শেষ হয়েছে পিএসজি, কিলিয়ান এমবাপ্পে ও রিয়াল মাদ্রিদের ত্রিমুখী লড়াই। রিয়ালের সঙ্গে দুই সপ্তাহ আগেই চুক্তি সম্পন্ন করেছেন এই ফরাসি তারকা। লম্বা সময় নাটকীয়তার পর এমবাপ্পে–রিয়ালের মধুর মিলনের খবর নিশ্চিত করেছে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কা।
স্প্যানিশ এই সংবাদমাধ্যম আজ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগামী ১ জুলাই থেকে এমবাপ্পে আনুষ্ঠানিকভাবে রিয়ালের খেলোয়াড় হতে যাচ্ছেন। দর–কষাকষির পর দুই পক্ষ চুক্তির নানা বিষয়ে একমত হয়েছে।
২০১৭ সালে প্রথম এমবাপ্পেকে নিয়ে আগ্রহ দেখায় রিয়াল। তবে ওই সময় রেকর্ড দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামে মোনাকো থেকে পিএসজিতে যোগ দেন বিশ্বকাপজয়ী এই ফুটবলার। যদিও রিয়ালের হয়ে খেলার স্বপ্নটা কখনোই গোপন রাখেননি এমবাপ্পে। ২০২১ সালের জুন থেকে রিয়ালও এমবাপ্পেকে পেতে মরিয়া হয়ে মাঠে নামে। একাধিকবার এমবাপ্পেকে দলে ভেড়ানোর অনেক কাছাকাছিও পৌঁছে গিয়েছিল দলটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি এমবাপ্পের রিয়াল–যাত্রা ঠেকাতে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এমানুয়েল মাখোঁকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল।
এরপর গত গ্রীষ্মেও দেখা মিলেছে নানা নাটকীয়তার। এমবাপ্পে চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত জানানোর পর তাঁকে তখনই ক্লাব ছাড়তে বলা হয়। চুক্তি নবায়ন না করে ক্লাবে থাকলে দল থেকে বাদ পড়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এমবাপ্পে যদি চুক্তি নবায়ন না করে ক্লাবে থাকেন, তাঁকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হবে। সে সময় এমবাপ্পের পিএসজিতে থাকা অসম্ভবই মনে হচ্ছিল। তবে সেই অসম্ভবই অবশ্য পরে সম্ভব হয়েছে এবং এমবাপ্পে পিএসজিতে থেকে খেলাও চালিয়ে যান। জানুয়ারির শুরুতেও বলা হচ্ছিল, এমবাপ্পের নতুন চুক্তি সময়ের ব্যাপার। ছয় মাস পর ফ্রি এজেন্ট হওয়ায় এমবাপ্পে চাইলে আগাম চুক্তি করতে পারেন।
ওই সময় রিয়ালের পক্ষ থেকে তাঁকে সময় বেঁধে দেওয়ার কথাও শোনা গিয়েছিল। যদিও পরে আলোচনার উত্তাপ থেমে যায় সেখানেই। এরপর গত শুক্রবার ইউরোপিয়ান বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানায়, ক্লাব ছাড়ার কথা পিএসজি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন এমবাপ্পে। সিদ্ধান্তটি জানিয়েছেন পিএসজি সতীর্থদেরও। এর মধ্যে রিয়ালে এমবাপ্পের বেতন–জার্সি নম্বরসহ নানা খবর প্রকাশিত হতে থাকে সংবাদমাাধ্যমগুলোয়। তবে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কা এমবাপ্পের রিয়ালে আসার খবরটিকে এবার ‘সিলগালা’ করেছে। নিশ্চিত করেছে আরও দুই সপ্তাহ আগেই চুক্তিপত্রে এমবাপ্পের স্বাক্ষর করার কথা। শুধু তাই নয়, এমবাপ্পে–রিয়ালের চুক্তির বিস্তারিতও তুলে ধরেছে সংবাদমাধ্যমটি।
পিএসজির কাছ থেকে আর কোনো প্রস্তুাব চাননি এমবাপ্পে
মার্কা জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য পিএসজি সভাপতির সঙ্গে দেখা করেন এমবাপ্পে। সে সময় তিনি জানিয়ে দেন, ৩০ জুন ক্লাব ছাড়তে যাচ্ছেন এবং তাঁকে যেন চুক্তি নবায়নের আর কোনো প্রস্তাব দেওয়া না হয়। কারণ, তিনি এরই মধ্যে রিয়ালের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ক্লাবটির সঙ্গে ৫ মৌসুমের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
এমবাপ্পে সিদ্ধান্তটি জানানোর পরও শান্তিপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে দুই পক্ষের আলাপ সম্পন্ন হয়। গত গ্রীষ্মে এমবাপ্পে চুক্তি নবায়ন না করায় পিএসজি সভাপতি নাসের আল খেলাইফি নাকি একরকম নিশ্চিত ছিলেন যে এমবাপ্পেকে ধরে আর হয়তো সম্ভব হবে না। সে সময় কাতারি মালিক বেশি আগ্রহী ছিলেন এমবাপ্পে যেন গ্রীষ্মের সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন। যেখানে তিনি আনুগত্য বোনাসের তৃতীয় কিস্তি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন।
জানুয়ারিতে হলো যোগাযোগ
এমবাপ্পেকে দলে টানার উদ্যোগ পুরোপুরিভাবেই নিয়ম মেনেই শুরু করে রিয়াল। এ ব্যাপারে শুরু থেকেই বেশ সতর্ক ছিল মাদ্রিদের ক্লাবটি। তারা চায়নি ন্যূনতম কোনো অনিয়ম পিএসজিকে অভিযোগ নিয়ে উয়েফা ও ফিফার দুয়ারে যাওয়ার সুযোগ করে দিক। সতর্ক ছিলেন এমবাপ্পে নিজেও। গত জানুয়ারিতে পিএসজির সঙ্গে তাঁর চুক্তি যখন শেষ ছয় মাসের বৃত্তে প্রবেশ করে, তখন এমবাপ্পের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে রিয়াল। এমবাপ্পে এখনো রিয়ালে আসতে চান কি না, সেটি জানতে চেয়েছিল ক্লাবটি। ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পরই মূলত চুক্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয় রিয়াল।
ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি
গত জানুয়ারিতে রিয়ালের হয়ে এমবাপ্পের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন জোসে অ্যাঙ্গেল সানচেজ। তিনিই মূলত রিয়ালের হয়ে দর–কষাকষির কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ফেব্রুয়ারির শুরুতে নতুন করে চুক্তিপ্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানান। এরপর রিয়ালের লক্ষ্য ছিল, যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা ও দর–কষাকষি শেষ করে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের কাজ সম্পন্ন করা। এমবাপ্পেকে তারা তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও পৌঁছে দিয়েছিল।
দেড় বছর আগে তাঁকে কেনার ব্যাপারে রিয়ালের যে মরিয়াভাব ছিল, তা এখন আর নেই। সে সময় যেকোনো মূল্য পরিশোধ করে এমবাপ্পেকে দলে টানার ব্যাপারে যে অবস্থান ছিল রিয়ালের সেখান থেকেও সরে এসেছে ক্লাবটি। ফলে যদি সব কিছু ঠিকঠাকভাবে যদি সম্পন্ন হয় তবে ঠিক আছে, না হলেও কোনো সমস্যা নেই। জুড বেলিংহাম ও ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের মতো তারকাদের নিয়ে ক্লাবটি সন্তুষ্টও। ফলে মাদ্রিদের দিক থেকে কোনো তাড়া ছিল না। তবে রিয়াল চাচ্ছিল ফলাফল যাই হোক, বিষয়টি যেন দ্রুত শেষ হয়।
ক্লাবের মানের সঙ্গে মানানসই বেতন
২০২২ সালে মে মাসে দুই পক্ষ যে বিষয়গুলোয় একমত হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করেই শুরু হয় দর–কষাকষি। পুরো বিষয়টি সরল হলেও কিছু জায়গায় মতবিরোধও ছিল। বিশেষ করে ইমেজ স্বত্বের জায়গা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমস্যা ছিল। রিয়াল এমবাপ্পের শর্তগুলোকে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী করে নিয়েছিল। আর রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের নির্দেশনা ছিল, এমবাপ্পের বেতন এমন হতে হবে যেন তা ক্লাবের সামগ্রিক বেতনকাঠামোয় বড় কোনো প্রভাব না ফেলে। কারণ, সভাপতি ও পরিচালকেরা জানতেন, বেতনের বড় পার্থক্য ড্রেসিংরুমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ চায়নি বেতনের কারণে ক্লাবের ভারসাম্য নষ্ট হোক। যে কারণে তারা এমবাপ্পের মা ফাইজা লামারি ও আইনজীবী ডেলফিন ভেরহেডেনকে জানায়, এমবাপ্পের বেতন ক্লাবের মানদণ্ডের সঙ্গে মানানসই হতে হবে।
কেমন হচ্ছে বেতন
সব কিছু বিষয় ঠিকঠাক করার পর, এটা ঠিক হয় যে এমবাপ্পে স্কোয়াডের সবচেয়ে বেতন পাওয়া খেলোয়াড় হিসেবে রিয়ালে আসবেন। তবে বেতনের পার্থক্য নিশ্চিতভাবেই স্কোয়াডের অন্য শীর্ষ বেতনধারীদের চেয়ে খুব বেশি হবে না। সূত্রের বরাত দিয়ে মার্কা জানিয়েছে, রিয়ালে এমবাপ্পের বেতন হবে বার্ষিক ১ কোটি ৫০ লাখ ইউরো থেকে ২ কোটি ইউরোর মধ্যে, এর সঙ্গে বোনাসও যুক্ত হবে।
এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অন্য তারকাদের যে চুক্তি প্রস্তাব করা হয়েছে, সে অনুযায়ীই সম্পন্ন হয়েছে এ চুক্তি। এর আগে ২০২২ সালে এমবাপ্পের যে চুক্তিপত্র রিয়াল তৈরি করেছিল, সেখানে তাঁর বেতন ধরা হয়েছিল ২ কোটি ৬০ লাখ ইউরো। অন্যদিকে পিএসজিতে চুক্তি নবায়নের পর গত মৌসুমে এমবাপ্পের বেতন গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৩ কোটি ২০ লাখ ইউরো।
সাইনিং বোনাস
ফ্রি এজেন্ট হিসেবে যোগ দিতে যাওয়া এমবাপ্পেকে রিয়াল কী পরিমাণ সাইনিং বোনাস দেবে, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। ২০২১ সালের আগস্টে যখন পিএসজিতে এমবাপ্পের এক বছরের চুক্তি বাকি ছিল, তখন রিয়াল তাদের প্রথমে ১৬ কোটি ইউরো প্রস্তাব করে। কয়েক দিন পর সে অর্থ বাড়িয়ে করা হয় ১৮ কোটি ইউরো। কিন্তু সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি পিএসজি। সে সময় চুক্তি অনুযায়ী এমবাপ্পেকে মাদ্রিদ ১৩ কোটি ইউরো বোনাস দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়। তবে এবার সেই অর্থের পরিমাণও কমতে যাচ্ছে। জানা গেছে, সেই অর্থের পরিমাণ এখন ৫ কোটি ইউরোর নিচে নেমে এসেছে। অথচ দুই মৌসুম আগে পিএসজির সঙ্গে চুক্তি নবায়নে এমবাপ্পে বোনাস হিসেবে পেয়েছিলেন ৬ কোটি ইউরো, সঙ্গে ৮ কোটি ইউরোর আনুগত্য বোনাস তো ছিলই।
ইমেজ স্বত্ব ও পৃষ্ঠপোষক
এমবাপ্পে ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা অর্থনৈতিক ক্ষতি মেনে নিয়েছেন। কারণ, তাঁরা সচেতন ছিল যে কেবল এভাবেই এমবাপ্পের রিয়ালে খেলার স্বপ্নপূরণ হতে পারে। পাশাপাশি এমবাপ্পে মাঠের খেলাকে এ মুহূর্তে বেতনকাঠামোর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তাঁরা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রিয়ালে জুড বেলিংহামের উত্থান এবং বিশ্বমানের খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর মূল্যের পুনর্মূল্যায়নকেও বিবেচনায় নিয়েছেন এমবাপ্পের ঘনিষ্ঠরা। মর্যাদা ও ভাবমূর্তি যতই উজ্জ্বল হবে স্পনসর চুক্তির (পৃষ্ঠপোষক চুক্তি) মানও তত উঁচুতে গিয়ে ঠেকবে। যে কারণে তাঁর আইনজীবী ডেলফিনসহ অন্যরা এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত হওয়া এমবাপ্পে যদি রিয়ালে গিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং ব্যালন ডি’অর জিততে পারেন, তবে তাঁর মূল্য তখন চূড়ায় গিয়ে ঠেকবে।
ফ্লোরেন্তিনো ও এমবাপ্পের সম্পর্ক
অতীতে নানা ঘটনা–দুর্ঘটনার পরও এই চুক্তি আলোর মুখ দেখেছে কেবল এমবাপ্পে ও রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সুসম্পর্কের কারণে। ২০২২ সালের মে মাসে দুজনের টেলিফোন আলাপের মধ্য দিয়ে এ সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। এরপর এমবাপ্পে নিজেই ফোন করে রিয়ালে আসতে না পারা এবং পিএসজির সঙ্গে চুক্তি নবায়নের খবর পেরেজকে দেন। শুরুতে রাগ ও হতাশা থাকলেও পরে তা ঝেড়ে এমবাপ্পেকে দলে ভেড়ানোর কৌশল আঁটতে বসেন রিয়াল সভাপতি। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে এমবাপ্পকে বরণে এখন থেকেই জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে রিয়াল। ইউরো ২০২৪ (১৪ জুন–১৪ জুলাই) ও ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকের (২৪ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট) ব্যস্ত সূচিকে বিবেচনায় এটি পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মার্কা।