বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে একসময় সবচেয়ে বড় ম্যাচের তকমা পেত আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সাদাকালো এবং আকাশি-নীল পাল্টে এখন আকাশি-নীলের সঙ্গে লালের লড়াই সবচেয়ে আলোচিত। আবাহনী কয়েক বছর ধরে মাঠে ধুঁকতে থাকলেও মোহামেডানের মতো ক্ষয়িঞ্চু হয়ে পড়েনি। মোটামুটি একটা শক্ত জায়গা ধরে রেখেছে।
ধনাঢ্য করপোরেট ক্লাব কিংস প্রথম থেকেই ঐতিহ্যের ধারক আবাহনীর সঙ্গে একটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে গেছে। যেটা আগে আবাহনী-মোহামেডানের মধ্যে ছিল। আগে আবাহনী-মোহামেডান মুখোমুখি হলেই মনে হতো দুই দলের মর্যাদার লড়াই, গত কয়েক বছরে কিংস আর আবাহনী ম্যাচে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি হয়েছে। দুই দলের মধ্যে একটা স্নায়ু চাপ থাকছে। এই স্নায়ুচাপটা সামলাতে পারে কিংস। আবাহনী পারছে না।
আবাহনী-কিংস ম্যাচই এখন ঘরোয়া ফুটবলে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সময়ের দুই সেরা দলের লড়াই এটি। যে লড়াইটা আজ আবার হতে চলেছে। স্বাধীনতা কাপে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে আজ বিকেল চারটায় কিংস অ্যারোনায় মুখোমুখি হবে দুই দল। এর আগে ১২ বার সাক্ষাতে কিংসের জয় ৭টি, আবাহনীর মাত্র ২টি। ৩ ম্যাচ ড্র। সর্বশেষ তিন ম্যাচেই কিংসের কাছে হেরেছে আবাহনী।
৫ বছর আগে ঘরোয়া ফুটবলে কিংসের পথচলা। তখন থেকেই শ্রেষ্ঠত্বের জমিটা হারাতে থাকে আবাহনী। দুই দল প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে। জয়ী দলের নাম আবাহনী। ব্যবধানও ছিল বড়ই, ৩-১। আবাহনীর সানডে সিজোবা করেছিলেন জোড়া গোল। অন্য গোলটি কারভেন্স বেলফোর্টের। কিংসের গোলটি দানিয়েল কলিনদ্রেসের।
একই বছর ২০ ডিসেম্বর স্বাধীনতা কাপের সেমিফাইনালে দ্বিতীয়বার মুখোমুখি দুই দল। ১-১ গোলে ড্র হওয়া সেই ম্যাচে কিংসের গোলদাতা ছিলেন মতিন মিয়া, আবাহনীর বেলফোর্ট। তৃতীয় ম্যাচে এসে আবাহনীকে হারায় কিংস। সেটি ছিল ২০১৮-১৯ প্রিমিয়ার লিগে। নীলফামারীতে কিংস ৩-০ গোলে উড়িয়ে দেয় আবাহনীকে। নাসির চৌধুরী, মতিন মিয়া ও কলিনদ্রেস করেন গোল তিনটি। সেবারই ফিরতি ম্যাচে আবার জয় কিংসের। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বখতিয়ারের গোলে এবার ১-০।
কিংস টানা তৃতীয় জয়টা তুলে নেয় ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি। ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে কিংসের জয় ৩-১ গোলে। গোল করেন জোনাথন, রাউল বেসারা ও ফ্রান্সিসকো তোরেস। পরের ম্যাচে কিংসের জয়ের ব্যবধান আরও বড়। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচে আবাহনীকে কিংস গুঁড়িয়ে দেয় ৪-১ গোলে। জোড়া গোল খালিদ শাফির। টানা চার হারের পর কিংসকে থামাতে পেরেছে আবাহনী। ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রিমিয়ার লিগে দুই দলের ফিরতি ম্যাচ ১-১ ড্র।
পরের ম্যাচে আবাহনী জিতেছে। সেটাও রীতিমতো ৩-০ গোলে। ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ফেডারেশন কাপে ফাইনালে আবাহনী ছিল অপ্রতিরোধ্য। কমলাপুর স্টেডিয়ামে জোড়া গোল করেন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার দরিয়েলতন গোমেজ, যিনি এখন কিংসে। সেটিই কিংসের বিপক্ষে আবাহনীর সর্বশেষ জয়ের আনন্দ।
কিংসের সঙ্গে গত চারটি ম্যাচের তিনটিই হেরেছে আবাহনী। ২০২১-২২ লিগে সিলেটে ২-২ ড্রয়ের পর ফিরতি ম্যাচে কিংস অ্যারেনায় ৩-২ গোলে জয় কিংসের। গত লিগে কুমিল্লায় কিংস জিতেছে ২-১ গোলে। ফিরতি ম্যাচে কিংস অ্যারেনায় কিংসের জয়ের ব্যবধান ১-০। গোল করেছেন দরিয়েলতন। এই হলো কিংস-আবাহনী প্রায় একপেশে লড়াইয়ের খতিয়ান।
দুই দলে মাঠের মতো মাঠের বাইরেও অনেক পার্থক্য। কিংস যে মানের দল গড়ছে, আবাহনী তা পারছে না। কিংসের বাজেট আবাহনীর চেয়ে অনেক বেশি। জাতীয় দলের ১৩ থেকে ১৪ জন এখন এই ক্লাবেই। কিংসের বেঞ্চে বসে থাকেন এমন কয়েকজন, যাঁরা অন্য বড় দলের একাদশে খেলতে পারেন অনায়াসে। মতিন মিয়া মতো স্ট্রাইকার কিংসের একাদশে জায়গা পান না। জাতীয় দলের এক নম্বর স্ট্রাইকার সুমন রেজা গত মৌসুমে কিংসের জার্সিতে সুযোগই পাননি তেমন। যে কারণে এ বছর তিনি দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
কিংস শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকায় দেশসেরাদের দলেই নিচ্ছে না, তাদের ব্যবস্থাপনাও অনেক পেশাদার। পেশাদার কোচিং স্টাফের কথা নাই-বা বলা হলো। ক্লাবটির উচ্চাশা আছে, আছে সুযোগ-সুবিধাও। আছে নিজস্ব মাঠ, যেটা নেই আবাহনীর। এখানেই আবাহনী অনেক পিছিয়ে। কিংস নিজেদের মাঠে খেলে বাড়তি সুবিধা পায়। এখন পর্যন্ত তারা নিজেদের মাঠে কোনো ম্যাচ হারেনি। সুবিধাটা কিংসকে অনেক এগিয়ে দিচ্ছে।
অন্যদিকে আবাহনী পিছিয়ে পড়ছে দিন দিন। দল গঠনে কিংসের মতো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তারা ঢালছে না। কিংস তুলনামূলক ভালো বিদেশি নিতে পারছে। দেশি-বিদেশি মিলিয়ে কিংস আজ দেশে প্রায় অপরাজেয়। তারা লিগ জিতছে ৩-৪ ম্যাচ হাতে রেখেই।
টানা চারটি লিগ জিতে রেকর্ড গড়েছে। টুর্নামেন্টেও দেখাচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব। যেখানে আবাহনীকে অনেক বেশি সংগ্রাম করতে হচ্ছে। গত মৌসুম তো আবাহনী শেষ করেছে কোনো ট্রফি না জিতেই।
এ মৌসুমেও যে জিতবে জোর দিয়ে বলতে পারছে না ধানমন্ডির দলটি। কারণ, গতবারের চেয়েও এবার শক্তি বাড়িয়েছে কিংস। ফলে কিংসই ঘরোয়া ট্রফির সবচেয়ে বড় দাবিদার। কেন আবাহনী পারছে না কিংসের সঙ্গে? জাতীয় দলের সাবেক কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক পার্থক্যটা দেখেন দল গড়াতেই, ‘খেলোয়াড় সংগ্রহে কিংস অনেকটাই এগিয়ে। সেটা স্থানীয় ও বিদেশি দুই ক্ষেত্রেই। কিংস যেমন দল গড়ছে, তেমনটা পারছে না আবাহনী। এটাই মূল কারণ। আর কোচ হিসেবে অস্কার ব্রুজোনও কিংসের একটা শক্তি। অন্যদের চেয়ে তাঁকে এগিয়ে রাখব।’