স্কালোনির বিশ্বকাপ জয় অন্য আর্জেন্টাইন কোচদের নিয়েও আগ্রহ বাড়িয়েছে
স্কালোনির বিশ্বকাপ জয় অন্য আর্জেন্টাইন কোচদের নিয়েও আগ্রহ বাড়িয়েছে

১০ লাতিন দেশের ৭টির জাতীয় দলের কোচই আর্জেন্টাইন, কেন এই দাপট

‘এক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নাপিত এখানে আপনার চুল কাটবে’—আর্জেন্টিনার এক সেলুনের বাইরে লেখা আছে এই কথাটি। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বরের পর লাতিন দেশটির প্রায় সব মানুষের ভাবনা অনেকটা এমনই। সবার মাঝেই যেন বিশ্বজয়ের অনুভূতি, সবকিছু যেন ফুটবলময়। বিশ্বকাপ জয় আর্জেন্টিনার ফুটবলের মর্যাদাকে যে কয়েক ধাপ ওপরে নিয়ে গেছে! তবে বিশ্বকাপ জয়ের উপলক্ষ বাদ দিলেও বিশ্বব্যাপী ফুটবলীয় কাঁচামাল সরবরাহে দেশটি বেশ আগে থেকেই সেরাদের তালিকায় ছিল।

কখনো ফুটবল তারকা, আবার কখনো ফুটবল কোচদের মাধ্যমে বিশ্ব ফুটবলে আর্জেন্টিনার উপস্থিতি সব সময় চোখে পড়ার মতোই ছিল। এমনকি আর্জেন্টিনা যখন মাঠে ও মাঠের বাইরে ধুঁকছিল, তখনো দেশটির প্রতিনিধিরা সরব উপস্থিতিতে বিশ্ব ফুটবলকে মাতিয়ে রেখেছেন। ২৮ বছরের শিরোপা–খরা এবং ৩৬ বছর বিশ্বকাপের শিরোপাহীন থেকেও যখন আর্জেন্টিনার ফুটবলপ্রেম কমেনি, বিশ্বসেরার তকমা যে খেলোয়াড় এবং কোচ সরবরাহের ধারাকে আরও ত্বরান্বিতই করার কথা।

দূর বা অদূর ভবিষ্যৎকে পাশে সরিয়ে রেখে বর্তমানে চোখ রাখলেও অবশ্য দেখা যাবে বিশ্বব্যাপী আর্জেন্টাইন কোচদের জয়জয়কার। বিশেষ করে লিওনেল স্কালোনির অভাবনীয় সাফল্য প্রতিদ্বন্দ্বী লাতিন দেশগুলোকেও আর্জেন্টাইন কোচদের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে। যেখানে দ্য সাউথ আমেরিকান ফুটবল কনফেডারেশন বা কনমেবলের ১০টি দেশের ৭টির জাতীয় দলের কোচই এখন আর্জেন্টিনার। যে তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ‘এল লোকো’ খ্যাত মার্সেলো বিয়েলসা। শুক্রবার তাঁকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে।

লিওনেল মেসির সঙ্গে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি

লাতিন ১০ দেশের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই আর্জেন্টিনার কোচ আর্জেন্টাইন লিওনেল স্কালোনি। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের পর হাইপ্রোফাইল কোচ বাদ দিয়ে স্কালোনিকে নিয়োগ দেওয়ায় সমালোচনা হয়েছিল অনেক। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে আর্জেন্টিনার ফুটবলের বাঁকবদলের নেপথ্য নায়ক এখন সেই স্কালোনি। তাঁর অধীনে কোপা আমেরিকা, ফাইনালিসিমার পর বিশ্বকাপ শিরোপাও জিতেছে আর্জেন্টিনা। নিজেকে কিংবদন্তির কাতারে নিয়ে যাওয়া এই কোচকে বাদ দিলেও আরও ৬ লাতিন দেশের কোচ এখন আর্জেন্টাইন।

বলিভিয়ার কোচ গুস্তাভ কস্তাস, চিলির এদোয়ার্দো বেরিজ্জো, কলম্বিয়ার নেস্তোর লরেনৎসো, প্যারাগুয়ের গিলের্মো বারোস শেলোত্তো, উরুগুয়ের মার্সেলো বিয়েলসা এবং ভেনেজুয়েলার ফার্নান্দো বাতিস্তা।

শুধু লাতিন দেশেই নয়, আর্জেন্টাইন কোচদের বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। আর্জেন্টাইন ফুটবলের নান্দনিকতা এবং কোচদের পেশাদার মনোভাবই  তাঁদের প্রতি অন্য দেশগুলোকে আগ্রহী করে তুলেছে। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী পাঁচ শর বেশি আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়, কোচ, শারীরিক প্রশিক্ষক, সহকারী কোচ, সমন্বয়কসহ বিভিন্ন পদে কাজ করে যাচ্ছেন।

আর্জেন্টাইন কোচ মার্সেলো বিয়েলসা

নিজ মহাদেশের বাইরে তাঁরা থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, মরক্কো, কাতার, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছেন। ২০২২ সালের মার্চে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম লা নাসিওনের করা একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১২৬টি দেশের পেশাদার লিগে ৬৩ জন আর্জেন্টাইন কোচ কাজ করছেন। এমনকি বাংলাদেশেও আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানির মতো আর্জেন্টাইন কোচ কাজ করে গেছেন। এখানে বলে রাখা ভালো, গত ২০ বছরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশ জাতীয় দলেই আর্জেন্টাইন কোচ ছিল।

এমন নয় যে শুধু ফলের কারণে আর্জেন্টাইন কোচরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুরত্ব পাচ্ছেন। এর সঙ্গে আরও বেশ কিছু কারণ যুক্ত আছে। কয়েক দিন আগে টিওয়াইসি স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আর্জেন্টাইন কোচদের প্রতি দেশগুলোর আগ্রহের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইকুয়েডরের সাবেক আর্জেন্টাইন কোচ গুস্তাভ আলফারো বলেছেন, ‘আর্জেন্টিনায় খেলাটির বৈচিত্র্যতা, ভিন্নতা, আকস্মিকতা এবং চাহিদার কারণে কোচ হিসেবে আমাদের নিয়ে এত আগ্রহ। মূলত নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার এবং কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতার কারণে আর্জেন্টিনার কোচরা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছেন।’

আর্জেন্টিনার ফুটবলের সমৃদ্ধ ইতিহাসও কোচদের নিয়ে উচ্চ চাহিদার বড় কারণ। বিভিন্ন ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্যে দেশটিতে কোচদের উত্থান ঘটেছে, যাঁরা নিজেদের ব্যক্তিত্ব এবং খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিতও করেছে। আর্জেন্টিনার ফুটবল অনেক বেশি চাহিদাসম্পন্নও বটে।

তাই যাঁরা দেশটির ফুটবলে সাফল্য পেয়েছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতার ভান্ডারও স্বাভাবিকভাবে ব্যাপক। আর আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের খেলার ধরনকে বহন করছে দেশটির কোচদের খেলানোর ধরনকে, যা কিনা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। এর সংযুক্তি আছে দেশটির শিখর এবং প্রকৃতির সঙ্গেও। পাশাপাশি আর্জেন্টাইন কোচরা প্রতিকূলতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন এবং প্রতিটি দেশের বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেন।

কাতার বিশ্বকাপের পর অবশ্য দৃশ্যপট অনেকটা বদলে গেছে। বিশেষ করে লিওনেল স্কালোনির মতো একজন অখ্যাত কোচের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বকাপ জয়ের ঘটনা বিশ্বব্যাপী আর্জেন্টাইন কোচদের মর্যাদাকে চূড়ায় নিয়ে গেছে। স্কালোনির সাফল্য এখন বাকিদের জন্যও মঞ্চটাকে অনেক বড় করে দিয়েছে। পাশাপাশি তাঁদের চাহিদাকেও বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুণ, যা সামনের দিনগুলোতেও আর্জেন্টাইন কোচদের নিয়ে বৈশ্বিক চাহিদাকে আরও অনেক বাড়িয়ে দেবে।