গোল করেই আকাশের দিকে তাকালেন। এরপর প্রার্থনার ভঙ্গিতে বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বললেন ঋতুপর্ণা চাকমা। যেন গোলটা পাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার।
নেপালে মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দুই ম্যাচের কোনোটিতেই একাদশে ছিলেন না ঋতুপর্ণা।
মালদ্বীপের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে বদলি নেমেও তিনি গোল পাননি। তবে পরশু পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামতেই গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। ততক্ষণে অবশ্য বাংলাদেশ পাঁচটি গোল দিয়েছে পাকিস্তানের জালে, জয়ও নিশ্চিত। পরে দলের হয়ে ৬ নম্বর গোলটা করেছেন ঋতুপর্ণা।
গোলটা ঋতুপর্ণা উৎসর্গ করেছেন অকালপ্রয়াত ভাই পার্বণ চাকমাকে। গত ২৯ জুন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন পার্বণ। ভাই হারানোর শোক এখনো লেগে আছে ঋতুপর্ণার চেহারায়। জাতীয় দলের সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল আর হাসিখুশি মেয়েটাই এখন সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকেন। পরশু তিনি গোল পাওয়ার পর টিম বাসে উঠেও অনেকক্ষণ কেঁদেছেন। টিম হোটেলে গিয়েও রাতে কান্নাকাটি করেছেন। কাঠমান্ডুর আর্মি হেডকোয়ার্টার মাঠে গতকাল অনুশীলনের সময় সতীর্থরা হাসি–আড্ডায় মেতে থাকলেও ঋতুপর্ণাকে দেখা গেছে বিষণ্ন।
বাবা ব্রজবাসী চাকমা ক্যানসারে ভুগে মারা গেছেন ২০১৫ সালে। বড় তিন বোন—ভারতী চাকমা, পামপি চাকমা ও পুতুলি চাকমার বিয়ে হয়ে গেছে। চার বোনের এক ভাই হওয়ায় সবচেয়ে আদরের ছিলেন পার্বণ। সেই আদরের ভাইকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন ঋতুপর্ণা।
পার্বণের দুই বছরের বড় ঋতুপর্ণা। পিঠেপিঠি ভাই–বোন হওয়ায় দুজনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। ২০১৭ সালে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে ডাক পাওয়ার পর থেকে ঋতুপর্ণার সব ম্যাচ দেখেছেন পার্বণ। পরশু পাকিস্তানের বিপক্ষে গোলের পর তাই সবার আগে ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়ে ঋতুপর্ণার, ‘ভাইকে কখনো ভুলতে পারি না। প্রতি সেকেন্ডে মনে পড়ে। মনে হয় এখনো আমার পাশে আছে ও। কাল (পরশু) গোল করার পর অনেক কেঁদেছি। মাঠে নামার আগে একটা জেদ ছিল, যেভাবেই হোক গোল পেতে হবে। ভাইকেই গোলটা উৎসর্গ করেছি।’
গত বছর ঢাকায় অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ওই টুর্নামেন্টে ভুটানের বিপক্ষে ১টি ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জোড়া গোল করেন ঋতুপর্ণা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঋতুপর্ণার গোলের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। পরশু পাকিস্তানের বিপক্ষে বক্সের সামান্য বাইরে থেকে নেওয়া ঋতুপর্ণার গোলটা ছিল দেখার মতো। অসাধারণ গোলের পরও আনন্দের বদলে ঋতুপর্ণার কণ্ঠে আফসোস, ‘কাল যদি গোলটা দেখত ভাই, ম্যাচ শেষেই ফোন দিত। অনূর্ধ্ব-১৯ সাফের পর বলত, “দিদি, তুই তো ভাইরাল হয়ে গেছিস। সেলিব্রিটি হয়ে গেছিস।”’
ঋতুপর্ণার সঙ্গে শেষবার পার্বণের কথা হয় ২৮ জুন। ২৩ ও ২৬ জুন মালয়েশিয়ার বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচ শেষ হওয়ার পর জাতীয় দলের ক্যাম্প ছুটি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। ঋতুপর্ণা ২৯ জুন রাঙামাটির উদ্দেশে ঢাকা থেকে বাসে রওনা দেন। সেদিন কেন জানি অজানা আশঙ্কা মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল তাঁর, ‘ও সাধারণত আমাকে কম ফোন করে। সেদিন ফোন করে বলেছিল, “দিদি, তুই কবে আসবি?” ভাই–বোনের এক সঙ্গে ভোটার হওয়ার কথা ছিল। এ জন্য আমি পরদিনই বাসের টিকিট কাটি। বাসে বসে কেমন যেন অস্থির লাগছিল। আগের রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। রুমমেট তহুরাকে (তহুরা খাতুন) আসার আগে বলেছিলাম, আমার কিছু হলে ক্ষমা করে দিস।’
ঋতুপর্ণা যখন বাড়ির পথে, দুর্ঘটনাটা ঘটে তখন। কিন্তু পথের মধ্যে থাকায় তাঁকে দুঃসংবাদ জানানো হয়নি। বাড়িতে গিয়ে জানতে পারেন নির্মম সত্য।
ফুটবলের সুবাদে অনেক দেশে গেছেন ঋতুপর্ণা। ফেরার পথে ভাইয়ের পছন্দের চকলেট নিয়ে যেতেন। কাল বলছিলেন, ‘এবার আমি কার জন্য চকলেট নিয়ে যাব?’ পার্বণের প্রিয় খেলোয়াড় লিওনেল মেসি, ঋতুপর্ণার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এ নিয়ে দুই ভাই–বোনের কত খুনসুটি হয়েছে! সেই স্মৃতি মনে করেন আর কাঁদেন।
মা বোজোপতি চাকমার জন্য বেশি কষ্ট হয় ঋতুপর্ণার, ‘বোনদের তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমি খেলার জন্য বাড়ির বাইরে থাকি। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। মায়ের সামনে কাঁদতে চাই না। কিন্তু হু হু করে কান্না চলে আসে। মা বড্ড একা হয়ে গেল।’
ভাই হারানোর কষ্টটা ভুলতে চান ঋতুপর্ণা ফুটবল মাঠে এসে, ‘এখন আমার অনেক দায়িত্ব। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিই। মাকেও দিই। আমাকে অনেক দূর যেতে হবে। জানি, পেশাদার ফুটবলারের জীবন এমনই। ফুটবল মাঠে নেমে ভাই হারানোর কষ্ট ভোলার চেষ্টা করি। জীবন তো থেমে থাকে না।’
জীবন থেমে থাকে না বলেই ঋতুপর্ণা কাঁদেন, আবার দলকে জিতিয়ে হাসেনও।