ফুটবলে ব্যক্তিগত অর্জনে যা কিছু সর্বোচ্চ আর মর্যাদার, তার সবই জিতেছিলেন জর্জ উইয়াহ। ব্যালন ডি’অর, ফিফা বর্ষসেরার পাশাপাশি আফ্রিকার মহাদেশীয় সেরার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনবার।
ফুটবল দিয়ে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সেই জর্জ উইয়াহ এখন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট। চার বছর ধরে তিনি দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বমঞ্চে। তবে খেলা ও রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো জর্জের একটা স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেছে। নিজে অনেক উঁচুতে উঠে গেলেও লাইবেরিয়াকে কখনো বিশ্বকাপে নিতে পারেননি। খেলা হয়নি ফুটবল-শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ মঞ্চে।
জর্জ উইয়াহর সেই স্বপ্ন পূরণের মশাল নিয়ে কাতারে দৌড়াচ্ছেন টিমথি উইয়াহ। না, লাইবেরিয়ার জার্সিতে নয়। ২২ বছর বয়সী টিমথি খেলছেন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে। শুধু খেলাই নয়, এরই মধ্যে গ্রুপ পর্বে ওয়েলসের বিপক্ষে গোলও করেছেন টিমথি। আজ তিনি দ্বিতীয় রাউন্ড খেলতে নামবেন নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। এক টিমথি আজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই নন, আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশ লাইবেরিয়া আর স্বপ্ন পূরণ না হওয়া বাবারও প্রতিনিধি।
টিমথির অবশ্য ফ্রান্সের হয়েও খেলার সুযোগ ছিল। খেলতে পারতেন ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের জ্যামাইকার হয়েও। বাবা জর্জ ক্লাব ফুটবল ছাড়েন ২০০১ সালে। এর আগের বছর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জন্ম হয় টিমথির। তাঁর মা জ্যামাইকান। জর্জ উইয়াহ কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জ নামের দল গঠন করে লাইবেরিয়ায় আনুষ্ঠানিক রাজনীতি শুরু করেন ২০০৫ সালে।
তবে টিমথি থেকে যান যুক্তরাষ্ট্রে। বেড়ে ওঠা আর ফুটবলে হাতেখড়িও সেখানে। তবে ১৪ বছর বয়সে তিনি চলে যান পিএসজির যুব একাডেমিতে। সেই থেকে এখনো ফ্রান্সেই আছেন। খেলেন ফরাসি লিগের ক্লাব লিলেতে। একাডেমি ও বয়সভিত্তিক দলে নজর কাড়ার পর তাঁকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশন (এফএফএফ)। আর রক্তের সূত্রে লাইবেরিয়ার হয়ে খেলার সুযোগ তো ছিলই। তবে সব ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রকেই বেছে নেন টিমথি। সিদ্ধান্ত নিতে প্রেসিডেন্ট বাবার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল জানিয়ে টিমথি বলেছিলেন, ‘বাবার চাওয়া ছিল, আমি যেন নিজের খেলাটা খেলি। ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ আমি আমার মতো করেই গড়ি।’
যে পরিবেশে বড় হয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে মিশেছেন, সেখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন টিমথি। ফরাসি ক্লাবে থাকলেও তাই আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলতেন যুক্তরাষ্ট্রের অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে। সেই সূত্রে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডাক পেয়ে যান মূল দলে। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে অভিষেক হয় তাঁর। এরপর এখন পর্যন্ত খেলেছেন ২৬ ম্যাচ। এর মধ্যে ২১ নভেম্বরের ওয়েলস ম্যাচটি বিশেষভাবেই মনে থাকবে টিমথির। এই ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ মঞ্চে অভিষেক হয় তাঁর। যে মঞ্চে খেলার আক্ষেপ নিয়ে দেড় যুগের ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন বাবা জর্জ। সেদিন ৩৬ মিনিটে গোল করে যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়েও দেন টিমথি। যদিও গ্যারেথ বেলের দ্বিতীয়ার্ধের গোলের কারণে ম্যাচটি আর জেতা হয়নি।
তবে ম্যাচ শেষে সেদিন ফুটবল ক্যারিয়ারের বড় এক পুরস্কার পেয়ে যান টিমথি। ম্যাচে নিজের গোল নিয়ে একটি পোস্ট করেছিলেন ইনস্টাগ্রামে। সেই পোস্টের নিচে ‘অভিনন্দন’ জানান কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে। টিমথির জন্য এই অভিনন্দন ছিল একজন ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার, প্রেসিডেন্ট বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজস্বতা পাওয়ার।
স্বপ্ন পূরণের আনন্দময় এই যাত্রায় বাবাকেও কাছে পেয়েছেন টিমথি। যে ম্যাচে ইরানকে হারিয়ে টিমথির দল দ্বিতীয় রাউন্ডে জায়গা করে, সেই ম্যাচের পর যুক্তরাষ্ট্রের লকার রুমে হাজির হন বাবা জর্জ উইয়াহ আর মা ক্লার উইয়াহ। ছেলে এখন নিজের পরিচয়ে পরিচিত, নিজের বলার মতো গল্প তৈরি করতে পেরেছে—এই আনন্দ যে জর্জেরও!