‘ভেবে গর্ব হচ্ছে যে, ওয়েম্বলির ফাইনাল হতে চলেছে আমার টানা দশম’—কথাগুলো হুয়ান পেদ্রো আমব্রোনার।
৭২ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ ভদ্রলোককে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের চেনার কথা নয়। স্পেনেরই বা কজন মানুষ তাঁকে চেনেন! রিয়াল মাদ্রিদের এই একনিষ্ঠ সমর্থককে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছে দেশটির ক্রীড়া দৈনিক এএস।
লন্ডনের ঐতিহাসিক ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে আগামী শনিবার রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মুখোমুখি হবে রিয়াল মাদ্রিদ ও বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের শীর্ষ এই প্রতিযোগিতার অবিসংবাদিত রাজা রিয়াল। দলটি এবার ১৫তম বারের মতো ট্রফি উঁচিয়ে ধরার অপেক্ষায়। ১৯৮১ সাল থেকে রিয়ালের সব চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল মাঠে বসে দেখা আমব্রোনা ওয়েম্বলিতে এবারের ফাইনালেও থাকছেন।
১৯৮১ সালের ফাইনাল হয়েছিল প্যারিসে, পিএসজি ঘরের মাঠ পার্ক দে প্রিন্সেসে। তখনকার ২৯ বছর বয়সী যুবক আমব্রোনার সেটিই ছিল মাঠে বসে প্রথম কোনো চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল দেখা। কিন্তু প্রথম অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। শিরোপার লড়াইয়ে লিভারপুলের কাছে ১–০ গোলে হেরে যায় রিয়াল। তবে এরপর রিয়াল যে আটবার ফাইনাল খেলেছে, প্রতিবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। শনিবার ওয়েম্বলির ফাইনালটা হতে যাচ্ছে রিয়ালের ৩২২৪ নম্বর সদস্য আমব্রোনার টানা দশম।
লস ব্লাঙ্কোদের এই পাঁড় ভক্ত ৪৩ বছর ধরে কীভাবে ফাইনালের টিকিটের ব্যবস্থা করছেন, ইউরোপের নানা শহর ঘুরে কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে—সবকিছু নিয়েই এএসের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন।
রিয়াল মাদ্রিদকে অনুসরণ করে আমার দশম ফাইনাল। সামনে ওরা আরও ফাইনালে খেলবে। তবে এটিকে (১০ ফাইনাল মাঠে বসে দেখা) রেকর্ড হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন। এ ব্যাপারে কিছু প্রবীণ কোচ, সাংবাদিক আর অনুরাগীরাই শুধু ভালো বলতে পারবেন। ১৯৮১ সালে প্যারিসের আগে ১৯৬৬ সালেও (ব্রাসেলসে) ফাইনাল খেলেছে রিয়াল। আমার বয়সী যারা ওই ফাইনাল দেখেছে, তখন তারা প্রায় শিশু ছিল।
আগেকার দিনে কাজটা খুব সহজ ছিল। দলের সঙ্গে চলাফেরা করার রেওয়াজ ছিল না। যেমন—১৯৮১ সালে ফাইনালের টিকিট পেতে হলে ক্লাবকে বললেই ব্যবস্থা করে দিত। সে সময় ফাইনাল হতো বুধবার রাতে। আমি কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে প্যারিসে পৌঁছেছিলাম। আমাদের সারা রাত ভ্রমণ করতে হয়েছে। কষ্ট বলতে এটুকুই। এরপর আমরা সহজেই হোটেল পেয়ে যাই।
১৯৯৮ সালে আমস্টারডামের ফাইনাল থেকে পরিস্থিতি বদলে যেতে লাগল। প্রথমবারের মতো লটারির মাধ্যমে টিকিট দেওয়া হলো। সেবার আমাদের কপালে টিকিট জোটেনি। কিন্তু ফুটবল নিয়ে সে সময় মানুষের মধ্যে এখনকার মতো পাগলামি ছিল না, তাই একটি মাধ্যমে যোগাযোগ করে শেষ পর্যন্ত টিকিটের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। আমরা পাঁচ বন্ধু গাড়ি নিয়ে আমস্টারডামের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। প্যারিস হয়েই আমস্টারডামে যেতে–আসতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কেউ একটানা ১০ মিনিটের বেশি গাড়ি চালাতে পারিনি।
এবার আমরা লটারিতে ভাগ্যবান ছিলাম। মাদ্রিদ থেকে প্যারিসের যাত্রাপথ ভালোভাবেই চিনে নিয়েছিলাম। আবারও পাঁচ বন্ধু গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম।
আমরা সেখানে বিমানে গিয়েছিলাম। দিনের বেলা গিয়ে দিনেই ফিরে আসার চেষ্টা করেছি। যেহেতু গন্তব্যের উদ্দেশে আমাদের ভোরে রওনা হতে হয়েছে, তাই দুই রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। এবার জিজ্ঞেস করবেন না, লটারি আমাদের পক্ষে ছিল কি না। আমার সব বন্ধু সেই ফাইনালের টিকিট পায়নি। তবু তারা টিকিটের জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু হতাশ হতে হয়েছে।
এই ফাইনালের আগে আমরা (রিয়াল মাদ্রিদ) খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। ধারাবাহিকভাবে আমরা ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়েছি। আহ, শেষ পর্যন্ত আমরা লিসবনে (২০১৪ ফাইনাল দেখতে) যেতে পারলাম। ফাইনালের টিকিট পেয়েই আমরা বাসে উঠে পড়ি। কিন্তু ফেরার সময়ের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। সীমান্তে ভয়াবহ যানজট লেগেছিল।
আবার টিকিট পেয়েছিলাম। কিন্তু ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে গিয়ে আবারও ভুল করে ফেলি। এবারও দিনের বেলা গিয়েছিলাম এবং বেশ ধকল পোহাতে হয়েছে। যেতে–আসতে এক হাজার ইউরোর বেশি খরচ হয়েছে।
শেষ ষোলো পর্ব শেষেই হোটেল বুকিং করে ফেলি। অথচ কেউ জানতই না, কোন দুটি দল ফাইনাল খেলতে যাচ্ছে। দুই মাস আগেই বুকিং দেওয়ায় লন্ডনের হোটেল ভাড়া বেশ সস্তা ছিল। লন্ডন থেকে আমরা কার্ডিফে গিয়েছিলাম। কার্ডিফ থেকে ফেরার সময় আমরা ‘লন্ডন অ্যাটাকের’ (২০১৭ সালের ৩ জুন লন্ডন ব্রিজে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের হামলা) শিকার হয়েছিলাম। মাদ্রিদ যদি সেবার ফাইনালে না উঠত, তাহলে আমরা হয়তো সব হারাতাম। ফাইনালের দিন সকাল পর্যন্তও আমরা টিকিট পাইনি। ক্লাবের এক পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তিনি ব্যবস্থা করে দেন। কার্ডিফ থেকে ফিরতি যাত্রাটা ছিল বিশৃঙ্খলায় ভরপুর। কারণ, লন্ডনে হামলার পর কর্তৃপক্ষ রেলস্টেশন বন্ধ করে দিয়েছিল। লন্ডনে জরুরি সতর্কতা জারির মধ্যেই আমরা বাসে গিয়েছিলাম। বিমানবন্দরে পৌঁছানো তো দুঃসাহসিক অভিযানের মতো ছিল। ১ মিনিট নয়, মাত্র ১ সেকেন্ডের জন্য আমরা বিমান ধরতে পেরেছিলাম।
আমরা দুই মাস আগে ভিনিসিয়ুসের মাধ্যমে টিকিট কিনেছিলাম। টিকিট খুব সস্তা দামে পেয়েছিলাম। ফেরার পথে ব্রাসেলস হয়ে আসতে হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য চলতেই থাকে। ছেলেরা আবারও মাদ্রিদের জন্য ফাইনাল জিতেছে এবং আমাদের জন্যও।
২০১৯ সালে আমরা ফাইনালে উঠতে পারিনি। তাতে কি, সেবারের ফাইনাল তো মাদ্রিদেই হয়েছে (আতলেতিকো মাদ্রিদের মাঠ ওয়ান্দা মেত্রোপলিতানো)। ২০২০ সালে ফাইনালে উঠতে পারলেও যেতে পারতাম না। কারণ, করোনার কারণে সে বছর রুদ্ধদ্বার স্টেডিয়ামে খেলা হয়েছে। ২০২১ সালেও মহামারির প্রভাব থাকায় খুব বেশি দর্শককে মাঠে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
একদম...। এবার আমরা লিসবন থেকে প্যারিস ফাইনালের টিকিটের ব্যবস্থা করেছি এবং প্রথা অনুযায়ী মাদ্রিদ এবারও আমাদের হতাশ করেনি। টিকিটের জন্য অনেক অনুরোধ এসেছিল। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় ছিল। ক্লাবের আরেকজন পরিচিত ব্যক্তি আমাদের সাহায্য করেছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা সেন্ট ডেনিসে থাকতে পেরেছি।
এভাবেই হয়ে আসছে। লটারি–ভাগ্য আবারও অনুকূলে ছিল। বৃহস্পতিবার (আজ) যাচ্ছি, সোমবার ফিরে আসব। সবকিছুই সস্তায় পেয়েছি। বিমানভাড়া ২৩০ ইউরো, হোটেলভাড়া ২০০ ইউরো, বিমানবন্দরে প্রবেশমূল্য ৭০ ইউরো আর বিমানবন্দরের ট্রেনভাড়া ৩২ ইউরো। সবকিছুই এক মাস আগে কিনে ফেলেছি। এখন শুধু মাদ্রিদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, যারা আমাকে (১৯৮১ সালের পর থেকে) কখনোই হতাশ করেনি।