ব্রিসবেনে নির্ধারিত সময়ে দুই দল গোলশূন্য। অতিরিক্ত সময়েও স্কোরবোর্ড পাল্টায়নি। রেফারি শেষ বাঁশি বাজানোর পর খেলা গড়ায় স্নায়ুক্ষয়ী টাইব্রেকারে। তখন অস্ট্রেলিয়া কিংবা ফ্রান্স—কোনো দলের কাউকেই খুব একটা ক্লান্ত মনে হয়নি। উজ্জীবিত হয়েই ভাগ্যপরীক্ষায় অংশ নেয় দুই দল। আর সেই স্নায়ুক্ষয়ী ভাগ্যপরীক্ষার পরতে পরতে ছিল রোমাঞ্চ।
‘সাডেন ডেথ’ এ গড়ানো টাইব্রেকারে দুই দল মিলে শট নিয়েছে মোট ২০টি। তাতে শেষ হাসি হেসেছে স্বাগতিকরাই। ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে ৭-৬ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো নারী বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছে অস্ট্রেলিয়া। ছেলে ও মেয়েদের ফুটবল মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।
টাইব্রেকারে ফ্রান্সের ডিফেন্ডার সেলমা বাশার প্রথম শটটিই রুখে দিয়ে ‘অ্যাডভান্টেজ’ আদায় করে নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গোলকিপার ম্যাকেঞ্জি আর্নল্ড। এরপর অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রথম শটে লক্ষ্যভেদ করেন কেইটলিন ফোর্ড। ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায় স্বাগতিকরা। ফ্রান্সের কাদিদিয়াতু দিয়ানি গোল করে ব্যবধান ১-১ করেন। ফ্রান্সের গোলকিপার পলিন পেইরু–মাইনিয়াঁ অস্ট্রেলিয়ার স্টেফ ক্যাটলির শট রুখে দিয়ে নিজেদের পক্ষে ‘অ্যাডভান্টেজ’ আদায় করে নেন। কিন্তু নাটকের তখন কেবল শুরু।
ফ্রান্সের ওয়েন্দি রেনার নিজেদের তৃতীয় শটে গোল করে ব্যবধান ২-১ করেন। অস্ট্রেলিয়ার স্যাম কার এসে সেটা ২-২ করেন। ফ্রান্সের ইউজেনি লে সমার বুদ্ধিদীপ্ত শটে বাঁ পোস্টের পাশ দিয়ে গোল করে ৩-২ করেন। মেরি ফাউলার এসে অস্ট্রেলিয়াকে আবারও (৩-৩) সমতায় ফেরানোর পর ধাক্কা খায় ফ্রান্স। আর সেই ধাক্কাটা দেন অস্ট্রেলিয়ার গোলকিপার আর্নল্ড।
ফ্রান্সের ইভ পেরিসের শট রুখে দেন। এরপর ম্যাকেঞ্জি আর্নল্ড নিজেই যান শট নিতে। লক্ষ্যভেদ করলেই সেমিফাইনাল! না, কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের এই স্ক্রিপ্ট যিনি লিখেছেন, রোমাঞ্চের আরও বাকি রেখেছিলেন। ম্যাকেঞ্জি আর্নল্ড বল পোস্টে মারেন! এরপর ম্যাচ গড়ায় ‘সাডেন ডেথ’ এ। অর্থাৎ, পেনাল্টি নেওয়ার তালিকায় যাঁরা ছিলেন না, তাঁদেরও স্নায়ুক্ষয়ী এই পরীক্ষা দিতে হবে!
গ্রেস জিয়োরোর লক্ষ্যভেদে ৪-৩ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছিল ফ্রান্স। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাটরিনা গোরি ফ্রান্সের গোলকিপার পেইরু-মাইনিয়াঁকে ফাঁকি দিয়ে লক্ষ্যভেদ করে স্বাগতিকদের আশা জিইয়ে রাখেন। এরপর সাকিনা কারশাউয়ি লক্ষ্যভেদে ৫-৪ গোলে এগিয়ে ফ্রান্স। অস্ট্রেলিয়ার টামেকা ইয়ালোপ ঠান্ডা মাথায় বল ক্রসবারের নিচ দিয়ে জালে ঢুকিয়ে ফ্রান্সের খেলোয়াড়দের উত্তেজনার প্রশমন করেন। সে সময় সান কর্প স্টেডিয়ামে দেখার মতো পরিস্থিতি নেমে আসে।
অস্ট্রেলিয়ার কোচ টনি গুস্তাভ দুজন সহকারীকে দুপাশে রেখে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফ্রান্সের কোচ হার্ভে রেনারের চোখেমুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ। কী হয়! কী হয়! এমন পরিস্থিতির মধ্যে গ্যালারিতেও দর্শকেরা প্রচুর চিৎকার চেঁচামেচি করেছেন। তখন অস্ট্রেলিয়ার সমর্থকদের চুপ করিয়ে দেন ফ্রান্সের ম্যালে লাকরার। টাইব্রেকারে লক্ষ্যভেদ করে ফ্রান্সকে ৬-৫ গোলে এগিয়ে দেন।
কিন্তু এলি কার্পেন্টার পরের শটেই গোল করে অস্ট্রেলিয়াকে সমতায় ফেরালে প্রাণ ফিরে আসে ‘মাটিলডা’ সমর্থকদের গ্যালারিতে। এরপর আরেকটু নাটক হয়। ফ্রান্সের কেঞ্জা দালির শট রুখে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গোলকিপার ম্যাকেঞ্জি আর্নল্ড। কিন্তু ভিডিও রিপ্লে দেখে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (ভিএআর) জানিয়ে দেয়, অস্ট্রেলিয়ার গোলকিপার গোললাইন থেকে সামনে এগিয়ে এসেছিলেন। তাই শটটি আবারও নেওয়ার সুযোগ পায় ফ্রান্স।
কিন্তু কেঞ্জা দালি এ যাত্রায়ও ম্যাকেঞ্জি আর্নল্ডকে ফাঁকি দিতে পারেননি! বাঁ দিকে ঝাপিয়ে পড়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ সেভ করেন ম্যাকেঞ্জি। টাইব্রেকারে তখন ৬-৬ গোলের সমতা এবং আবারও নাটক!
অস্ট্রেলিয়ার ক্লেয়ার হান্টের শট বাঁ হাত দিয়ে শেষ মুহূর্তে রুখে দেন ফ্রান্সের গোলকিপার পেইরু-মাইনিয়াঁ। এরপর ফ্রান্সের ১৯ বছর বয়সী নাওমি ফেলার লক্ষ্যভ্রষ্ঠ শট নেওয়ার পর সেমিফাইনাল থেকে শুধু একটি লক্ষ্যভেদের দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল অস্ট্রেলিয়া। কোর্টনি ভাইন এসে ফ্রান্সের গোলকিপারের বাঁ পাশ দিয়ে লক্ষ্যভেদ করেই পাগলাটে ছুট লাগান। জয়! প্রায় ৫০ হাজার দর্শকের সামনে দম বন্ধ করা উত্তেজনার মধ্যে অসাধারণ এক জয়ে শেষ চারে ওঠার পাশাপাশি ঘরের মাটিতে বিশ্বকাপ জয়ের আশাও জিইয়ে রাখল অস্ট্রেলিয়া।
এর আগে নির্ধারিত সময় ও অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে দুই দল প্রানবন্ত ফুটবল খেললেও গোল পায়নি। অস্ট্রেলিয়া ১৫টি শট নিয়ে ৪টি পোস্টের ভেতর রাখতে পেরেছে। ফ্রান্স ২১টি শট নিয়ে পোস্টে রাখতে পেরেছে ৫টি। ২০১১ সালের পর এবার প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে ওঠার স্বপ্ন দেখেছিল ফ্রান্স।