কদিন আগে সৌদি আরবের এল ক্লাসিকোতে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে স্প্যানিশ সুপার কাপের শিরোপা জেতে বার্সেলোনা। সেই ম্যাচের পর বার্সা কোচ জাভি হার্নান্দেজ বলেছিলেন, ‘এটি প্রথম শিরোপা জয়, তবে শেষবার নয়।’ জাভি যে নিজের কথা রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছেন, তা বার্সার সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। লা লিগায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা রিয়াল মাদ্রিদের চেয়ে এখন ৮ পয়েন্টে এগিয়ে আছে বার্সা।
এর মধ্যে ইউরোপা লিগে গতকাল রাতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত ড্র করেছে বার্সা। খেলাতেও ছিল আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক রসদ। সব মিলিয়ে গত কয়েক মৌসুমের মধ্যে এবারই বার্সাকে মাঠের খেলায় অনেক বেশি সংগঠিত দেখাচ্ছে।
তবে মাঠের খেলায় বার্সাকে যতটা গোছানো মনে হচ্ছে, মাঠের বাইরে ঠিক তার বিপরীত। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক বিতর্ক ও বিপদে বিপর্যস্ত বার্সা মাঠের বাইরে রীতিমতো হাঁসফাঁস করেছে, যার সর্বশেষ সংযোজন রেফারিকে টাকা দিয়ে বিপাকে পড়ার ঘটনা।
বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনার আগে ফিরে যাওয়া যাক ২০২১-২২ মৌসুমে। সেবার মৌসুম শুরুর আগেই বড় ধাক্কা। নাটকীয় দলবদলে শেষ মুহূর্তে চুক্তি নবায়ন না করেই লিওনেল মেসিকে বিদায় বলে দেয় বার্সা। মেসির বিদায়ের পর সেই মৌসুমটা বার্সার জন্য ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়ে বার্সার ঠাঁই হয় ইউরোপা লিগে।
সেখান থেকেও ফিরতে হয় শূন্য হাতে। লা লিগার পয়েন্ট তালিকায়ও নিচের দিকে নেমে গিয়েছিল ক্লাবটি। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে সে সময় ১.৩৫ বিলিয়ন ইউরোর ঋণের বোঝায় চাপা পড়েছিল দলটি। মাঠে দলের মৌসুম বাঁচাতে ‘অলৌকিক’ কিছুর সন্ধানে ছিল বার্সা। শেষ পর্যন্ত সেই অলৌকিক কিছু নিয়েই হাজির হন জাভি। নাহ, জাভি সে মৌসুমে কোনো শিরোপা জিততে পারেননি।
তবে বার্সাকে লিগের তলানি থেকে ওপরে তুলে নিয়ে আসেন জাভি। সেই সঙ্গে দলকে বদলে দেওয়ার যে অঙ্গীকার, সেটিও ফুটে উঠতে শুরু করেছিল বার্সার খেলায়। তবে বার্সায় জাভির যাত্রাটা পুরোপুরি মসৃণ বলার সুযোগ নেই। জাভি বার্সার কোচ হিসেবে এরই মধ্যে একটি শিরোপা জিতেছেন, তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্ব থেকে টানা দ্বিতীয়বার বিদায় ঠেকাতে পারেননি এই স্প্যানিশ কিংবদন্তি।
দায়িত্ব নেওয়ার কদিন পরই অবশ্য জাভি বলেছিলেন, ‘প্রত্যাশার চেয়েও কাজটা অনেক কঠিন।’ এমনকি দলের খেলোয়াড়দের সামর্থ্য নিয়েও সে সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন জাভি। এসব পথ পেরিয়ে সাম্প্রতিক অতীতের তুলনায় বার্সার পারফরম্যান্সে এবার যে পরিবর্তন এসেছে, তা চোখে পড়ার মতোই। শুধু মাঠেই নয়, জাভিকে সামলাতে হচ্ছে মাঠের বাইরের নানা চাপও।
গ্রীষ্মের দলবদলের কথা ধরা যাক। খেলোয়াড় দলে টানতে দলবদলে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করে একের পর এক হাই-প্রোফাইল খেলোয়াড় দলে ভেড়ায় বার্সেলোনা। বায়ার্ন মিউনিখ থেকে নিয়ে আসে সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডফস্কিকে। তবে খেলোয়াড় নিবন্ধন করতে গিয়ে রীতিমতো নাকানি খেতে হয়েছিল ক্লাবটিকে। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ অর্থনৈতিক লিভারও কার্যকর করতে হয় বার্সাকে। বার্সার ঝুঁকিপূর্ণ এই দলবদল বড় ধাক্কা খায় চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়ের পর। সে সময় মাঠের ব্যর্থতা বাইরের পরিস্থিতিকে রীতিমতো টালমাটাল করে তুলেছিল।
চ্যাম্পিয়নস লিগের ব্যর্থতা ভুলে অন্য টুর্নামেন্টগুলো দিয়ে নিজেদের রক্ষার চেষ্টায় মনোযোগ দেয় বার্সা। সে লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত তাদের সফল বলাই যায়। তবে মাঠের বাইরের পরিস্থিতি সব সময় যেন উত্তপ্ত। বিশেষ করে আগের সভাপতি জোসে মারিয়া বার্তেমেউর সময়কালের আবর্জনা পরিষ্কারে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে দলটিকে।
কদিন আগে প্রকাশিত এক খবরে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল বার্সাকে। যেখানে বলা হয়, ২০২১ সালে মেসির চুক্তির অঙ্ক ফাঁসের আলোড়ন তোলা ঘটনায় জড়িত ছিলেন বার্সারই সাবেক দুই পরিচালক, যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে চুক্তির অঙ্কটা সংবাদমাধ্যমের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় বড় বিপদে না পড়লেও বিব্রতকর অবস্থায় ঠিকই পড়তে হয় বার্সাকে।
এরপর বার্সা সমস্যায় পড়ে দলের অন্যতম সেরা পারফর্মার গাভিকে নিবন্ধন করতে গিয়ে। যেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল লা লিগার বেঁধে দেওয়া স্কোয়াডের বেতনসীমা নীতি। লা লিগার সভাপতি হাভিয়ের তেবাস ব্যাখ্যা করে জানান, চুক্তিটা একাধিক বছরের হওয়ায় বার্সার মূল স্কোয়াডের বেতনসীমার মধ্যে গাভিকে রাখতে পারবে না বার্সা।
২০২২-২৩ মৌসুমে বার্সার স্কোয়াডের যে বাজেট, তা ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণে মূলত গাভিকে মূল দলে নিবন্ধিত করতে দেয়নি লা লিগা কর্তৃপক্ষ। এরপর আদালতের দ্বারস্থ হয়ে আপিল করেছিল বার্সা। আদালত গাভিকে মূল দলে নিবন্ধিত করার নির্দেশ দেওয়ার পর পথ পরিষ্কার হয় বার্সার। সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান হলেও অর্থনৈতিকভাবে বার্সা হালে পানি পাচ্ছে না। সামনে তাদের বেতন–ভাতা অনেক কমাতে হবে।
যে লক্ষ্য পূরণে ছাড়তে হবে অনেক খেলোয়াড়কেও। এমনকি বার্সার আর কোনো অর্থনৈতিক লিভার কার্যকর করার সুযোগও নাকি বাকি নেই। জানুয়ারির শুরুতে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, আগামী মৌসুমে বার্সার বেতন তাদের বাজেটের চেয়ে ২০০ মিলিয়ন ইউরো বেশি হয়ে যেতে পারে (বার্সা বর্তমানে ৩১৮ মিলিয়ন ইউরো বেতন দিচ্ছে)। তাই উচ্চ বেতনের খেলোয়াড়দের বিক্রি করা ছাড়া এই মুহূর্তে তাদের হাতে আর কোনো বিকল্পও নেই।
বার্সা যখন অর্থনৈতিক ঝড় সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে বার্তেমেউর সময়ে রেফারিকে টাকা দেওয়ার খবর। এই খবর সামনে আসার পর সবার প্রথম প্রশ্ন ছিল, বার্সারও কি তবে জুভেন্টাসের মতো পয়েন্ট কাটা যাবে? কেউ কেউ অবশ্য কয়েক ধাপ এগিয়ে বার্সার অবনমনও দেখে ফেলেছিল। ক্লাবটির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, বার্তেমেউ সভাপতি থাকাকালে পরামর্শের জন্য তৎকালীন লা লিগার রেফারিদের টেকনিক্যাল কমিটির সহসভাপতি জোসে নেগ্রেরিয়াকে ১.৪ মিলিয়ন ইউরো (১৪ লাখ ইউরো) প্রদান করেছে বার্সা।
২০১৬-১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছর ধরে এই অর্থ প্রদান করা হয়। ইউরোপা লিগের প্রস্তুতি থেকে চোখ সরিয়ে বার্সাকে তাৎক্ষণিকভাবে এই ইস্যু নিয়ে বিবৃতি দিতে হয়। যেখানে কোনো ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করে তারা। লা লিগা সভাপতিও অবশ্য বার্সার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন। তবে আদালতে বিচারাধীন থাকায় ভবিষ্যতে যেকোনো কিছু হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেননি তেবাস। বলেছেন, ‘নৈতিকভাবে এবং নান্দনিকভাবে স্প্যানিশ ফুটবলে এটা ঘটতে পারে না।’
বর্তমানে বার্সা চেষ্টা করছে মাঠের খেলায় ঘুরে দাঁড়ানোর। তবে তাদের সে চেষ্টায় বারবার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মাঠের বাইরের নানা ঘটনা, যা নিশ্চিতভাবে খেলার মাঠকেও প্রভাবিত করছে। আর ঐতিহাসিকভাবে বার্সা অন্যায়, স্বৈরাচার ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াকু শক্তি হিসেবে পরিচিত, যা এসব খবরে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বার্সার লড়াইটা এখন শুধু মাঠে ফল পাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি নিজেদের আত্মপরিচয় সমুন্নত রাখার লড়াইও বটে।