চলতি মৌসুমে লিভারপুল ও মোহাম্মদ সালাহ যেন একে অপরের আয়না। যেখানে একের পারফরম্যান্সের দুরবস্থা প্রতিফলিত হচ্ছে অন্য জনের মধ্যে। প্রিমিয়ার লিগে শিরোপার লড়াইয়ে থাকা দূরে থাক, সেরা চারে থাকাও লিভারপুলের জন্য এখন রীতিমতো এভারেস্ট জয়ের মতো কঠিন। আর লিভারপুলের এমন অসহায়ত্বের প্রতীক গোলমুখে সালাহর পারফরম্যান্স।
লিভারপুলের জার্সিতে নিজের সবচেয়ে বাজে মৌসুমটাই যেন পার করছেন ‘ইজিপশিয়ান কিং’–খ্যাত এই ফুটবলার। কিন্তু কেন? গত মৌসুমেও লিগে যৌথভাবে সর্বোচ্চ ২৩ গোল করা খেলোয়াড়টি এবার কেন গোলের খোঁজে মাথা ঠুকে মরছেন! জানুয়ারি মাসের পুরোটাজুড়েই কোনো গোল পাননি সালাহ। প্রিমিয়ার লিগে ১৯ ম্যাচ শেষে তাঁর গোল মাত্র ৭টি।
নিজের সময়ের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার এরই মধ্যে লিভারপুলের কিংবদন্তি হওয়ার মতো সব রসদ জোগাড় করেছেন। ৩৮ ম্যাচের প্রিমিয়ার লিগ যুগে এখন পর্যন্ত এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ৩২ গোলের মালিকও এই ফরোয়ার্ড। অবশ্য বাস্তবতা হচ্ছে সালাহ সেই সোনালি সময়টাকে এখন হারিয়ে খুঁজছেন। ব্রাইটনের বিপক্ষে গত রোববারের ম্যাচটিতে ফিরে তাকানো যাক। নখদন্তহীন এক তারকাকেই সেদিন গোলের জন্য হন্যে হয়ে থাকতে দেখা গেছে।
শুধু পায়ের কাজেই নয়, সালাহর আত্মবিশ্বাসও ছিল তলানিতে। দলকে বিপদ থেকে টেনে নেওয়ার দিক থেকেও সালাহ যেন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ। কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। সালাহর এমন পারফরম্যান্সের চাপটা পড়েছে লিভারপুলের সামগ্রিক পারফরম্যান্সেও।
অথচ সাদিও মানের বিদায় ও চোট–জর্জর আক্রমণভাগের অভাবটা বুঝতে না দেওয়ার বড় দায়িত্বটা এবার সালাহর ওপরই ছিল। কিন্তু সে দায়িত্বপালনে সালাহকে ব্যর্থই বলতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে সালাহকে মাঠে খুঁজে পাওয়াও অনেক সময় কঠিন হয় পড়ে।
আরেকটু গভীরে গেলে অবশ্য চিত্রটা ভিন্ন মনে হতে পারে। এ মৌসুমে সালাহ একেবারেই যে গোল করেননি, তা নয়। এখন পর্যন্ত মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সালাহর গোল ১৭টি। চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বে যৌথভাবে শীর্ষ গোলদাতাও এই মিসরীয় তারকা।
মৌসুম শেষে এমনও হতে পারে যে সালাহ গত মৌসুমের ৩১ গোলের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। যদিও কাজটা একেবারেই সহজ হবে না। বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সালাহর এই গোলগুলো কি আদৌ কোনো কাজে লেগেছে বা লাগছে? কিংবা গোলমুখে বিধ্বংসী সালাহকে কি আদৌ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে?
আরেকটি দিক থেকে লিভারপুলে সালাহর প্রয়োজনীয়তাটা বোঝা যেতে পারে। এ মৌসুমে ‘অল রেড’দের সবচেয়ে বড় জয়টি এসেছে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে। সেই ম্যাচে জয়সূচক গোলটি এসেছিল এই সালাহর কাছ থেকেই। কিন্তু সেই পারফরম্যান্স আগে–পরে খুব একটা দেখাতে পারেননি সাবেক এই এএস রোমা ফরোয়ার্ড।
এর মধ্যে অবশ্য চ্যাম্পিয়নস লিগে রেঞ্জার্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক এবং লিগে টটেনহামের বিপক্ষে লিভারপুলকে জেতানোর পথে জোড়া গোলের কথা বলা যেতে পারে। তবে সেসব কয়েক মুহূর্তের ঝলকের বেশি কিছু ছিল না। নিজের সেরা সময়ে সালাহ নিয়মিত এমন পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন।
গোল করার পরিসংখ্যানেও সালাহর নিষ্প্রভ থাকার প্রমাণ মিলছে। প্রতি ৯০ মিনিটে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সালাহ গোল করেছেন ০.৩৪টি, যা কিনা এ মৌসুমে যাঁরা ন্যূনতম ৭ গোল করেছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম। আগের পাঁচ মৌসুমে প্রতি ৯০ মিনিটে সালাহর গোল করার হার ছিল ০.৭৫ (২০২১-২২), ০.৬৪ (২০২০-২১), ০.৫৯ (২০১৯-২০), ০.৬১ (২০১৮-১৯) ও ০.৯৯ (২০১৭-১৮)। পাশাপাশি তাঁর গোল রূপান্তরের হার ১৪ শতাংশ। ৭ গোল করাদের মধ্যে সেটিও সবার চেয়ে কম।
সালাহর এ মৌসুমে এমন হতশ্রী পারফরম্যান্সের অন্যতম কারণ হতে পারে লিভারপুলের আক্রমণভাগের অস্থিরতা। গত মৌসুম শেষে ভেঙে গেছে আগের কয়েক মৌসুম ধরে দাপট দেখানো লিভারপুল–ত্রয়ীর মিথস্ক্রিয়া।
গ্রীষ্মের দলবদলে লিভারপুল ছেড়ে বায়ার্ন মিউনিখে পাড়ি জমান সাদিও মানে। দারউইন নুনিয়েজ এবং কোডি গাপকোরা এখনো দলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। এর মধ্যে চোটে পড়ে ভুগেছেন ফরোয়ার্ড লাইনের রবার্তো ফিরমিনো, দিয়েগো জোতা ও লুইস দিয়াজের মতো তারকারা।
আক্রমণভাগে লিভারপুল তারকাদের থিতু হতে না পারার প্রভাব পড়েছে সালাহর পারফরম্যান্সেও। মৌসুমজুড়ে এখন পর্যন্ত কারও সঙ্গে সেভাবে জুটি বেঁধে খেলতে পারেননি সালাহ, যা তাঁর পারফরম্যান্সের পারদকেও নামিয়েছে নিচের দিকে।
শুধু ফরোয়ার্ড লাইনের তারকারাই নন, লিভারপুল মৌসুমের শুরু থেকে যোগ্য মিডফিল্ডারের অভাবে ভুগেছে। মাঝমাঠের এই দুর্দশার প্রভাব দলের অন্য পজিশনগুলোতেও পড়েছে। এটিও সালাহর জ্বলে উঠতে না পারার অন্যতম কারণ।
এর সঙ্গে টানা সাফল্যে আসা ক্লান্তি ও বয়সের প্রসঙ্গও সামনে আনা যেতে পারে। কয়েক মৌসুম ধরে টানা গোলের পর গোল করেছেন সালাহ। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এখন পর্যন্ত তাঁর করা ১৭৩ গোলে লিভারপুলও পূরণ করেছে সাফল্যের বৃত্ত।
আর সেই সাফল্য সালাহর গোল–ক্ষুধাতেও হয়তো বড় প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া সালাহর বয়সও এখন ৩০ পেরিয়েছে। ফুটবলারদের এই বয়স থেকেই ‘বুড়ো’ হওয়ার শুরু। তবে কি সালাহ এখন বয়সে ভারে ন্যুব্জ! চলতি মৌসুমে চোটে না পড়লেও শারীরিকভাবে সালাহকে বেশ ক্লান্তই দেখিয়েছে।
তবে নিজের সেরা অবস্থান থেকে দূরে থেকেও সালাহ এই মৌসুমে লিভারপুলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। এখনো তিনি গোলের জন্য প্রচুর শট নিচ্ছেন, প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে বলও স্পর্শ করছেন অনেক এবং ড্রিবলও করছেন বেশ। তাই লিভারপুলের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এখনো সবচেয়ে বড় ভরসার নামও সালাহ।
এরই মধ্যে অনেক কিছু হাত ফসকে গেছে, বাকি যা আছে তা অর্জনে এবং পারফরম্যান্সের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে লিভারপুল তাকিয়ে থাকবে সালাহর দিকেই। এখন সালাহ কি পারবেন এগিয়ে এসে লিভারপুলের মৌসুমটা বাঁচাতে!