লাইপজিগ থেকে লিভারপুলে যাচ্ছেন সোবোসলাই
লাইপজিগ থেকে লিভারপুলে যাচ্ছেন সোবোসলাই

সোবোসলাই—লিভারপুলে হাঙ্গেরিয়ান রোমাঞ্চের সুবাস

গত মৌসুমের শুরু থেকেই মিডফিল্ড-দুর্বলতার কারণে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল লিভারপুল। মৌসুম যতই এগোচ্ছিল ‘অল রেড’ সমর্থকদের হাহাকার ততই বাড়ছিল। জানুয়ারির দলবদলেও একজন মিডফিল্ডারের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন লিভারপুলভক্তরা। কিন্তু অ্যানফিল্ডের টানেল ধরে আর কোনো ত্রাতা লিভারপুলকে উদ্ধার করতে আসেননি। বলা যায়, ক্লাব কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাতেই মিডফিল্ডের দুর্বলতা নিয়ে মৌসুম শেষ করেছে লিভারপুল। যার ফলাফল সেরা চারের বাইরে থেকে মৌসুম শেষ করতে হয়েছে ক্লাবটিকে।

কে জানে হয়তো গত মৌসুমের ব্যর্থতাতে কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে, এবারের দলবদল শুরু হতে না হতেই দুজন মিডফিল্ডারকে দলে ভিড়িয়েছে তারা। প্রথমে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক অ্যালেক্সিস ম্যাক আলিস্টারকে দলে টানে লিভারপুল, আর এবার দলটিতে আসতে যাচ্ছেন আরেক মিডফিল্ডার ডমিনিক সোবোসলাই। বিবিসি জানিয়েছে, রিলিজ ক্লজের ৭ কোটি ইউরো পরিশোধ করেই আরবি লিপজিগ থেকে তাঁকে আনতে যাচ্ছে লিভারপুল।

২২ বছর বয়সী সোবোসলাই খুব আলোচিত কোনো নাম নয়, তবে আগামী দিনগুলোতে নিজেকে বিশ্বসেরাদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠার পূর্ণ রসদ তাঁর মধ্যে রয়েছে। লিভারপুলে ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীন নিজেকে মেলে ধরার দারুণ এক মঞ্চই এখন পাচ্ছেন সোবোসলাই। লিভারপুলে এসে হঠাৎ আলোচনায় আসা এই হাঙ্গেরিয়ান তরুণের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল আরও আগে। সম্ভবত তাঁর জন্মেরও আগে। ফুটবলটা যে তাঁর রক্তে!

সোবোসলাইয়ের বাবা জোল্ট নিজেও ছিলেন পেশাদার ফুটবলার। হাঙ্গেরির প্রথম সারির লিগ খেলার অভিজ্ঞতা আছে জোল্টের। ছেলেকে নিয়েও ভিন্ন কিছু ভাবেননি বাবা। সোবোসলাইয়ের পায়ে বল তুলে দেওয়ার গল্পটা নাহয় তাঁর বাবার মুখেই শুনুন, ‘ডমিনিক (সোবোসলাই) হাঁটতে শুরুর করার সঙ্গে সঙ্গে আমি তার পায়ে বল তুলে দিই। সে আমার খেলা দেখতে আসত, তাকে দেখে খুব আপ্লুত মনে হতো।’

জার্মান কাপের শিরোপা হাতে সোবোসলাই

২০০৭ সালে জোল্টকে ভিডিওটন ক্লাব ছেড়ে দিলে তিনি নিজেই ফনিক্স গোল্ড নামের একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। সেই ক্লাবের একাডেমিটাই পথ খুলে দেয় সোবোসলাইয়ের জন্য। ফুটবলের সঙ্গে ছেলের সখ্য নিয়ে জোল্ট বলেন, ‘স্কুলে না গেলে তাকে অনুশীলন মাঠেই পাওয়া যেত। আমার মনে নেই, কখনো অন্য কোনো খেলনা তাঁর ছিল কিনা, আমার সব ভাবনা ছিল বলকে ঘিরে।’

সোবোসলাইয়ের শুরুর সময়ে ভিডিওটন (যে ক্লাবটি নামবদলে পরে ফেহারভার হয়ে যায়) ছিল সেকেসফেহেরভার অঞ্চলের ফুটবলার হতে চাওয়া শিশু-কিশোরদের জন্য তীর্থস্থান। যে কারণে তাঁরও সেই একই পথে হাঁটা অনুমেয় ছিল। কিন্তু সোবোসলাই সেটি করেননি, বরং বাবার ক্লাবেই বিকশিত করেছেন নিজেকে। ক্লাব জিমেই নিজের শৈশবের বেশির ভাগ সময় পার করেছেন সোবোসলাই। পাশাপাশি বাবা এবং একদল কোচের তত্ত্বাবধানে নিজেকে গড়ে তুলতে থাকেন স্কুলগামী এই শিশু।

এই ক্লাবে কোচিংয়ের ধরনেও বেশ নতুনত্ব ছিল, যেখানে মূলত কৌশলে মনোযোগ দেওয়া হতো বেশি। অনুশীলনে অনেক সময় খেলোয়াড়দের হাতে গলফ বলও দেওয়া হতো, যেন একে অপরের কাপড় ধরে টানতে না পারে। জোল্ট বলেন, ‘আমার মনোযোগ ছিল খেলোয়াড়দের টেকনিক্যালি দক্ষ করে গড়ে তোলায়। এখানকার দর্শনই ছিল মূলত ফুটবলটা ভালোভাবে খেলা। যখন আপনি দক্ষতায় এগিয়ে থাকবেন তখন খেলাটা আরও উপভোগ্য হবে।’

এই ফুটবল-দর্শন খুব দ্রুত হাঙ্গেরির ফুটবলে নতুন এক ঢেউ নিয়ে আসে। ২০১১ এবং ২০১৩ সালে করডিয়াল কাপের বয়সভিত্তিক শিরোপাও জেতেন সোবোসলাই। শিরোপা জয়ের পথে ফনিক্স গোল্ড হারায় বায়ার্ন মিউনিখ, নরওইচ সিটি, এফসি বাসেল এবং রেড বুল সালজবুর্গের মতো ক্লাবকে। এ সময় সোবোসলাইকে সবাই ডাকত ‘স্মল ওয়ান’ বা ‘ছোট একজন’ নামে। মূলত নিজের বয়সের চেয়ে বেশি বয়সী ফুটবলারদের সঙ্গে খেলতেন বলেই দেওয়া হয়েছিল এই নাম। ফনিক্স গোল্ড ছেড়ে এক মৌসুম তিনি এমকেটি বুদাপেস্টের হয়েও খেলেছেন।

জার্মান কাপ জয়ের পর সোবোসলাই

এসবের মধ্যেই স্কাউটদের নজরে পড়েন সোবোসলাই। এর আগে তিনি অবশ্য ইতালি এবং নেদারল্যান্ডসে গিয়ে ট্রায়ালেও অংশ নেন। তবে তাঁর ভাগ্য নির্ধারিত হয় দেশের হয়ে অনূর্ধ্ব ১৫ দলে খেলার সময়। তাঁর খেলা দেখে সালজবুর্গ তাঁকে দলে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তবে মাত্র ১৫ বছর বয়স হওয়ার কারণে অস্ট্রিয়ান ক্লাবটি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে দলে টানতে পারেনি। নিয়ম অনুযায়ী দলে টানার আগপর্যন্ত অবশ্য সোবোসলাইকে নিয়মিত ট্রায়াল দেওয়ানো হয়েছিল। ১৬ বছর হওয়ার পরই তাঁকে কিনে নেয় তারা। তবে কিছু দিন সালজবুর্গের সহযোগী ক্লাব এফসি লিয়েফেরিংয়েও খেলেছেন সোবোসলাই।

সালজবুর্গের পরিবেশ তাঁর জন্য ছিল একেবারেই নতুন। এর আগে দলে জায়গা পেতে সমস্যায় পড়তে হয়নি তাঁকে। কিন্তু সালজবুর্গে দারুণ কিছু প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি প্রথমবার অনুশীলনে নেমেই মিডফিল্ডে বেশ বিপাকে পড়তে হয় তাঁকে। বেশ বাজেভাবে ট্যাকেল করা হয় তাঁকে। এসবে অবশ্য ভড়কে যাননি সোবোসলাই। আক্রমণের জবাব প্রতি-আক্রমণ দিয়েই দিয়েছেন। যে কারণে অনুশীলন শেষে সেদিন তাঁর প্রতিপক্ষকেই রক্তাক্ত মুখ নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল।

তাঁকে নিয়ে রেড বুলের স্পোর্টিং ডিরেক্ট ক্রিস্তফ ফ্রেউন্ড বলেছেন, ‘সে একেবারে তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে রেড বুলে আসে। সে সময়েই সে দারুণ প্রতিভাবান ছিল। তার আত্মবিশ্বাসও ছিল দারুণ।’ সে সময় কিছু ঘাটতিও ছিল সোবোসলাইয়ের, যা তিনিসব এফসি লিয়েফেরিংয়ে খেলে দূর করেছেন। মানসিকভাবেও সেখানে তিনি দারুণ শক্তি অর্জন করেছেন। লিয়েফেরিংয়ের জার্সিতে মূল দলের হয়ে যখন তাঁর অভিষেক হয়, তখন বয়স আঠারোও হয়নি।’

এর মধ্যে জাতীয় দলের রাডারেও চলে আসেন সোবোসলাই। তাঁর হাত ধরে হাঙ্গেরি যুবদল অনূর্ধ্ব ১৭ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে উত্তীর্ণ হয়। এর ফলে প্রায় এক দশক পর বড় কোনো প্রতিযোগিতায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করে হাঙ্গেরি। এরপর ১৬ বছর বয়সে জাতীয় দলে ডাকও পান। যদিও ২০১৮ সালে হাঙ্গেরির হয়ে অভিষেকও হয় তাঁর। এরপর ধীরে ধীরে নিজেকে হাঙ্গেরির ফুটবলে আশা-ভরসার প্রতীক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করেছেন সোবোসলাই। বয়স ২২ পেরোনোর আগে খেলে ফেলেছেন ৩২ ম্যাচ।

মিডফিল্ডে শক্তি বাড়াতে এর আগে আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার ম্যাক অ্যালিস্টারকে এনেছিল লিভারপুল

তাঁকে দিয়েই হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে দেশটি। একসময় ফেরেঙ্ক পুসকাস ও ন্যান্দর হিদেকুটিরা ফুটবলকে উপহার দিয়েছিলেন হাঙ্গেরিয়ান রোমাঞ্চ। তবে সেসব সুখস্মৃতি কালক্রমে ব্যর্থতার নিচে চাপা পড়ে গেছে। এখন সোবোসলাইকে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে।

অনেকের মতে, ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপে খেলার পর এ ধরনের প্রতিভাবান খেলোয়াড় আর আসেননি। সামনের দিন সেরাদের একজন হওয়ার সামর্থ্য তাঁর ঠিকই আছে। তাঁর সামর্থ্যের ঝলক দেখতে ফিরে যেতে হবে ২০১৯ সালে ইউরো বাছাইয়ের ম্যাচে। সেদিন মদরিচ-ব্রজোভিচদের ক্রোয়েশিয়াকে ২-১ গোলে হারানোর পথে দারুণ নৈপুণ্য দেখান সোবোলাই। সেদিন ম্যাচজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করেন এ তরুণ। এরপর ২০২০ সালে গোল্ডেন বয়ের পুরস্কারের তালিকায় সেরা বিশেও উঠে এসেছিলেন সোবোসলাই।

সালজবুর্গ থেকে ২০২১ সালে লাইপজিগে আসেন সোবোসলাই। জার্মান ক্লাবটির হয়ে গত মৌসুমেও তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। মৌসুমে ৪৬ ম্যাচে ১০ গোলের পাশাপাশি করেছেন ১৩টি অ্যাসিস্টও। জার্মান কাপের শিরোপাও জেতার পাশাপাশি লিপজিগকে বুন্দেসলিগায় পয়েন্ট তালিকার তিন নম্বরে রাখার ক্ষেত্রেও দারুণ ভূমিকা ছিল তাঁর। মিডফিল্ডে প্লে মেক করার পাশাপাশি আক্রমণে গিয়েও ভূমিকা রাখতে পারেন। দলের প্রয়োজনে বের করে আনতে পারেন গোলও। পাসিং ও ফ্রিকিকেও দুর্দান্ত। বৈচিত্র্যই মূলত সোবোসলাইকে নিয়ে এসেছে লিভারপুলে। যেখানে তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জটা এখন মিডফিল্ড নিয়ে লিভারপুল সমর্থকদের হাহাকার মেটানো।