এই ম্যাচ জিতলেই ফাইনাল। কী অবস্থা দলের—আবেগের সঙ্গেও কি লড়তে হচ্ছে না?
প্রশ্নটা শুনে লিওনেল স্কালোনি হাসেন, ‘প্রথম ম্যাচে হেরে যাওয়ার পর আমাদের জন্য এই বিশ্বকাপে সব ম্যাচই তো এ রকম। পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস...সব ম্যাচই তো আমরা “ফাইনাল” ভেবেই খেলতে নেমেছি।’
এই ম্যাচ জিতলেই ফাইনাল। এটাই কি ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ম্যাচ?
প্রশ্নটা শুনে জ্লাতকো দালিচ বলেন, ‘কাল যদি আমরা জিতি, তাহলে এটাই হবে ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ম্যাচ।’
আপাতত তা ৩ নম্বরে। ক্রোয়েশিয়ান কোচের ক্রমতালিকায় ১ নম্বরে গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানো সেই ম্যাচ। যেটি দুই নম্বরে, সেটিই আজকের সেমিফাইনালটিকে সেই ‘স্বপ্নের ম্যাচ’ হতে দেয়নি। মনে আছে তো, এই সেমিফাইনালই হওয়ার কথা ছিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা!
‘হওয়ার কথা ছিল’ মানে কী? ফুটবলে যা হওয়ার কথা ছিল, তা-ই কি হয় নাকি! হলে কি আর মরক্কো সেমিফাইনাল খেলে! ক্রোয়েশিয়ার সেমিফাইনালে ওঠাটাও তো প্রায় একই রকম। কেন? যে দল গতবার ফাইনালে খেলেছে, সেই দলের সেমিফাইনালে ওঠা নিয়ে বিস্ময়ের কী আছে! কারণ, সেই দল আর এই দল এক নয়। আগের বিশ্বকাপের সেই দলে অনেক পরিবর্তন। ‘নতুন’ এই দল বিশ্বের সেরা আটের মধ্যে জায়গা করে নেওয়াতেই অনেক খুশি ছিল ক্রোয়েশিয়া। ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিনের সেই সংবাদ সম্মেলনের কথা মনে পড়ছে। কোচ জ্লাতকো দালিচের সঙ্গে এসেছিলেন লুকা মদরিচ। দুজনকেই এমন তৃপ্ত দেখাচ্ছিল!
ব্রাজিলের বিপক্ষে জয় ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নের দিগন্তটাকে অনেক বিস্তৃত করে দিয়েছে। ব্রাজিলকে হারিয়ে যখন সেমিফাইনালে উঠতে পেরেছি, আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে ফাইনালে কেন নয়? বিশ্বকাপে দুই দলের সর্বশেষ ম্যাচেই যেখানে বড় জয় আছে!
সেই ম্যাচ গত বিশ্বকাপে। যে ম্যাচের কথা গতকাল একাধিকবার এল দুই দলের সংবাদ সম্মেলনেই। আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। মেসি আর দি মারিয়াকে একদমই নিজেদের রূপে দেখা দিতে দেয়নি। সেই ম্যাচে খেলেছেন ইভান পেরিসিচ, সংবাদ সম্মেলনে যিনি ছিলেন কোচের সঙ্গী। অনুমিতভাবেই পার্থক্যটা বুঝিয়ে দিলেন তিনি। সেটা ছিল গ্রুপ ম্যাচ, এবারের মতো বড় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কোনো ব্যাপার ছিল না। তা ছাড়া মাঝের সময়টায় অনেক কিছু হয়ে গেছে। ওই ম্যাচের কোনো মূল্যই নেই।
আসলেই নেই। তারপরও কোনো ম্যাচের আগে অতীত কোনো ইঙ্গিত দেয় কি না, তা খোঁজার চেষ্টা চলে। সেই অতীত জানাচ্ছে, আর্জেন্টিনা সেমিফাইনালে ওঠা মানেই নিশ্চিত ফাইনাল। সেমিফাইনালে যে কখনোই হারেনি তারা। একবার অবশ্য ফাইনালে উঠেছে সেমিফাইনাল না খেলেই। ১৯৭৮ সালে দেশের মাটিতে আর্জেন্টিনা যেবার প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল, সেবার কোনো সেমিফাইনাল ছিল না। দ্বিতীয় রাউন্ডের সেরা দুই দল খেলেছিল ফাইনালে।
এরই মধ্যে নিজেদের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ক্রোয়েশিয়া এখন আরও বিপজ্জনক। তাদের সবচেয়ে বড় যে শক্তির কথা বারবার বললেন স্কালোনি, তা হলো, ‘ওরা একটা দল হয়ে খেলে।’ সেই ‘দল’ হয়ে খেলাটাকে প্রথাগত কোনো ছকেও ফেলতে পারছেন না আর্জেন্টাইন কোচ, ‘ওরা খুব বেশি রক্ষণাত্মক নয় আবার খুব বেশি আক্রমণাত্মকও নয়। সব সময় একই রকম খেলে যায়।’
এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সব ম্যাচেই ‘দ্বাদশ খেলোয়াড়’ হিসেবে দেখা দিচ্ছে গ্যালারি। প্রতিটি ম্যাচই যেন আর্জেন্টিনার হোম ম্যাচ। যা দেখে অন্য দলগুলোর ঈর্ষা হওয়াই স্বাভাবিক। ক্রোয়েশিয়ান কোচ অবশ্য এটাকেই অন্যভাবে ব্যবহার করতে চাইলেন, ‘আমাদের সমর্থকেরাও খুব আবেগপ্রবণ। কিন্তু ওরা এবার খুব বেশি আসতে পারেনি। স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনার সমর্থকই বেশি থাকবে। চাপটাও তাই ওদের ওপরই বেশি।’ দালিচ যেটিকে ‘চাপ’ বানাতে চাইছেন, স্কালোনি তা থেকেই খুঁজে নিচ্ছেন অনুপ্রেরণা, ‘আমাদের সমর্থকদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। জানি না, এখানে আসতে কত টাকা লাগে। তারপরও ওরা এমন দলে দলে এসেছে। ওদের জন্য, পুরো দেশের জন্য আমরা জিততে চাই।’
স্কালোনিকে যা বলতে হলো না, তা হলো আর্জেন্টিনা জিততে চায় লিওনেল মেসির জন্যও। বলে দিয়েছেন, এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। তবে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়েও এই বিশ্বকাপই শেষ কি না, এটা বলেননি। স্কালোনিও যত দিন সম্ভব মেসিকে উপভোগ করার সুযোগ পাওয়ার আশা জানানো ছাড়া সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারলেন না। নিজের পরিচয় দাঁড়িয়ে যাওয়ায় মেসির ‘নতুন ম্যারাডোনা’ হিসেবে আবির্ভাবের কথা অনেকের হয়তো মনেই থাকে না। ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনা অবশ্য প্রতি পদেই। এই বিশ্বকাপে শুধু খেলা দিয়ে দলকে টেনে নেওয়াতেই নয়, মাঠে আচার–আচরণেও যেন হয়ে উঠছেন ম্যারাডোনার প্রতিচ্ছবি। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালটিই যার বড় উদাহরণ।
এটা কি বলার প্রয়োজন আছে যে সেমিফাইনাল মানেই ফাইনাল—এর রেকর্ড অক্ষুণ্ন রাখতে ‘খুদে জাদুকর’-এর দিকেই তাকিয়ে আর্জেন্টিনা!