বাঁ পাশের ছবিটা ১৯৮৬ সালের। ডিয়েগো ম্যারাডোনার হাতে বিশ্বকাপ। ৩৬ বছর পর ডানের ছবিটার জন্ম দিলেন লিওনেল মেসি
বাঁ পাশের ছবিটা ১৯৮৬ সালের। ডিয়েগো ম্যারাডোনার হাতে বিশ্বকাপ। ৩৬ বছর পর ডানের ছবিটার জন্ম দিলেন লিওনেল মেসি

মেসিকে যে চিঠি লিখতেন ম্যারাডোনা

দুই বছর আগেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। বেঁচে থাকলে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ে নিশ্চয়ই আনন্দে আত্মহারা হতেন তিনিও। ম্যারাডোনার মতো উদ্‌যাপন আর কজনই–বা পারেন! ম্যারাডোনা এখন যেখানে আছেন, সেখান থেকে আর্জেন্টিনার আরেকটি বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক লিওনেল মেসিকে কোনো অভিনন্দনবার্তা পাঠানোর সুযোগ থাকলে, কেমন হতো সেটি? অনুমান করার চেষ্টা করা হয়েছে সেটিই—

প্রিয় লিও,

এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছাবে কি না, জানি না। যদি পেয়ে থাকো, সবার আগে ভালোবাসা নিয়ো।

আকাশি পর্দাটা সরিয়ে এজেইজা চত্বরে তোমাদের উৎসব দেখছি। ইশ্‌! এই মিলনমেলায় যদি আমিও থাকতে পারতাম! জনতার সুরে গলা মিলিয়ে যদি গাইতে পারতাম ‘মুচাচোস’! কদিন আগেও এই গানে তোমরা গেয়েছ, ‘ডিয়েগো, ওই আকাশে দেখি তোমাকে।’ এখন গাইছ, ‘শান্তিতে ঘুমাও ডিয়েগো!’

ঘুমাই কীভাবে লিও! এই মিলনমেলার শেষ রেণুটুকু বাতাসে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত দুই চোখের পাতা এক হবে না। চোখে মায়াঞ্জন মেখে তাকিয়ে আছি তোমাদের পানে, তোমরা যাকে আকাশ বলো, সেই পর্দাটা সরিয়ে। আজ তা আরও আকাশি, আরও গাঢ়—ঠিক তোমাদের মিলনমেলায় আমার মিশে যেতে না পারার গভীর দুঃখবোধের মতো।

প্রিয় লিও, আমার সন্তান, আমার আর্জেন্টিনার সন্তান! খুব ইচ্ছা করছে তোমাকে বুকে টেনে নিই। বুকে বুক মিলিয়ে বলি, বিশ্বকাপ জিতেছ লোকে দেখছে। কিন্তু আমি দেখছি অন্য কিছু। এই বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে আর্জেন্টাইনদের তুমি যেভাবে একসূত্রে গেঁথেছ, ৩৬ বছর আগে একবার এমন দেখা গিয়েছিল। আর দেখিয়েছিলেন আমাদের ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ ইভা পেরন।

বিশ্বকাপ ট্রফিটা সামান্য ধাতুতে গড়া স্বীকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। একটু সোনা-টোনা থাকতে পারে, ফিফা তো! কিন্তু আজকের এই মিলনমেলার মধ্য দিয়ে আর্জেন্টাইনদের মনে যে স্বীকৃতিটুকু তুমি পেলে, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। চে বলছিলেন, দুনিয়াজুড়ে বিপ্লবের চাষাবাদ করেও জন্মভূমি রোজারিওতে তিনি সব সময় প্রাপ্য মর্যাদাটুকু পাননি। তুমি সেই রোজারিওরই সন্তান। তুমি পেরেছ লিও, তুমিই পারো!

ম্যারাডোনার জন্মস্থান ভিলা ফিওরিতোয় মেসি ও তাঁর দেয়ালচিত্র

ওই যে দেখো, লোকে তোমার নামে গান ধরেছে। এই গান অমর, অক্ষয়, অজর। আজকের পর থেকে তুমি যখনই রোজারিও কিংবা বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় বের হবে, সবার চোখেমুখে এক পরম তৃপ্তির ছবি দেখবে। ওটাই আসল বিশ্বকাপ লিও, ওটাই আসল বিজয়!

শুধু আর্জেন্টিনা কেন, পুবের ওই দেশটারও খোঁজ নিয়ো। আমি এখান থেকে সব দেখতে পাই। তোমার হাতে বিশ্বকাপ দেখার অপেক্ষায় ছিল ওরাও। ৩৬ বছরের অপেক্ষাটা শুধু তোমাদেরই নয়, ওদেরও। হয়তো পুরো পৃথিবীরই। কথাটা ভাবতে গিয়ে খানিক অনুশোচনাও হয়েছে। আমার কারণেই তো লোকে তোমার ওপর প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়েছে। তুমি সেই বোঝা বহন করতে করতে, জন্মভূমিতেই প্রায় ফেরার হয়ে যখন সাফল্যটা পেলে, তখন আমার গর্ব দেখে কে!

মোৎজার্টকে বললাম, বেহালাটা ধরো, আমি সুখের কান্না কাঁদব। সে ফুটবল বোঝে না। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে শুধু বলল, সুরে শেষের কবিতার ছাপ থাকবে কি না? এ–ও বলে দিতে হয়, বলো!

লুসাইলে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের উদ্‌যাপনে এভাবেই সতীর্থ হয়ে ওঠেন মেসি ও ম্যারাডোনা

বিশ্বকাপে নিজের শেষ ম্যাচে তুমি আমারই চাপিয়ে দেওয়া বোঝা নামিয়ে জাতির স্বপ্ন পূরণ করেছ। মাইকেলেঞ্জেলো বলছিল, লুসাইলের মতোই জনতা ভিড় জমিয়েছিল ক্যানভাসে তাঁর শেষ আঁচড় দেখতে। সিসটিন চ্যাপেলের সেই ফ্রেসকোর কথাও বলল। তোমার হাতে বিশ্বকাপের ছবিটা নাকি ওটার চেয়েও সুন্দর!

আমি সরল মানুষ। শিশুর মতো হৃদয়। সব বিশ্বাস করি। শুধু এটুকু বিশ্বাস করি না, আর্জেন্টাইনরা আর ‘নেক্সট ম্যারাডোনা’ খুঁজবে। খোঁজ নিয়ে দেখো, সবাই ‘নেক্সট মেসি’ খুঁজছে। এটাই পরম্পরা লিও, তুমি আমার বুক থেকে এই ভার নামিয়েছ। আমার সমস্ত অনুশোচনা ও দুঃখবোধ মিটিয়ে হালকা করেছ।

তোমাকে ধন্যবাদ, লিও।

আচ্ছা লিও, আমরা কি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ? লোকে বলে, আমি শুধু রক্তে নই, স্বভাব-আচরণেও নিখাদ আর্জেন্টাইন। ভীষণ আবেগপ্রবণ, রক্তেই দ্রোহের বীজ এবং সোজা কথাটা সোজা করেই বলি। কোনো লুকোছাপা নেই।

তুমি তার উল্টো। মনের সব আনন্দ, দুঃখ-বেদনা মনেই রাখো। রোজারিওর পারানা নদীর মতো শান্ত, নিস্তরঙ্গ। লোকে এভাবে আমাদের আলাদা করলেও ভুলে যায়, সেই ‘মুদ্রা’টি কিন্তু আর্জেন্টাইন পেসো। আমরা দুজনই আর্জেন্টাইন; সে তুমি ১৩ বছর বয়সে দেশ ছেড়ে যে ‘জাহান্নামে’ গিয়ে থাকো, এমনকি ফুটবলের প্রসঙ্গও ছাড়ো—শুধু শৈশবের প্রেমকে পরিণতি দেওয়ার জন্যও তুমি আর্জেন্টাইন। প্রতিশ্রুতি রেখেছ, যেভাবে অনুচ্চারে জাতিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও রাখলে!

আর্জেন্টিনার পতাকায় মেসি ও ম্যারাডোনা

আমিও রেখেছি। কিন্তু আমি তোমার মতো ছিলাম না। আমার বিশ্বাসে ছিল, ‘লা পেলোতা নো সে মাঞ্চা’—লোকে জীবন নিয়ে যা খুশি করতে পারে। সে জন্য বলের কোনো দায় নেই। বলে কখনো কলঙ্কের দাগ লাগে না। বোকা জুনিয়র্স সমর্থকদের সামনে যেদিন কাঁদতে কাঁদতে ওই কথাটা বলেছিলাম, সেদিন লোকের চোখেমুখে আমি মায়া দেখেছি। ভালোবাসা দেখেছি। কোনো শিরোপায় তার তুলনা হয় না।

তুমিও জনতার এই ভালোবাসার তুলনা পাবে না। কখনো তা খোঁজার চেষ্টাও কোরো না। শুধু অনুভব কোরো লিও, চোখ বুজে শুধু অনুভব করো—আর্জেন্টাইনদের ভালোবাসার প্রকাশ কত প্রগাঢ়, কী মায়া!

লোকে এই মায়ায় ভুলেই তোমাকে নিয়ে নতুন বিতর্ক বাঁধিয়েছে। প্রসঙ্গটা পুরোনো কিন্তু তুমি বিশ্বকাপ জিতে তা জাগিয়ে তুলেছ। কে সর্বকালের সেরা? লোকের এই বিতর্কে কান দিয়ো না, লিও। শুধু নিজের খেলাটা উপভোগ করো। রোজারিওর গলিঘুপচিতে যেভাবে খেলে বড় হয়েছ, সেটাই চালিয়ে যাও। বলে কখনো কলঙ্কের দাগ লাগতে দিয়ো না। ভ্যানগঘ পাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। তাঁর সঙ্গে লোকে নাকি তোমার মুখের মিল পায়। রাবিশ! ওই যে নিষ্পাপ বলটা, সেটাই তোমার মুখের প্রতিচ্ছবি। তুমিই ফুটবল!

লুসাইলে শেষ লড়াইয়ে যেদিন তোমরা নামলে, এখানে আমরা সবাই পর্দা সরিয়ে চেয়েছিলাম। ওপর থেকে স্টেডিয়ামের ভেতরকার আকাশি-সাদা আভার ছটা চোখে লাগতেই আমার আজতেকার কথা মনে পড়েছে। মন পুড়েছে। মাঠে যদি আমিও থাকতে পারতাম! যদি তোমাদের একটু সাহায্য করতে পারতাম! তৃপ্তি পেতাম। এখানে সবকিছুই আছে। শুধু স্পর্শের অনুভূতিটা নেই। মঞ্চে যখন তুমি শিরোপায় চুমু খেলে, আমার মনে হয়েছিল, এটাই পৃথিবীর দীর্ঘতম অপেক্ষার চুমু!

বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমু খাচ্ছেন মেসি

বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমুর অনুভূতিটা কি আগের মতোই আছে, লিও? সেই যে শূন্য এক অনুভূতি, সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে...তারপর হৃদয়ের কোন জ্বালামুখ থেকে যেন ভিসুভিয়াসের লাভার মতো আনন্দের উদ্‌গীরণ ঘটে। জনতার স্রোতে তার কতটুকু বোঝা যায়? সব কোলাহল আর হইহুল্লোড় শেষে যখন তুমি সম্পূর্ণ একা হবে, তখন ভেবে দেখো, এই আনন্দের শিকড় কতটা গভীর!

এই পৃথিবীর প্রথম আর্জেন্টাইন থেকে শেষ যে আসবে, এই পৃথিবীর প্রথম আর্জেন্টিনা সমর্থক থেকে শেষজন হিসেবে যে ভবিষ্যতে দাঁড়াবে আকাশি-সাদা হাতে—সবাই তোমার এই বিজয় মনে রাখবে, লিও।

ইভা পেরন হাত তুলে ডাকছেন। তোমার সম্মানে এখানে আনন্দমিছিল হবে। আমি স্লোগান ধরব। গারিঞ্চা-সক্রেটিসদেরও ডেকেছি। লাতিন ভাইদের মধ্যে আজ আর কোনো ভেদাভেদ নেই। লাতিন আমেরিকায় বিশ্বকাপ ফিরিয়ে সবাইকে এভাবে একসূত্রে গাঁথার অবদানও কিন্তু তোমার, লিও; যেটা আমার মধ্যে ছিল না।

ওখানে থাকতে পেলের সঙ্গে কী বাহাসই না করেছি! পেলেকে বলে দিয়ো, ‘রাজদরবার’ ওকে তুলে আনতে চাইলেও আমি ঠেকিয়ে রেখেছি। লড়ে যাব শেষ পর্যন্ত। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি এ আমার অর্ঘ্য। আর তোমাকে সেই নিখাদ ভালোবাসা, যেটা শুধু বলকেই বেসেছি।

আর্জেন্টিনার এসব প্রজন্ম থেকেই হয়তো বের হয়ে আসবে ভবিষ্যতের মেসি

ভাবছ, আর্জেন্টাইনদের প্রতি কিছু বলছি না কেন? ওহ! বোকা লিও! আমার প্রিয় লিও! এখন ওদের জন্য তুমি আছ। তাই আমি গুণগুণিয়ে গাইছি, ‘ডোন্ট ক্রাই ফর মি আর্জেন্টিনা/ দ্য ট্রুথ ইজ আই নেভার লেফট ইউ...।’

আজ এ পর্যন্তই, লিও। চোখে কী যেন পড়েছে। মোৎজার্টটা কই গেল, ওকে তো বেহালা ধরতে হবে!

ইতি তোমারই, ডিয়েগো।