নাপোলিতে ম্যারাডোনার গল্পটা শুধু ভালোবাসার
নাপোলিতে ম্যারাডোনার গল্পটা শুধু ভালোবাসার

ম্যারাডোনা, নাপোলি এবং এক অমর ভালোবাসার গল্প

বলা হয় নাপোলির তিনটি প্রতীক, ‘পিৎজা, ডিয়েগো ম্যারাডোনা এবং ফুটবল।’ এ তিনের বাইরে নাপোলির কোনো অস্তিত্ব নেই।

ম্যারাডোনার নাপোলিতে যাওয়ার কথা ছিল ১৯৭৯ সালে। সেবার হিসাব মেলেনি, মানিকজোড় মিলতে তাই অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও ৫ বছর। বার্সেলোনায় ত্যক্ত-বিরক্ত ম্যারাডোনা দুদণ্ড শান্তি পেতে শেষ পর্যন্ত খুঁজে নেন নাপোলিকে। যেখানে ম্যারাডোনা চেয়েছিলেন নির্বিঘ্নে ফুটবলটা খেলতে। চেয়েছিলেন নাপোলির সবুজ ঘাসের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে। কিন্তু কে জানত, নাপোলি ম্যারাডোনার জন্য এমন কিছু নিয়ে অপেক্ষা করছিল, যা তাঁকে রক্তের সঙ্গে বয়ে যেতে হবে শেষ দিন পর্যন্ত। ঈশ্বরতুল্য ভালোবাসার সঙ্গে ছিল রক্তের সঙ্গে মিশে যাওয়া মাদকও।

দিনটা ১৯৮৪ সালের ৫ জুলাই। গোটা নাপোলি শহর তখন গমগম করছিল ‘ম্যারাডোনা ম্যারাডোনা’ ধ্বনিতে। শুধু নেপলসের সান পাওলো স্টেডিয়ামেই উপস্থিত ছিল ৮০ হাজার মানুষ। গ্যালারির কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। সন্ধ্যা যতই ঘনিয়ে আসছিল, ম্যারাডোনার মুখচ্ছবির ওপর বেলা শেষের আলো যেন প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল নেপলসজুড়ে। মনে হচ্ছিল, নাপোলির আকাশ-বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন ম্যারাডোনা।

সেদিন ম্যারাডোনা কথা বলার আগে শুধু উপস্থিতি দিয়েই পুরো নেপলসকে নিজের বশে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর পরিচিতি অনুষ্ঠানে ধূসর নীলরঙা ট্র্যাকস্যুট-পুমার টি–শার্ট পরে এবং কাঁধে নাপোলির স্কার্ফ ঝুলিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে ম্যারাডোনা উচ্চারণ করলেন, ‘বুয়োনা সেরা, নাপোলিতানি’। অর্থাৎ ‘শুভ সন্ধ্যা, হে নেপলসবাসী।’

ম্যারাডোনা যখন কথা বলছিলেন, তাঁকে নিয়ে বাঁধা গানের সুর আঁছড়ে পড়ছিল নেপলস থেকে বুয়েনস এইরেস পর্যন্ত। সেদিনই মূলত ম্যারাডোনার ওপর থেকে একচ্ছত্র অধিকার হারায় তাঁর জন্মশহর বুয়েনস এইরেস। ম্যারাডোনার হয়ে যান ১১ হাজার কিলোমিটার দূরের আরেকটি শহর নাপোলিরও।

ম্যারাডোনাকে নিয়ে বাঁধা গানের কথাগুলো ছিল এমন, ‘ম্যারাডোনা দায়িত্ব নিল/ এটা এবার না হলে আর কখনোই হবে না/ তোমার আর্জেন্টিনা এখানে/ আমাদের আর তর সইছে না।’ ভক্তদের এমন ভালোবাসার জবাবে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘আমি নাপোলির শিশুদের আদর্শ হতে চাই। কারণ আমি বুয়েনস এইরেসে থাকতে যেমন ছিলাম, তারাও তেমনই।’

১৯৮৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে ইতালীয় ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন ম্যারাডোনা

হ্যাঁ, সেদিনই নাপোলির সব শিশু–কিশোরদের আদর্শে পরিণত হয়েছিলেন ম্যারাডোনা। যারা এখন যৌবন পেরিয়েও ধরে রেখেছেন ম্যারাডোনার স্মৃতিকে। এখনো নাপোলি মানে ম্যারাডোনা। নেপলসের প্রতিটি দেয়ালও দখল করে রেখেছে ম্যারাডোনার ম্যুরাল এবং গ্রাফিতি। সেদিনের শিশুরাই আজ প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ম্যারাডোনাকে।

৮৪–এর জুলাইয়ের মতোই আজও নাপোলি মানেই ম্যারাডোনা। অমলিন ম্যারাডোনা।
ম্যারাডোনার প্রতি নেপলসবাসীর এমন ভালোবাসার কারণও ছিল। ইতালির সবচেয়ে অবহেলিত এবং প্রান্তিক শহর ছিল নাপোলি। তুরিন, মিলান কিংবা রোমার ঝলমলে আলোর বিপরীতে দক্ষিণের শহর নাপোলিকে দেখা হতো এক টুকরো অন্ধকার হিসেবে। ম্যারাডোনা যখন নাপোলিতে আসেন, শহরটির সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ তখন চূড়া স্পর্শ করেছিল। ভেঙে পড়েছিল শহরের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাও। মারামারি-হানাহানি আর মাফিয়াগিরি ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা।

ম্যারাডোনা আসার আগে নাপোলিকে সরাসরি না করে দিয়েছিলেন পাওলো রসির মতো বিখ্যাত ইতালিয়ান তারকা।

এমনকি ম্যারাডোনা আসার আগে নাপোলিকে সরাসরি না করে দিয়েছিলেন পাওলো রসির মতো বিখ্যাত ইতালিয়ান তারকা। রসির নাপোলিকে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে আত্মজীবনী ‘এল ডিয়েগো’তে ম্যারাডোনা লিখেছিলেন, ‘আমি আসার আগে রসি নাপোলিকে না করে দিয়েছিল এটা বলে যে নেপলস তার জন্য নয়। এর কারণ ছিল মাফিয়ারা। সত্য কথা হচ্ছে, আমি আসার আগে কেউ নাপোলিতে আসতে চাইত না।’

এরপর ম্যারাডোনা যখন ভেরোনার মাঠে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলেন, তখন প্রতিপক্ষ সমর্থকেরা পোস্টারে লিখে এনেছিল, ‘ওয়েলকাম টু দ্য নাপোলি।’ এটা ছিল নাপোলিকে বেছে নেওয়ার জন্য ম্যারাডোনার প্রতি কটাক্ষ। কারণ একটাই, মনে করা হতো, নাপোলি তখন বসবাস এবং খেলা কোনোটির জন্যই উপযুক্ত ছিল না।

ওদিকে টানা তিন মৌসুম ধরে অবনমন থেকে বাঁচার জন্য কঠিন সংগ্রাম করে যাচ্ছে নাপোলি। সে সময় দলটির অবস্থা সম্পর্কে ম্যারাডোনা লিখেছিলেন, ‘আমি এটা না জেনেই নাপোলিতে এসেছিলাম যে এটা সিরি ‘বি’র দল। এটা ঠিক যে তারা সিরি ‘আ’তেই ছিল। ইতালির শীর্ষ লিগেই ছিল। কিন্তু তারা দল হিসেবে ‘বি’–এর মানেরই ছিল।’

এমন একটি শহর এবং ক্লাবের জন্য ম্যারাডোনা যে দেবতাতুল্য কেউ হবেন, সেটা তো বলা বাহুল্য। তবে ম্যারাডোনা জানতেন যে এই ভালোবাসা তাঁকে ধরে রাখতে হবে খেলা দিয়েই। নাপোলির ইতিহাস বদলাতে হলে সেটা তাঁকেই নতুন করে লিখতে হবে। পুরো বিষয়টিকে ম্যারাডোনা নিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। এই লক্ষ্য অর্জনে ম্যারাডোনা নিজের শরীর পর্যন্ত বদলে ফেলেছিলেন। ম্যারাডোনা লিখেছিলেন, ‘আমি জানতাম ইতালিয়ান ফুটবলে জেতার জন্য আমার ভিন্ন এক শরীর দরকার।’ এরপর নিজেকে বদলে ফেলার সঙ্গে ইতালির ফুটবলের সব ন্যারেটিভও এক ধাক্কায় বদলে দিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন মহারাজা।

প্রশ্ন হচ্ছে নাপোলিকে কী দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা?

ম্যারাডোনার হাত ধরেই নাপোলি জিতেছিল দুটি সিরি ‘আ’ শিরোপা (১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৯-৯০) এবং ১৯৮৮-৮৯ সালের উয়েফা কাপ। সঙ্গে আরও দুটি ঘরোয়া শিরোপা। অথচ এই কিংবদন্তি নাপোলিতে যাওয়ার আগে দুটি কোপা ইতালিয়া ছাড়া বলার মতো কিছুই ছিল না ক্লাবটির। শুধু এটুকুই নয়, ম্যারাডোনার আগে বা পরে আর কখনো ইউরোপীয় ট্রফিও জেতা হয়নি তাদের। আর সিরি আ’র শিরোপা জিততেও নাপোলিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও ৩৩ বছর।

নাপোলিতে আমার জীবন ছিল অবিশ্বাস্য। আমি বাইরে যেতে পারতাম না। তারা আমাকে এত ভালোবাসত।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা, ফুটবল কিংবদন্তি

এ তো গেল মাঠের অর্জন। মাঠের বাইরে ম্যারাডোনা নেপলসের পড়ে পড়ে মার খেতে মানুষগুলো শিখিয়েছিলেন কীভাবে মাথা তুলে বাঁচতে হয়। কীভাবে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের প্রাপ্য আদায় করে নিতে হয়। ম্যারাডোনাই তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মানুষ হওয়ার অনুভূতি। তাঁকে নেপলসবাসী ভালোবেসেছিল পাগলের মতো। ম্যারাডোনা সেই ভালোবাসার কথা বলেছিলেন এভাবে, ‘নাপোলিতে আমার জীবন ছিল অবিশ্বাস্য। আমি বাইরে যেতে পারতাম না। তারা আমাকে এত ভালোবাসত। আর নেপলসবাসী আপনাকে ভালোবাসে মানে তারা সত্যিই আপনাকে ভালোবাসে!’

কথিত আছে, একবার নেপলসের জয়ের পর রাস্তায় নেমে হুল্লোড় করছিলেন ম্যারাডোনা এবং তাঁর সতীর্থরা। এক বুড়ি লাঠি হাতে রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘এরা কোন শয়তান রে!’ ম্যারাডোনা পাল্টা জবাব দিয়ে বললেন, ‘আমি ডিয়েগো, নেপলসের রাজা।’ বুড়ি এরপর ভালো করে দেখে চিনতে পারলেন—এ তো সত্যিই ম্যারাডোনা। তখন আদর করে দিয়ে বললেন, ‘আরে, এ তো সত্যিই আমাদের রাজা।’ নেপলস এবং ম্যারাডোনার এমন ভালোবাসার গল্প প্রচুর আছে। সেই গল্পগুলোও অমরত্ব দিয়েছিল ম্যারাডোনাকে। ফলে তাঁর মৃত্যুর পর বুয়েনস এইরেস যতটা শোকে ডুবে গিয়েছিল, তেমন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল নেপলসও।

নেপলসে ম্যারাডোনা স্টেডিয়ামের সামনে স্থাপন করা হয়েছিল আর্জেন্টাইন মহাতারকার ভাস্কর্য

একটা সময় ছিল পীর-আউলিয়ারা যেখানে যেতেন, সেখানেও তাঁদের আস্তানা গড়ে উঠত। সেখানেও একইভাবে সম্মানিত হন তাঁরা। ম্যারাডোনাও ছিলেন নেপলসের জন্য তেমনই একজন। হয়তো সেখানে তাঁর সমাধি নেই। কিন্তু শহরের হাওয়া এবং নিশ্বাসে যিনি মিশে আছেন, তাঁর জন্য সমাধির কি দরকার! যার স্থান হৃদয়ে, তাঁকে তো মানুষ নিজেদের অস্তিত্বে বহন করে নিয়ে যাবে।  

নেপলস শহরের মানুষের কাছে ম্যারাডোনা কেমন ছিলেন, তা নিয়ে ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’তে বিখ্যাত উরুগুইয়ান ক্রীড়া সাহিত্যিক এদুয়ার্দো গ্যালেয়ানো লিখেছিলেন, ‘নেপলসে ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন সন্ত ম্যারাডোনা। শুধু তা-ই নয়, সত্যিকারের সন্ত সান গিন্নারোর ম্যারাডোনায়ন করে ছাড়েন নেপলসবাসী।’
গ্যালেয়ানোর ভাষায়, ‘সন্ত গিন্নারো হন সন্ত গিন্নারমান্দো। রাস্তায় তাঁরা এই হাফপ্যান্ট পরা দেবতার (ম্যারাডোনা) ছবি বিক্রি করতেন, যাঁকে আলোকিত করে রাখতেন মাতা মেরি।’ ভাবা যায়, নাপোলি শহরের দেবতার জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা!

একজন মানুষ এমন ভালোবাসা তো শুধু কল্পনাই করতে পারে! এমনকি ১৯৯০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ম্যারাডোনা যখন আর্জেন্টিনার হয়ে খেলতে এসেছিলেন, তখন নাপোলি সমর্থকদের হাতে ব্যানার ছিল, ‘হৃদয়ে ডিয়েগো, প্রাণে ইতালি।’ বা ‘ম্যারাডোনা নেপলস তোমায় ভালোবাসে, কিন্তু ইতালি আমাদের দেশ।’ এই যেন নেপলসবাসীর জন্য ছিল ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষা।

নাপোলিতে ম্যারাডোনার সব স্মৃতিই যে সুখকর ছিল, তা নয়, সেখানেও রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অনেক বিতর্কে জড়িয়ে আছে ম্যারাডোনার নাম, যা ম্যারাডোনার চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। কিন্তু নেপলসের সাধারণ মানুষদের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া ম্যারাডোনার তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি।

সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে সেই মানুষগুলো ম্যারাডোনাকে ভালোবাসেন পাগলের মতো। আজও হয়তো ম্যারাডোনার জন্মদিনে নাপোলির কোনো এক দেয়ালচিত্রের সামনে একটি ফুলের তোড়া রেখে আসতে যাবে নাম না জানা কোনো এক শিশু। যার মধ্য দিয়েই আরও অনেক বছরের জন্য ছড়িয়ে পড়বে ম্যারাডোনার চির অমলিন চেতনা।

যা পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত মিশে থাকবে নাপোলির অস্তিত্বের সঙ্গে।