট থেকে পুরোপুরি সেরে না ওঠায় গত বছর ইউরোতেও খেলতে পারেননি। সেই দুঃস্মৃতির আগে লিভারপুলের হয়ে জিতেছিলেন চারটি শিরোপা। মাঠে ফেরার পর জিতেছেন আরও তিনটি। ক্লাবটির হয়ে সম্ভাব্য সবকিছুই জিতেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো বৃহৎ মঞ্চে খেলার স্বাদ আগে নেওয়া হয়নি। সেই অপেক্ষা ফুরাচ্ছে আজ, ৩১ বছর বয়সে।

নিজের প্রথম বিশ্বকাপে খেলতে নামার আগে ফন ডাইক বলেছেন, ‘নিজেদের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, আত্মবিশ্বাসী থাকতে হবে।’

লুই ফন গাল অবসর ভেঙে কোচের দায়িত্বে ফেরার পর ভোজবাজির মতো পাল্টে গেছে ডাচ ফুটবল। টানা ১৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার তৃপ্তি নিয়েই কাতারে এসেছে ইউরোপের দলটি। মূত্রথলির ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েও নিজের দায়িত্ব থেকে দূরে থাকেননি ফন গাল। শিষ্যদের খেলায় যাতে প্রভাব না পড়ে, তাই গোপনে চিকিৎসা নিয়েছেন। ২৫ বার সইতে হয়েছে রেডিওথেরাপির ধকল। এর মধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। তবু হুইলচেয়ারে বসেই কোচিং করিয়েছেন।

এমন এক নিবেদিত মানুষকে নিয়ে অধিনায়ক ফন ডাইক বলেছেন, ‘আমরা একজন অসাধারণ, অভিজ্ঞ মানুষকে কোচ হিসেবে পেয়েছি। নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতেই পারি।’

দলের গভীরতা নিয়ে ফন ডাইকের ভাষ্য, ‘আমাদের দলটা অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারুণ্যের মিশেলে গড়া। সবচেয়ে বড় কথা, সবাই যথেষ্ট উদ্দীপ্ত ও তেজি। এটাই আমাদের সাফল্যের চাবিকাঠি। সবাই বিশ্বের সেরা ক্লাবগুলোতে খেলে। শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবল খেলে আমরা অভ্যস্ত।’

প্রতিপক্ষ সেনেগালকে নিয়ে বেশি কিছু বলেননি। তবে আক্ষেপ করেছেন বন্ধু সাদিও মানের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়া নিয়ে। লিভারপুলে তাঁরা যে একসময়কার সতীর্থ ছিলেন, ‘ওরা আফ্রিকার চ্যাম্পিয়ন। নিঃসন্দেহে বড় ম্যাচ হতে চলেছে। সাদিওকে (মানে) ভীষণ মিস করব। চোটের কারণে দেশের হয়ে বড় টুর্নামেন্ট খেলতে না পারার কষ্ট আমি বুঝি।’

ফন ডাইক ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম কাটিয়েছেন ২০১৯–২০ সালে। সে মৌসুমে তাঁকে ড্রিবল করে কেউ বোকা বানাতে পারেননি। এবারও কি সে পথেই হাঁটছেন?

পেশাদার ফুটবলারদের বৈশ্বিক সংগঠন ফিফপ্রোর এক প্রতিবেদনে বলছে, গত বছরের ১২ জুলাই থেকে এ বছরের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ৭ হাজার ৫৯৭ মিনিট খেলেছেন ফন ডাইক! এই সংখ্যাগুলোই বলে দেয় ডাচ অধিনায়ক শুধু মানব নন, যন্ত্রমানব। এবার সেই যান্ত্রিক দক্ষতা বিশ্বকাপে দেখানোর পালা।