‘আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা’—বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় একটি গানের শুরু এটা। গতকাল রাতে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সেই গানের এ লাইনটাই যেন বারবার বিয়োগান্তক গল্প হয়ে ফিরে এসেছে রিয়াল মাদ্রিদের জন্য। লাইনের ফাঁদ পেতেই তো রিয়াল মাদ্রিদকে তাদেরই মাঠে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে বার্সেলোনা। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে তারকাবহুল রিয়ালের ৪–০ গোলের হার, অবিশ্বাস্যই বটে।
ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, কিলিয়ান এমবাপ্পে এবং জুড বেলিংহামকে নিয়ে গড়া আক্রমণভাগকে সময়ের সেরা বলবেন অনেকেই। এই তিনজনের যে কোনো একজনই বিশ্বের শক্তিশালী ডিফেন্স–লাইনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ফলে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে এই ত্রয়ীকে আটকাতে নিজেদের সামর্থ্যের বেশি কিছু করে দেখাতে হয় প্রতিপক্ষ দলগুলোকে। আর খেলাটা যদি হয় রিয়ালের মাঠে, তাহলে এই আক্রমণত্রয়ীকে থামানো তো আরও দুঃসাধ্য। পাশাপাশি এই বাস্তবতাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে বার্সার বর্তমান রক্ষণভাগের বিপরীতে রিয়ালের আক্রমণভাগ নিশ্চিতভাবেই সেরা।
গতকাল রাতে এল ক্লাসিকোয় রিয়ালকে থামাতে তাই অভিনব কিছুই করে দেখাতে হতো হানসি ফ্লিককে। আর ফ্লিক সেটা করেছেন লাইন এলোমেলো করে দিয়ে। চলতি মৌসুমে হাইলাইন ডিফেন্সে খেলিয়ে বার্সাকে একাধিক ম্যাচে সাফল্য এনে দিয়েছেন ফ্লিক। তবে ক্যাম্প ন্যুয়ের দলটিতে আমদানি করা হাইলাইন ডিফেন্স কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে দ্বিধাও ছিল।
বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বশেষ ম্যাচে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে। যদিও সব দুশ্চিন্তা উড়িয়ে সেই ম্যাচে বার্সা জিতেছিল ৪–১ গোলে। এ কারণেই রিয়ালের বিপক্ষে এই কৌশলে দলকে খেলাতে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন ফ্লিক। যদিও বার্সেলোনা সমর্থক তথা আপামর ফুটবলপ্রেমীদের চোখ ছিল রিয়ালের শক্তিশালী আক্রমণভাগের বিপক্ষে ফ্লিক কীভাবে নিজের ডিফেন্ডারদের ব্যবহার করেন, সেদিকে।
গতকালও শুরু থেকে হাইলাইন ডিফেন্সিভ কৌশলের আশ্রয় নেন জার্মান এই কোচ। যা শেষ পর্যন্ত এল ক্লাসিকোয় ফ্লিকের ‘মাস্টারক্লাস’ হিসেবেই লেখা থাকবে৷ বিশেষত প্রথমার্ধে রিয়ালের আক্রমণত্রয়ী যখন গতি আর আগ্রাসনে টগবগ করছিল, তখন ফ্লিকের এই কৌশলেই বারবার হতাশ হতে হয়েছে এমবাপ্পে-ভিনিসিয়ুস–বেলিংহামদের৷ যার ফল ম্যাচে ১২ বার অফসাইডের শিকার হতে হয়েছে রিয়ালকে।
বিপরীতে বার্সাকে রিয়াল অফসাইডের ফাঁদে ফেলতে পেরেছে মাত্র একবার। বিস্মিত হওয়ার মতো পরিসংখ্যানই বটে। তবে রিয়ালের জন্য সবচেয়ে যন্ত্রণার ব্যাপার হচ্ছে, অফসাইডের যে ফাঁদগুলোতে তারা পা দিয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ছিল গোল পাওয়ার মতো। ফ্লিকের তৈরি করা এই ফাঁদে সবচেয়ে বেশি পা দিয়েছেন এমবাপ্পে। এমনকি এমবাপ্পে দুবার বল জালে পাঠিয়ে একবার উদ্যাপনও সেরে ফেলেছিলেন।
কিন্তু ফ্লিকের তৈরি করা ফাঁদে শেষ পর্যন্ত হতাশা নিয়েই থাকতে হয়েছে এই ফরাসি তারকাকে। অফসাইডের কারণে সেই দুটির একটিতেও গোল পাননি ফরাসি স্ট্রাইকার।
এদিন প্রথম গুরুত্বপূর্ণ অফসাইডের ফাঁদে রিয়াল পা দেয় ম্যাচের শুরুতেই। বার্সার পুরো ডিফেন্সলাইন তখন ছিল মাঝমাঠের কাছাকাছি জায়গায়। ডিফেন্ডার পাউ কুবারসির মার্কিংয়ে এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা জায়গা বের করতে পারছিলেন না। বাঁ প্রান্তে জুলস কুন্দের পেছনে ছিলেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র।
এমবাপ্পে–ভিনিসিয়ুস–বেলিংহামদের বিপরীতে এমন একটি কৌশল দাঁড় করানো ছিল রীতিমতো আগুন নিয়ে খেলার মতোই।
ফলে মাঝের জায়গায় ফাঁকায় থাকা এমবাপ্পেকে উদ্দেশ্য করে বল বাড়ান কামাভিঙ্গা। কিন্তু পুরোটাই ছিল বার্সার অফসাইড ফাঁদ। ১৪ মিনিটে বার্সার দুই সেন্টারব্যাকের মাঝে ফাঁকা জায়গা বের করে অপেক্ষায় ছিলেন এমবাপ্পে। কিন্তু এবারও টাইমিংয়ে ভুল করে বসেন। ৫ মিনিট পরও ঘটে একই ঘটনা। এভাবে ম্যাচজুড়ে চলতে থাকে এ ধারা। হাইলাইন ডিফেন্সের সামনে রিয়ালের এই হাঁসফাঁস করার দৃশ্য মনে করিয়ে দিয়েছে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা–সৌদি আরবের ম্যাচটির কথা। সেদিন এভাবেই হাইলাইন ডিফেন্সে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চমক উপহার দিয়েছিল সৌদিরা।
তবে এমবাপ্পে–ভিনিসিয়ুস–বেলিংহামদের বিপরীতে এমন একটি কৌশল দাঁড় করানো ছিল রীতিমতো আগুন নিয়ে খেলার মতোই। কারণ, ফাঁদ এড়াতে পারলে প্রতিপক্ষের গোল বন্যায় ভেসে যাওয়ার শঙ্কাও থাকে। কিন্তু বড় কিছু করতে হলে ঝুঁকি তো নিতেই হয়, ফ্লিকও নিয়েছেন। সেই ঝুঁকির ফল তো সামনেই রাখা আছে। কৌশলের এই ঝুঁকির দিক নিয়ে ফ্লিক নিজেও অবশ্য সচেতন ছিলেন। ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘আমরা ভালোভাবে শুরু করি। প্রথমার্ধে আমরা ভালো খেলেছি। ডিফেন্স অনেক সামনে ছিল। এটা বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। এটা কাজে লেগেছে।’
বার্নাব্যুতে ম্যাচের প্রথম ৪৫ মিনিটে বেশ কিছু কৌশলগত ফাঁকা জায়গা ছেড়ে দিয়ে রিয়ালকে ফাঁদে পা দিতে বাধ্য করেছে বার্সা। বার্সাকে তখন খুব বেশি প্রেসিংও করতে দেখা যায়নি। বরং রিয়ালের আগ্রাসী ফুটবলের বিপরীতে খেলাকে কিছুটা মন্থর করার দিকেই যেন দৃষ্টি ছিল তাদের। পাশাপাশি প্রথম অর্ধে রিয়ালের আক্রমণভাগের আত্মবিশ্বাস গুঁড়িয়ে দেওয়াও ছিল বার্সার আরেকটি লক্ষ্য।
পরের ৪৫ মিনিটে অবশ্য কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনেন ফ্লিক। এই অর্ধে বার্সার প্রতি-আক্রমণগুলো ছিল রীতিমতো ত্রিশূলের ফলার মতো। বিশেষ করে ম্যাচের শেষ ৪০ মিনিটেই বলা যায় রুদ্রমূর্তি নিয়ে হাজির হয় কাতালান পরাশক্তিরা। যার ফলাফল ছন্দে থাকা তিন ফুটবলারই গোল নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন। রবার্ট লেভানডফস্কির জোড়া গোলের পাশাপাশি একটি করে গোল পেয়েছেন লামিনে ইয়ামাল ও রাফিনিয়া। এ ক্ষেত্রে ফ্লিকের প্রথম মাস্টারস্ট্রোক ছিল ফেরমিন লোপেজের জায়গায় ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংকে নিয়ে আসা। ডি ইয়ংকে পেদ্রির কয়েক মিটার সামনে জায়গা করে দিয়ে মাঝমাঠের আধিপত্য নেওয়ার চেষ্টা করেন ফ্লিক।
এই ডাচ মিডফিল্ডারের কারণে অরেলিয়েঁ চুয়ামেনি এবং কামাভিঙ্গারা দ্রুতই নিয়ন্ত্রণ হারান এবং বার্সার আক্রমণগুলো আরও ধারালো হয়ে ওঠে। এ সময় হাইলাইন ডিফেন্সকে খানিকটা নিচেও নামিয়ে আনেন ফ্লিক। ভরসা করেন চিরায়ত গতি ও পাসিংয়ের সমন্বয়ের ওপর। বার্সা এ সময় রিয়ালের ফাঁকা জয়গাগুলোকেও ব্যবহার করে দুর্দান্তভাবে। অন্য দিকে বার্সার বদলে যাওয়া এ কৌশল বুঝে ওঠার আগেই দুই গোল হজম করে বসে রিয়াল। এই দুই গোলেই মূলত শেষ হয়ে যায় ম্যাচ। এই দুই গোলে বার্সার কৌশল যেমন কার্যকরী ছিল, তেমন রিয়ালের রক্ষণেরও দায় ছিল। স্বাগতিকদের চার ডিফেন্ডারদের মধ্যে সংযোগ ছিল না বললেই চলে। লেভার মতো স্কোরারের জন্য এর বেশি আর কী লাগে!
বার্নাব্যুতে বার্সা ও রিয়াল—দুই দলের পারফরম্যান্সকেই অবিশ্বাস্য বলতে হয়। ৯০ মিনিটজুড়ে চেষ্টা করেও ফ্লিকের কৌশলকে ঠেকানোর জন্য কিছুই করতে পারলেন না আনচেলত্তি, বিস্ময়কর! এমনকি ভিনিসিয়ুস-এমবাপ্পেরাও হাজির হতে পারলেন না নিজেদের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জাদু নিয়ে। যেন ফ্লিকের তুকতাকে সব ভুলে গেছেন তাঁরা। অথচ সুযোগ যে একেবারে কম পেয়েছেন, তা–ও নয়।
প্রথমার্ধে বল নিয়ে ঢুকেও ফিনিশিংয়ে ব্যর্থ হন ভিনি। আর দ্বিতীয়ার্ধে এমবাপ্পে একাধিকবার বার্সার ডিফেন্সের ফাঁদ এড়ানোর পরও গোলরক্ষককে ফাঁকি দিতে পারলেন না। এখানে অবশ্য আলাদা করে কৃতিত্ব দিতে হয় বার্সার গোলরক্ষক ইনিয়াকি পেনিয়াকে। মার্ক আন্দ্রে টের-স্টেগেনের চোটের কারণে পাওয়া সুযোগটা দারুণভাবে কাজে লাগানোর নতুন আরেকটা অধ্যায় রচনা করেছেন তিনি।
সব মিলিয়ে ফ্লিক–মাস্টারক্লাসে এই ম্যাচ দিয়ে লা লিগায় ৬ পয়েন্টের লিড নেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যাবর্তনের পতাকাটাও যেন উড়িয়ে দিল বার্সেলোনা। বিশেষত পরপর দুই ম্যাচে দুই ‘চিরশত্রু’ বায়ার্ন ও রিয়ালকে হারিয়ে ইউরোপিয়ান ফুটবলে নিজেদের সুদিন ফেরানোর ঘোষণাটাও কি দিয়ে রাখল না কাতালানরা!