১৯৫৮ সুইডেন বিশ্বকাপে অভিষেক হয়েছিল ১৭ বছর বয়সী এক ব্রাজিলিয়ান তরুণের। পাঁচ বিশ্বকাপের তিনটিতে ট্রফি জিতে যিনি এখন ফুটবল কিংবদন্তির অংশ। নাম তাঁর এডসন আরান্তে দো নাসিমেন্তো; সবাই যাঁকে চেনেন ‘পেলে’ নামে। পেলের প্রথম বিশ্বকাপে অভিষেক হয়েছিল আর্জেন্টাইন সাংবাদিক এনরিক মাকায়া মারকুয়েজেরও।
পেলে বিশ্বকাপের মাঠ ছেড়েছেন ১৯৭০ সালে। তবে প্রেসবক্সে মারকুয়েজ ‘খেলে’ চলেছেন ৫২ বছর পরও। ১৯৫৮ থেকে ২০২২—৬৪ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় টানা ১৭টি বিশ্বকাপ কাভার করেছেন এই আর্জেন্টাইন সাংবাদিক, বিশ্বকাপ ইতিহাসে কোনো সাংবাদিকের যা সর্বোচ্চ।
কাতার বিশ্বকাপে কাজ করা সাংবাদিকদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৬টি বিশ্বকাপে ছিলেন জার্মানির হার্টমুট শেরজার। উরুগুয়ের জর্জ দা সিলভেইরা কাজ করেছেন ১৫টি বিশ্বকাপে। এই তিনজনের পাশাপাশি অন্তত ৮টি বিশ্বকাপে সংবাদমাধ্যমের হয়ে কাজ করেছেন, এমন ৮২ সাংবাদিককে সম্মাননা দিয়েছে ফিফা। গত পরশু কাতারের দোহায় আয়োজিত অনুষ্ঠানটির যৌথ আয়োজক ছিল ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (এআইপিএস)। ‘জার্নালিস্টস অন দ্য পোডিয়াম’ নামে অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফির মিনি রেপ্লিকা তুলে দেন ব্রাজিলের হয়ে দুটি বিশ্বকাপ জেতা রোনালদো নাজারিও।
কাতারের ভার্চ্যুয়াল স্টেডিয়াম-১-এ আয়োজিত সম্মাননা অনুষ্ঠানটি একপর্যায়ে একাল-সেকালের বিশ্বকাপ স্মৃতিচারণার মঞ্চে রূপ নেয়। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ কাভার করতে আর্জেন্টিনা থেকে সুইডেনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে মারকুয়েজ বলেন, ‘ডিসি-৭ উড়োজাহাজে করে রওনা দিয়েছিলাম।
এরপর জ্বালানি নেওয়ার জন্য ওটা যে কতবার কত জায়গায় থামল, এখন আর নামও মনে নেই।’ উড়োজাহাজের পর বাস আর ফেরিতে চড়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছিলেন ২৩ বছর বয়সী মারকুয়েজ। ওই সময় আর্জেন্টিনার এক রেডিওতে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করতেন তিনি। সুইডেন থেকে দেশে খবর পাঠাতেন টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সাহায্যে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিসহ বিভিন্ন কারণে ১৯৩৮, ১৯৫০ ও ১৯৫৪ বিশ্বকাপে খেলেনি আর্জেন্টিনা। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ফিরে আর্জেন্টাইনরা নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় বলে জানান মারকুয়েজ, ‘বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে নিজেদের আমরা বিশ্বসেরা ভাবতাম।
কিন্তু খেলতে নামার পর আমাদের চোখ খুলে গেল। চেকোস্লোভাকিয়া আমাদের ৬ গোল দিয়ে দিল। যে দলের কখনো নামই শুনিনি, তাদের কাছে এত গোল হজম করতে পারছিলাম না। আমি সিগারেট টানতে শুরু করলাম। অথচ এর তিন বছর আগে আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলাম।’
কাতার বিশ্বকাপ শুরুর দিন ৮৮তম জন্মদিন পালন করা মারকুয়েজ মাঝে টেলিভিশনে কাজ করার পর আবার রেডিও ধারাভাষ্যে ফিরেছেন। এখন কাজ করেন ডি স্পোর্টসে।
১৬ বার বিশ্বকাপ কাভার করা হার্টমুট শেরজার জানান তাঁর ১৯৬৬ বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা। লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ড-জার্মানি ফাইনাল শেষে খেলোয়াড়দের লকার রুমে যাওয়ার স্মৃতিচারণা করেন জার্মান এই সাংবাদিক, ‘লকার রুমে গিয়ে আমি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ওর বয়স তখন ২০ বছর, খুব লাজুক।
জিজ্ঞেস করলাম, ম্যাচটা কেমন খেললে? বলল, ববি চার্লটনকে দেখার দায়িত্ব ছিল। ভালো করেছি। খুবই প্রতিভাবান খেলোয়াড়। এটাই ছিল আমাদের দুজনের মধ্যে প্রথম আলাপ।’ টানা পাঁচ-ছয় দশক ধরে বিশ্বকাপ কাভার করার অভিজ্ঞতায় অনেক ফুটবলারের উত্থান-পতন দেখেছেন বর্ষীয়ান এই সাংবাদিকেরা।
আর্জেন্টাইন ফুটবলের অচেনা বালক থেকে ডিয়েগো ম্যারাডোনার বিশ্বজোড়া খ্যাতি, লাল কার্ডবিহীন বিশ্বকাপ থেকে আঙুল ব্যবধানে অফসাইডে গোল বাতিলের নিয়ম চালু হওয়া—এমন অনেক কিছুই দেখেছেন তাঁরা।
প্রযুক্তির আগমনে সংবাদমাধ্যমের কাজেও বড় পরিবর্তন দেখেছেন বলে জানান উরুগুয়ের সাংবাদিক সিলভেইরা। তিনি বলেন, ‘খেলাটা এখন অনেক বেশি জনপ্রিয়, সাংবাদিকও অনেক বেশি। টুর্নামেন্ট কাভার করার ধরনটাও পাল্টে গেছে। আগে মুখোমুখি বসে কোচ, খেলোয়াড়দের সাক্ষাৎকার নেওয়া যেত, প্রশ্ন করা যেত। এখন সবকিছুই সংবাদ সম্মেলনে ঢুকে গেছে।’