লিভারপুলে ইয়ুর্গেন ক্লপ অধ্যায় শেষ হয়েছে। ক্লপের শূন্যস্থান পূরণ করার দায়িত্ব আর্নে স্লটের কাঁধে। নতুন কোচ হিসেবে ৪৫ বছর বয়সী স্লটের নাম গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে লিভারপুল।
সর্বশেষ নিজ দেশ নেদারল্যান্ডসের ক্লাব ফেইনুর্ডকে কোচিং করানো স্লট উদ্যমী হিসেবে পরিচিত, যিনি খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সেরাটা আদায় করে নেন এবং টেকসই কাজের নীতিতে বিশ্বাসী।
আর্নে স্লট সম্পর্কে এই ৫ তথ্য আপনার অজানাও থাকতে পারে। চাইলে জেনে নিতে পারেন—
আর্নে স্লটের পুরো নাম আরেন্ড মার্টিন সল্ট। ১৭ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে শীর্ষ স্তরের ফুটবলে তাঁর অভিষেক হয়। ১৯৯৫ সালে যোগ দেন স্বদেশি ক্লাব পিইসি জুয়লেতে। সে সময় তিনি ছিলেন স্ট্রাইকার। গতির চেয়ে কৌশলেই বেশি এগিয়ে ছিলেন। কৌশলী ও দর্শনীয় ফুটবলের কারণে বেশ সুনামও কুড়িয়েছেন। নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রায়াত্ত টেলিভিশন চ্যানেল এনওএসকে একবার তাঁর সাবেক কোচ ইয়ান এভার্স বলেছিলেন, ‘লোকে ভাবত, আর্নে অলস ও শান্ত স্বভাবের। কিন্তু তাদের ধারণা ঠিক ছিল না। (একজন ফরোয়ার্ডের কাছ থেকে) আপনি শুধু স্লাইডিং ট্যাকল আশা করতে পারেন না।’
কৌশলের কারণেই পরবর্তীকালে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ভূমিকায় খেলতে শুরু করেন স্লট। তবে গোল করায় ছিলেন পারদর্শী। পিইসি জুয়লেতে থাকতেই পাসিং দক্ষতাকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যান। ক্লাবটির হয়ে তিন ধাপে ১১ মৌসুম খেলেছেন সল্ট। ২০১৩ সালে এই ক্লাবের জার্সিতেই খেলোয়াড়ি জীবনকে বিদায় বলে দেন। ১১ বছর আগে পিইসি জুয়লে ছাড়লেও তাঁর পাসিং দক্ষতাকে এখনো কাজে লাগান ক্লাবের বর্তমান খেলোয়াড়েরা, যেটি ‘আর্নে স্লট পাস’ নামে পরিচিত।
এ ব্যাপারে স্লটের সাবেক সতীর্থ ব্রাম ফন পোলেন বলেছেন, ‘ওর খেলার ধরনের সঙ্গে “রেশমি” ও “মার্জিত” শব্দ দুটি প্রায়ই ব্যবহার করা হতো। পিইসি জুয়লে এখনো আর্নে স্লট পাস কাজে লাগায়।’ স্লটের পাস অন্যদের চেয়ে আলাদা হওয়ার কারণ, তিনি কিছুটা পেছন দিকে ঘুরে বল বাড়াতেন। এতে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ বোকা বনে যেত এবং সতীর্থ উইঙ্গার বল পেয়ে দৌড়ানোর যথেষ্ট জায়গা পেয়ে যেতেন।
লিভারপুলের পরবর্তী কোচ হিসেবে যখন স্লটকে নিয়ে কানাঘুষা চলছিল, তখন ক্লাবটির সমর্থকেরা তাঁর ফুটবলশৈলীর কিছু নমুনা খুঁজছিলেন। নমুনা হিসেবে তাঁরা আয়াক্সের মাঠে ফেইনুর্ডের ঐতিহাসিক জয়ের পর ড্রেসিংরুমে প্রেরণা জোগানো একটি দলীয় সংলাপের ভিডিও পেয়ে যান, যা তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার করেছিলেন। সেই ভিডিওতে স্লটকে ফেইনুর্ড খেলোয়াড়দের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা প্রতিদিন গাধার খাটুনি করি বলেই যেখানে থাকা উচিত, আজ সেখানে আছি। আর এ কারণেই এখানে আমাদের ভক্তরা না থাকা সত্ত্বেও তোমরা ওদের (আয়াক্সকে) নিজেদের মাঠে হারাতে পেরেছ। তবে এটা বড় ব্যাপার হলেও একটা জয়মাত্র। আমস্টারডামে ১৭ বছর পর প্রথম জয়ের চেয়েও এ মৌসুমে আমাদের লক্ষ্য আরও বড়।’
স্লটের প্রতি আগ্রহ দেখানো প্রথম ইংলিশ ক্লাব কিন্তু লিভারপুল নয়। গত বছরের মার্চে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কোচ আন্তনিও কন্তের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর থেকেই স্লটকে পেতে আদাজল খেয়ে নামে টটেনহাম হটস্পার। একাধিক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমও জানিয়েছিল, টটেনহামের কোচ হয়ে আসছেন স্লট। কিন্তু তিনি হুট করে সিদ্ধান্ত বদলান এবং ফেইনুর্ডের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেন।
পয়েন্ট তালিকার আট নম্বরে থেকে ২০২২-২৩ প্রিমিয়ার লিগ মৌসুম শেষ করায় এবার ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেনি টটেনহাম। ওদিকে ডাচ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেইনুর্ড চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নেয়। সেটাই যে সিদ্ধান্ত বদলানোর কারণ, স্লট সেই সময় তা নিজেই জানিয়েছেন, ‘আমরা জন্য নির্ধারণ ফ্যাক্টর ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা। সত্যিটা হলো আমি ব্যক্তিগতভাবে (ফেইনুর্ডে) দুর্দান্ত সময় কাটাচ্ছি এবং গত দুই মৌসুমে দলকে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি।’
সেল্টিককে হারিয়ে ফেইনুর্ডের চ্যাম্পিয়নস লিগ অভিযানের শুরুটা দারুণ হয়েছিল। প্রথম লেগে হারিয়ে দিয়েছিল লাৎসিওকেও। কিন্তু আতলেতিকো মাদ্রিদের কাছে দুই লেগেই হেরে যাওয়ায় গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে পড়তে হয়।
হাই-প্রেসিং অ্যাটাকিং কৌশলের কারণে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলো এরই মধ্যে স্লটকে ‘নেদারল্যান্ডসের পেপ গার্দিওলা’ নামে ডাকতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে স্লট নিজেও জানিয়েছেন, গার্দিওলা তাঁর রোল মডেল। রোটারডামভিত্তিক ডাচ দৈনিক ‘আলজেমিন ডাগব্লাড’কে গত বছর দেওয়া সাক্ষাৎকারে ম্যানচেস্টার সিটি কোচ গার্দিওলাকে নিয়ে স্লট বলেছিলেন, ‘তাঁর (গার্দিওলার) অধীন খেলোয়াড়দের সব সময় খুব ভালো দেখায়। সেই একই খেলোয়াড়কে তাঁর অধীন খেলার আগে ও পরে (অন্য কোচের অধীন) খারাপ মনে হয়।’
গার্দিওলার ভক্ত হলেও এখন থেকে ম্যানচেস্টার সিটিকে আটকানোর উপায় খুঁজতে হবে স্লটকে। লিভারপুলের হয়ে প্রথম মৌসুমেই তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে গার্দিওলার সিটিকে টানা পঞ্চমবার প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয় থেকে আটকানো।
সুদৃঢ় কাজের নীতিতে বিশ্বাসী স্লট। ভোর হওয়ার আগেই তিনি ফেইনুর্ডের ক্যাম্প পরিচালনা শুরু করতেন, প্রতিটি অনুশীলন সেশন দেখতেন এবং পরের ম্যাচের প্রতিপক্ষ নিয়ে খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করতেন। ‘আলজেমিন ডাগব্লাড’কে স্লট বলেছিলেন, ‘আমি ফেইনুর্ড খেলোয়াড়দের বলে থাকি, প্রতিপক্ষের চেয়ে চার গুণ বেশি গোলের সুযোগ তোমাদের তৈরি করতে হবে এবং দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হবে। এই মৌসুমে আমরা যতগুলো ম্যাচ জিতেছি, সেগুলোর তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছি, আমরা প্রতিপক্ষের চেয়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি দৌড়েছি। যেসব ম্যাচ জিততে পারিনি, সেগুলোতে মাত্র ৩ থেকে ৬ শতাংশ বেশি দৌড়েছি। আমাদের প্রতিটি প্রশিক্ষণ, প্রতিটি আলোচনা অবশ্যই ঠিকঠাক হতে হবে।’
খেলোয়াড়ি জীবনে গতির চেয়ে যিনি কৌশলে বিশ্বাসী ছিলেন, সেই স্লট কোচ হওয়ার পর দৌড়ে বেশি জোর দিয়েছেন। এটা ফেইনুর্ডকে ভালো ফল এনে দিয়েছে, দলের খেলোয়াড়দের শারীরিকভাবে আরও ফিট ও একে-অন্যের প্রতি আরও সহায়ক করে তুলেছে এবং এভাবে খেলেই দলটি প্রায়ই ম্যাচের শেষ দিকে গোল পেয়েছে।
সাবেক সতীর্থ ফল পোলেন স্লটের কোচিং নিয়ে বলেছেন, ‘ওর চাওয়া ছেলেদের ফিট থাকতে হবে, যা সে আগে পেত না। আমি জানি না (আগে) সে কখনো জিমের ভেতরটা দেখেছে কি না।’