বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে গতকাল। সিলেটে ফিফা প্রীতি ম্যাচে সেশেলসের বিপক্ষে বিরতির পর মাঠে নেমেছেন এলিটা কিংসলি। অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এতে। সেই আনন্দের রেশ নিয়ে নতুন স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছেন এলিটা। স্বপ্নের নাম—বাংলাদেশকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতানো।
নিজের সেই নতুন স্বপ্নের কথা এলিটা বলে দিয়েছেন আজ জাতীয় দলের সঙ্গে অনুশীলনে এসে। সিলেট জেলা স্টেডিয়াম অন্যরা যখন অনুশীলনে নামছেন, তখনই সাংবাদিকদের কাছে আগের রাতে বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেক নিয়ে কথা বললেন তিনি। সেখানেই এসেছে প্রশ্নটা। ২০০৩ সালের পর ‘দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপ’ আর জেতেনি বাংলাদেশ। এরপর ২০০৫ সালে একবারই শুধু ফাইনাল খেলার সুযোগ হয়েছে। ১৭ বছর হলো বাংলাদেশ সাফের গ্রুপ পর্বই পেরোতে পারছে না।
এই যখন অবস্থা, ‘বাংলাদেশি’ হয়ে যাওয়ার পর এলিটা কী ভাবছেন? দেশের মানুষকে কী দিতে চান? এসব প্রশ্নে বলেন, ‘সাফ নিয়েই কোচের (হাভিয়ের কারবেরা) সঙ্গে আমার প্রথম মিটিংটা হয়েছে। তিনি আমাকে বলেছেন, সাফ জিততে হবে। আমি শুধু প্রথমবার সাফ খেলব না (আগামী জুনে ভারতে), আমাদের চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। আমাদের লক্ষ্য শুধু গ্রুপ পেরোনো নয়, চ্যাম্পিয়ন হওয়া।’
নাইজেরিয়ান এই ফুটবলার বাংলাদেশের হয়ে যাওয়ার পর তাঁর কাছে অনেক প্রত্যাশা সবার। সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পারবেন বলে মনে হয়? এলিটার উত্তর, ‘আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য যাঁরা আমাকে সমর্থন করেছেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। আমার দায়িত্ব এখন সবার প্রত্যাশা পূরণ করা। বাংলাদেশের হয়ে ভালো করার বিশাল স্বপ্ন এখন আমার মনে।’
তবে শুরুতেই বলতে ভোলেননি, গত রাতটা তাঁর কেমন আনন্দে কেটেছে। সেই আনন্দে ঘুমাতে পারেননি সারা রাত। তবে সব উচ্ছ্বাস এক পাশে রেখে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এটা গতকালই শেষ। এ নিয়ে আমি আর ভাবতে চাই না। আমি মনে করি, আমার কাজ শেষ হয়নি এখনো। আমাকে নিশ্চিত করতে হবে যে বাংলাদেশের হয়ে যতটা সম্ভব গোল যেন করতে পারি। এটা এখন আমার নতুন স্বপ্নও বলতে পারেন।’
১১ বছর আগে বাংলাদেশে যখন বিয়ে করছিলেন, তখন ভাবতে পারেননি একদিন এ দেশের নাগরিক হয়ে যাবেন, বাংলাদেশের হয়ে খেলা তো দূরের কথা। ‘না, আমি এটা ভাবিনি। আমি এখানে বিয়ে করেছি ২০১২ সালে। তখন ভাবিনি নাগরিকত্ব পেয়ে যাব। আমি কখনোই ভাবিনি যে বাংলাদেশের নাগরিক হব।’ এখনো যেন সবকিছু নিয়ে বিস্মিত এলিটা।
২০১৫ সালে চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে শেখ কামাল টুর্নামেন্ট জিতেছেন। সেই টুর্নামেন্টই আসলে চিনিয়েছে তাঁকে। সেমিফাইনালে দুই গোল করে একাই দলকে ফাইনালে তোলেন। ফাইনালেও গোল করিয়ে ইস্টবেঙ্গলের বিপক্ষে জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। ফাইনাল–সেরা হয়েছিলেন, টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৫ গোলও ছিল তাঁর।
সেই শেখ কামাল টুর্নামেন্টই এলিটার জীবনে এসেছে বাঁকবদল হয়ে। বললেন, ‘ফাইনাল শেষে সেদিন মাঠেই আমি বাংলাদেশের পতাকা জড়াই শরীরে। সেদিন আমার অন্য রকম লেগেছিল। আমার স্ত্রী তখন আমাকে উদ্ধুদ্ধ করেছিল বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে।’
২০১৬ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে ২০২১ সালের মার্চে নাগরিকত্ব পান এলিটা। সে বছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের পাসপোর্টও পেয়েছেন। অক্টোবরে মালেতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রাথমিক দলে কোচ অস্কার ব্রুজোন তাঁকে দলে রাখলেও কাগজপত্রে জটিলতা হতে পারে ভেবে চূড়ান্ত দলে তাঁকে আর রাখা হয়নি। অবশেষে গতকাল এলেন চূড়ান্ত দলে।
সহজ দুটি সুযোগ নষ্ট না করলে অভিষেক ম্যাচে গোলও পেয়ে যেতেন। সেটা নিয়ে হতাশা জানিয়ে এলিটা বলছিলেন, ‘স্ট্রাইকার হিসেবে আমি সব সময়ই গোল করতে চাই। গতকাল আমি দুর্ভাগা ছিলাম। যখন নেটে মারব, তখন বলটা বাউন্স করে। ফলে ঠিকমতো শট নিতে পারিনি। বলটা বাউন্স না করলে হয়তো গোল পেতাম। এ জন্য আমি মাঠটাকে দায়ী করব। মাঠটা আন্তর্জাতিক মানের ছিল না।’
একটু যে স্নায়ুচাপে ভুগছিলেন, বোঝা গেছে সেটাও। এলিটা তা স্বীকার করেও নিলেন, ‘হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। আমি যদি বলি নার্ভাস ছিলাম না, সেটা মিথ্যা বলা হবে। প্রথমবার বাংলাদেশের জার্সি পরে মাঠে নেমেছি। মনে হয়েছে, একটা বিশাল ওজন নিয়ে মাঠে নেমেছি। আর ভেবেছি আমি গোল করব। সুযোগ এসেছিল কিন্তু আমি গোল করতে পারিনি।’
৩৩ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে, সেটা ভালোই জানা তাঁর। ভেবেও রেখেছেন কীভাবে উতরাবেন এই চ্যালেঞ্জ, ‘এটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জ আমার জন্য। বয়স বাড়লে খেলা কঠিন। তবে আমি আমার অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করব। সেটাই করতে হবে আমাকে। বল পায়ে এবং বল ছাড়া দুভাবেই। যখন বল আমার পায়ে থাকবে না, আমাকে রানিং করতে হবে।’
এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে ঢাকা আবাহনীর হয়ে ৮ ম্যাচে এলিটা ৭ গোল করেছেন, হ্যাটট্রিক করেছেন আজমপুর ফুটবল ক্লাব উত্তরার বিপক্ষে। চট্টগ্রাম আবাহনীর বিপক্ষে ৫-১ গোলের জয়ে তাঁর জোড়া গোল। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের বিপক্ষেও গোল আছে। ঘরোয়া ফুটবলের নৈপুণ্যই তাঁকে বাংলাদেশ দলে জায়গা করে দিয়েছে।
আর এতে স্ত্রী ও চতুর্থ শ্রেণিপড়ুয়া একমাত্র কন্যা সাফিরা এলিটা খুব খুশি। দুজনই কাল মাঠে ছিলেন। নাইজেরিয়ায় মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এলিটা। কথা বলেছেন ভাইদের সঙ্গেও। সবাই খুব খুশি। খুশি হওয়ারই কথা। এমন কিছু যে তাঁরাও ভাবতে পারেননি!