আর্জেন্টিনার অনুশীলনে রদ্রিগো ডি পল (মাঝে), পাপু গোমেজ ও মেসি
আর্জেন্টিনার অনুশীলনে রদ্রিগো ডি পল (মাঝে), পাপু গোমেজ ও মেসি

আর্জেন্টিনার আরেকটি ‘ফাইনাল’

সেই কৈশোরকাল থেকেই আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের তুমুল সমর্থক। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে মারিও কেম্পেসের প্রতিটি গোল এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারেন। প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের পথে আর্জেন্টিনার প্রতিটি ম্যাচ, প্রতিটি মুহূর্তও। এটা এমন ঘটা করে বলার মতো কিছু হতো না, যদি আর্জেন্টিনার সমর্থক এই ভদ্রলোক পোল্যান্ড দলের কোচ না হতেন!

নামটা খটোমটো। বেশ বড়ও। সেসওয়াফ মিখনিয়েভিৎস। মিখনিয়েভিৎসের আর্জেন্টিনা-প্রেম আলোচনাতেই আসত না, যদি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার গ্রুপ পর্ব পেরোনোর পথে তাঁর দল বাধা হয়ে না দাঁড়াত। সৌদি আরবের কাছে বিশ্বকাপ–কাঁপানো ওই পরাজয়ের পর মেক্সিকোর বিপক্ষে জয় আর্জেন্টিনাকে একটা লাইফলাইন দিয়েছে সত্যি, কিন্তু পোল্যান্ডের বিপক্ষে আজকের ম্যাচেও তো নামতে হচ্ছে সেই একই শঙ্কা নিয়ে। হেরে গেলেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায়।

ফ্রান্স, ব্রাজিল, পর্তুগালের জন্য গ্রুপের তৃতীয় ম্যাচটা শুধুই নিয়ম রক্ষার ম্যাচ। অন্য খেলোয়াড়দের একটু বাজিয়ে দেখার সুযোগও। সেখানে আর্জেন্টিনার জন্য প্রতিটি ম্যাচই ‌‘ফাইনাল’। এমন একটা পরিস্থিতিতে প্রিয় দলের মুখোমুখি হতে পেরে সেসওয়াফ মিখনিয়েভিৎসকে খুবই আনন্দিত বলে মনে হলো। ‘হ্যাঁ, আমি ছোটবেলা থেকেই আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থক। তার মানে এই নয় যে ওদের হারিয়ে দেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ব না। মেক্সিকোর যে কোচ (টাটা মার্টিনো) আছে, সে তো আর্জেন্টাইনই। সে-ও কি পরের রাউন্ডে যেতে চাইছে না?’ এক সাংবাদিক তাঁর আর্জেন্টিনা-প্রেমের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার পর হাসতে হাসতে পাল্টা প্রশ্ন করলেন পোলিশ কোচ।

পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি জিততে চায় আর্জেন্টিনা

২ ম্যাচে ৪ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপের শীর্ষে পোল্যান্ড। শেষ ষোলোতে যেতে আজ ড্র করলেই চলে। মনে যা-ই থাক, মুখে মিখনিয়েভিৎস দাবি করলেন, ওই চিন্তা মাথাতেই আনছেন না, ‌‘মাঠে নামার পর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। তবে এটা জানি, আর্জেন্টিনার সঙ্গে ড্র করার লক্ষ্য নিয়ে নামলে হারতে হবে। বিশেষ করে ওদের যেখানে জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই।‌’

জিতলে আর কোনো কিছু ভাবতে হবে না। ড্র করলেও সম্ভাবনা থাকবে। তবে আর্জেন্টিনাকে তখন তাকিয়ে থাকতে হবে মেক্সিকো-সৌদি আরব ম্যাচের দিকে। ড্র করে পরের রাউন্ডে ওঠার আরেকটি ভীতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। গ্রুপ রানার্সআপ হিসেবে শেষ ষোলোতে খেলতে হবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের সঙ্গে। গত বিশ্বকাপেও তা-ই হয়েছিল। ম্যাচটা ফুটবলপ্রেমীদের মন ভরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এ কারণে তা মনে রেখেছে শুধু ফ্রান্সই। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ যে শেষ হয়ে গিয়েছিল সেখানেই।

আপাতত শুধু পোল্যান্ড ম্যাচ নিয়েই ভাবছে আর্জেন্টিনা

লিওনেল স্কালোনি এখনই এসব নিয়ে ভাবতে চাইবেন না স্বাভাবিক। পরের রাউন্ডে উঠতেই যেখানে জান বেরিয়ে যাচ্ছে, সেখানে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ নিয়ে ভাবার বিলাসিতা কোথায়! আরেকটা দর্শনেও প্রবল বিশ্বাস আর্জেন্টিনার তরুণ কোচের। অতীতে কী হয়েছে, ভুলে যাও। বেশি দূরে ভাবতে যেয়ো না। বর্তমানে থাকো। এই যে পোল্যান্ডের বিপক্ষে অগ্নিপরীক্ষা, তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারে এটাই কি সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ? প্রশ্নটা শুনে ওই সাংবাদিকের দিকে যেন অগ্নিদৃষ্টিই হানলেন, ‌‘আমি কি আগেও বলিনি, আমার কাছে সব সময় সেই ম্যাচই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেটি আমরা খেলতে যাচ্ছি।‌’

জিততে হলে গোল করতেই হবে। আর্জেন্টিনার জন্য এই তথ্য তাই মোটেই প্রীতিকর নয় যে পোল্যান্ড এখনো এই বিশ্বকাপে কোনো গোল খায়নি। গোল খায়নি বলে খাবে না, এমন কোনো কথা তো নেই। আর আর্জেন্টিনা গোল করলে সেই গোল কার পা থেকে আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, এটা বলতে খুব বেশি ফুটবল বুঝতে হয় না। পোলিশ কোচের ক্ষেত্রে অবশ্য এটা সম্ভাবনা নয়, শঙ্কা। মেক্সিকোর বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ম্যাচটার কথা এনে বললেন, ‌‘মেক্সিকো কিন্তু আর্জেন্টিনাকে খুব বেশি সুযোগ তৈরি করতে দেয়নি। তবে মেসি যখন দলে থাকে, বড় কোনো সুযোগ তৈরি না করলেও চলে।‌’

গোলের জন্য মেসির দিকে তাকিয়ে থাকবে আর্জেন্টিনা

সেদিন মেসির গোলটাই এর বড় প্রমাণ। ম্যাচটা গ্যালারিতে বসেই দেখেছেন মিখনিয়েভিৎস। মেসির গোলের পর লুসাইল স্টেডিয়ামের আবহটা কেমন হয়েছিল, সেটির সবিস্তার বর্ণনাও দিলেন। পাশে বসা এক আর্জেন্টাইন কিশোর আনন্দে তাঁকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল যে সেই আবেগ ছুঁয়ে গিয়েছিল মিখনিয়েভিৎসকেও, ‌‘ছেলেটা আমাকে এমনভাবে আলিঙ্গন করল যেন আমি ওর বাবা।’

এমন মুহূর্ত যেন না আসে, সেই পরিকল্পনাতেই অবশ্য গত কয়েক দিন কেটেছে পোলিশ কোচের। যদিও শুরুতেই বলে নিলেন, ‌‘মেসিকে আটকানোর পথ তো অনেক বছর খুঁজে মরছে সবাই। কেউ কি তা খুঁজে পেয়েছে?’

আর্জেন্টিনা দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে, দুটি আন্তর্জাতিক ট্রফি জিতে এই বিশ্বকাপে এসেছে অন্যতম ফেবারিট হিসেবে। বিশ্বকাপে পোল্যান্ডের সেরা সাফল্য বলতে যেখানে ১৯৭৪ ও ১৯৮২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা। রবার্ট লেভানডফস্কির এই পোল্যান্ড দল অবশ্য পোলিশ ফুটবলের সেই স্বর্ণযুগকে একটু হলেও মনে করিয়ে দিচ্ছে। যদিও বিশ্বকাপ আর ইউরো মিলিয়ে প্রথমবারের মতো টানা চারটি বড় টুর্নামেন্টে কোয়ালিফাই করার পরও কেন যেন ‌‘সোনালি প্রজন্ম’ হিসেবে তেমন হাঁকডাক নেই। লেভানডফস্কিদের যা বয়স, তাতে বড় কিছু করার শেষ সুযোগ এই বিশ্বকাপই। পোলিশ কোচের সঙ্গে দলের যে দুই খেলোয়াড় সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন, তাঁদের কথা শুনে মনে হলো, এটাকে চাপের বদলে প্রেরণা হিসেবেই নিয়েছেন তাঁরা। আর্জেন্টিনার জন্য পরীক্ষাটা তাই মেক্সিকো ম্যাচের চেয়েও হয়তো বড়। স্কালোনিও তো বারবার মনে করিয়ে দিলেন, পোল্যান্ড বিপজ্জনক দল। শুধু শূন্যেই নয়, বল পায়ে দারুণ কিছু স্কিলফুল খেলোয়াড়ও আছেন এই দলে।

আর্জেন্টিনাকে কি থামাতে পারবেন লেভানডফস্কি

পোল্যান্ডের এই দলের কোনো খেলোয়াড়ের নাম বলতে গেলে কোন নামটা সবার আগে আসে, তা অনুমান করতে পারায় কোনো পুরস্কার নেই। আজকের ম্যাচের অন্য নাম তো আর এমনিতেই ‌‘লিওনেল মেসি বনাম রবার্ট লেভানডফস্কি’ নয়!