সে একদিন ছিল বটে! লা লিগা, কোপা দেল রে বা চ্যাম্পিয়নস লিগ...বার্সেলোনার ম্যাচে চোখ রাখলেই দেখা যেত পরিচিত দুটি দৃশ্য। লুইস সুয়ারেজের পাস, তা থেকে লিওনেল মেসির গোল। কখনো আবার ঠিক এর বিপরীত দৃশ্য—মেসির দুর্দান্ত পাস, সেই পাসে সুয়ারেজের দুর্দান্ত ফিনিশিং। ধারাভাষ্যে কান পাতলে শোনা যেত—মেসির অসাধারণ পাস খুঁজে পেয়েছে সুয়ারেজকে। আলতো স্পর্শে সুয়ারেজ তা পাঠিয়ে দিয়েছেন জালে। সুয়ারেজের জন্য এটি যেন ছিল থালায় সাজানো গোল। কখনো আবার শোনা যেত—সুয়ারেজের পাস থেকে বাঁ পায়ের অসাধারণ শটে মেসির গোল! দুটির যেটিই ঘটত, গোলের পর দেখা যেত, মেসি-সুয়ারেজ হাসতে হাসতে করছেন উদ্যাপন।
কী এক অসাধারণ জুটিই না বার্সেলোনায় গড়ে তুলেছিলেন মেসি ও সুয়ারেজ। মেসি তো বার্সেলোনায় তাঁর কৈশোর থেকেই। বার্সার একাডেমি পেরিয়ে ‘সি’ ও ‘বি’ দল মাড়িয়ে আর্জেন্টাইন তারকার বার্সার মূল দলে অভিষেক ২০০৪ সালে। সেই থেকে কাতালান ক্লাবটির আক্রমণভাগে কখনো তিনি জুটি বেঁধেছেন রোনালদিনিওর সঙ্গে, কখনো থিয়েরি অঁরি বা স্যামুয়েল ইতোর সঙ্গে। কিন্তু ২০১৪ বিশ্বকাপের পর সুয়ারেজ যখন বার্সায় নাম লেখান, মেসি তাঁর সঙ্গে যে জুটিটি গড়ে তোলেন, সেটি যেন ছিল ঐশ্বরিক।
মাঠের বাইরে দুজনের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, পালা-পার্বণে তাঁরা যেন হরিহর আত্মা! ব্যস্ততা শেষে খানিক অবসরে তাঁরা মেতে উঠতেন সরস আড্ডায়। মৌসুম শেষের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার বেলায়ও মেসি আর সুয়ারেজ ছিলেন জুটি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখনো মিলিত হয় মেসি ও সুয়ারেজের পরিবার। মাঠের বাইরের এ সম্পর্কের ছাপই যেন পড়ত বার্সেলোনায় দুজনের জুটি বেঁধে খেলায়। মাঠের বাইরের দুজন নিরীহ মানুষ অবশ্য সেখানে প্রতিপক্ষের জন্য হয়ে উঠতেন ভয়ংকর। একসঙ্গে তাঁরা দুজন যে কত দলকে ডুবিয়েছেন আর উড়িয়ে দিয়েছেন, তার হিসাব রাখাও ভার!
মাঠের বাইরে মেসি-সুয়ারেজের জুটি এখনো অক্ষতই আছে। তবে মাঝে মাঠে তাঁদের জুটিতে ধরেছিল ভাঙন। ২০২০ সালে সুয়ারেজকে ছেড়ে দেয় বার্সেলোনা। প্রিয় বন্ধুকে ক্যাম্প ন্যুয়ে ধরে রাখার জন্য তখন বার্সেলোনা-কর্তাদের সঙ্গে মেসির দেনদরবার করার কথাও শোনা গেছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পারেননি, চোখের জলে বার্সা থেকে সুয়ারেজকে বিদায় দিয়েছেন মেসি। আর্থিক অনটনের কারণে পরের বছর মেসিকেও বিসর্জন দিতে হয়েছে বার্সার।
মেসি বার্সা ছেড়ে নাম লেখান পিএসজিতে। সুয়ারেজ তখনো লা লিগার দল আতলেতিকো মাদ্রিদে। ২০২২ সালে আতলেতিকো ছেড়ে উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার নাম লেখান নিজের দেশের ক্লাব নাসিওনালে। সেখান থেকে পরের বছর তাঁর ঠিকানা হয় ব্রাজিলের ক্লাব গ্রেমিও। সেখানে বসেই সুয়ারেজ বলেছিলেন, বার্সেলোনায় থাকতে মেসি আর তিনি মিলে পরিকল্পনা করেছিলেন ক্যারিয়ারের শেষ তাঁরা একসঙ্গে একই ক্লাবে করবেন!
এ বছর মেসি পিএসজি ছেড়ে ইন্টার মায়ামিতে নাম লেখানোর পর থেকেই গুঞ্জন ওঠে—তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্রেই আসবে সেই শুভক্ষণ, সেখানেই হবে মেসি-সুয়ারেজ পুনর্মিলনী, আবার গড়ে উঠবে ‘মে-সু’ বা ‘এমএস’ জুটি! এ গুঞ্জনে একটা সময় ঠান্ডা পানি পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারের বিদেশি খেলোয়াড় কেনার জটিল নিয়ম। অবশেষে নিয়মের সব জট সরিয়ে ডেভিড বেকহামের আংশিক মালিকানার মায়ামি সুয়ারেজের সঙ্গে এক বছরের চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের পরের মৌসুমেই দেখা যাবে পুরোনো সেই মেসি-সুয়ারেজ জুটি।
বার্সেলোনায় থাকতে এ জুটি কত দলের সর্বনাশ করেছেন, সেটা বলা কঠিন। তবে পরিসংখ্যানের খাতা বলে একটা বিষয় যখন আছে, তখন সেটা ঘেঁটে এটা তো অন্তত বের করা যেতে পারে—বার্সেলোনায় একসঙ্গে তাঁরা কত গোল করেছেন, কতটা অ্যাসিস্ট তাঁদের আর দুজনে একসঙ্গে শিরোপাই–বা জিতেছেন কতটি
গোল
বার্সেলোনায় মেসি-সুয়ারেজ একসঙ্গে খেলেছেন ৬ মৌসুম। সেই ৬ মৌসুমে সুয়ারেজ সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ক্লাবটির হয়ে করেছেন ১৯৫ গোল। মেসির গোলসংখ্যা আরও বেশি—২৮০টি। প্রতি মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে দুজনের গোল ৭৯টি করে। দুজনের একসঙ্গে সেরা মৌসুম কেটেছে ২০১৫-১৬-তে। সেবার দুজনে মিলে করেছিলেন ঠিক ১০০ গোল। মেসি ৪১টি, সুয়ারেজ ৫৯। সুয়ারেজ তাঁর ৫৯ গোলের ৪০টিই করেছিলেন লা লিগায়, তা–ও আবার মাত্র ৩৫ ম্যাচে।
অ্যাসিস্ট
বার্সেলোনার হয়ে মাঠে মেসি আর সুয়ারেজের সংযোগটা যেন ছিল অতীন্দ্রিয় দূরানুভূতির মতো! মাঠের যেকোনো প্রান্ত থেকে একজনকে খুঁজে নিত আরেকজনের পাস। এর জন্য একজনের দিকে আরেকজনের তাকানোরও প্রয়োজন ছিল না অথবা প্রয়োজন ছিল না কোনো শব্দ ব্যবহারেরও। বার্সেলোনার হয়ে একসঙ্গে দুজন খেলেছেন ২৫৮ ম্যাচ। একে অপরকে দিয়ে করিয়েছেন ৯৯টি গোল। এই ৯৯ গোলের মধ্যে মেসিকে দিয়ে সুয়ারেজ করিয়েছেন ৪৭টি। আর সুয়ারেজের ৫২টি গোলের উৎস ছিলেন মেসি। বার্সেলোনায় মেসির মোট অ্যাসিস্ট ৩০৩টি। পরিসংখ্যান বলছে, বার্সেলোনায় মেসি তাঁর মোট অ্যাসিস্টের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ করেছেন সুয়ারেজকে।
দুজনের টানা সবচেয়ে বেশি গোল–সহায়তার ঘটনাটি ২০১৯-২০ মৌসুমে। সেবার মেসি ও সুয়ারেজ একে অপরকে টানা ৫ ম্যাচে ৬ গোলে সহায়তা করেন। জুটি হিসেবে দুজনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ম্যাচটি ২০১৮ সালে। সে বছর দেপোর্তিভো লা করুনিয়ার বিপক্ষে বার্সেলোনার ৪-২ গোলের জয়ে মেসিকে গোল-সহায়তার হ্যাটট্রিক করেছিলেন সুয়ারেজ।
ট্রফি
২০১৪ থেকে ২০২০—এই ৬ বছরে বার্সেলোনায় মেসি ও সুয়ারেজ মিলে জিতেছেন ১৩টি ট্রফি। ট্রফি জয়ের দিক থেকে কাতালান ক্লাবটিতে সুয়ারেজ সবচেয়ে সফল তাঁর অভিষেক মৌসুমে। সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগা ও কোপা দেল রে জিতেছেন উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার।
ফুটবল–বিশ্ব এখন দেখার অপেক্ষায় আছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে ইন্টার মায়ামির হয়ে কতটা গোল আর অ্যাসিস্ট করতে পারে এই জুটি আর শিরোপাই–বা জিততে পারে কতটি!