আল নাসরের জার্সি হাতে রোনালদো
আল নাসরের জার্সি হাতে রোনালদো

সৌদি আরব ফুটবলের নতুন তীর্থ নাকি ‘বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্র’

একজন তারকা ফুটবলার যখন ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় দাঁড়িয়ে নিজের শেষের চিত্রনাট্য সাজাতে শুরু করেন, তখন ভাবনার করিডরে কী খেলা করে? অবসর তো হাতছোঁয়া দূরত্বে কিন্তু বুট খুলে রাখার আগে আরেকটু পথ তো দৌড়ে নেওয়াই যায়। যে খেলাটাকে আত্মার অংশ করে বেড়ে ওঠা, তাকে আরেকটু ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে সব খেলোয়াড়ের। শেষের আগে যাত্রাপথের স্বল্প দূরত্বটুকু কেউ অতিক্রম করেন শৈশবের ক্লাবে ফিরে গিয়ে। কেউ কেউ আবার বেছে নেন শেষ মুহূর্তে আরেকটু বেশি আয়ের পথকে।

আর্থিক লাভ বিবেচনায় এত দিন পর্যন্ত বিদায় বলার আগে বেশির ভাগ তারকা ফুটবলারের পছন্দের স্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকার (এমএলএস), জাপানি লিগ, চীনা লিগ, এমনকি কেউ কেউ কাতারি লিগকেও নিজেদের গন্তব্যস্থল বেছে নিয়েছেন। তবে তারকাদের নিয়ে এসে পুঞ্জ গড়ার লড়াইয়ে এ মুহূর্তে বাকি সবাইকে টেক্কা দিচ্ছে সৌদি আরবের ফুটবল লিগ।

গত ছয় মাস আগেও যে লিগ নিয়ে কোনো আলাপ ছিল না, তারাই এখন বিশ্ব ফুটবলের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার অপেক্ষায়। প্রশ্ন হচ্ছে, সৌদি প্রো লিগের ভবিষ্যৎ আসলে কী? এটা কি আসলেই ফুটবলের নতুন তীর্থস্থান হয়ে উঠতে যাচ্ছে, নাকি এটা স্রেফ বিদায়লগ্নে থাকা ফুটবলারদের নতুন কোনো পুনর্বাসনকেন্দ্র? যার অবদান হবে এমএলএসের বা জাপানি ক্লাবগুলোর মতো।

সৌদি আরবের ফুটবলের উত্থানের অগ্রনায়ক হিসেবে সবার আগে আসবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নাম। আগামী দিনে সৌদি লিগ যদি ফুটবল দুনিয়ায় ওলটপালট ঘটিয়ে দেয়, তার জন্য প্রশংসা বা নিন্দার সিংহভাগ যাবে রোনালদোর পকেটেই। ফুটবল দুনিয়ায় প্রো লিগের ঝান্ডা সবার আগে গেড়েছেন রোনালদোই। পর্তুগিজ মহাতারকার সৌদি লিগ আসার পথটা অবশ্য খুব সহজ ছিল না।

পিএসজির হয়ে শনিবার শেষ ম্যাচ খেলতে নামবেন মেসি

১২ বছর নিজের পর নিজের উত্থানপর্বের আঁতুড়ঘর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফিরেছিলেন ‘সিআর সেভেন’। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের গল্পটা রাঙাতে পারেননি রোনালদো। উল্টো তিক্ততা বাড়িয়ে মাঝ মৌসুমে ওল্ড ট্রাফোর্ডকে বিদায় জানিয়ে বেছে নেন সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসরকে। সেটিই ছিল ফুটবলে মরুঝড়ের সূচনাপর্ব।

রোনালদো আসতে না আসতেই শুরু হয় লিওনেল মেসিকে নিয়ে গুঞ্জন। এশিয়ার সবচেয়ে সফল ক্লাব আল হিলাল নাকি মেসিকে পেতে টাকার ঝুলি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এরই মধ্যে নাকি সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বিশাল অঙ্কের প্রস্তাব দিয়েছে তারা। এর মাঝে পর্যটনদূত হিসেবে সৌদি আরব ভ্রমণ করে আগুনে ঘি ঢেলেছেন মেসি নিজেই। গতকাল মেসির পিএসজি অধ্যায় শেষের ঘোষণাও দিয়ে দিয়েছেন ক্লাবটির কোচ ক্রিস্তফ গালতিয়ের। আর সব জল্পনা ও গুঞ্জন মেসিকে এখন রিয়াদের বিমানে তুলে দেওয়ার অপেক্ষায়।

অবশ্য মেসি একাই নন, নিঃসঙ্গ রোনালদোকে তারকা-সঙ্গ দিতে কদিনের মধ্যে সৌদি আরবে গিয়ে হাজির হতে পারেন করিম বেনজেমা, লুকা মদরিচ, সের্হিও বুসকেতস, জর্দি আলবা ও সের্হিও রামোসরা। যাঁদের প্রত্যেককে আগামী মৌসুমে দেখা যেতে পারে প্রো লিগে। তবে এই তারকাদের আগমনই শেষ কথা নয়। এটাকে বরং পূর্বলেখ হিসেবে ধরা যেতে পারে, যা আগামী দিনগুলোতে সৌদি আরবের ফুটবল কেন্দ্র হয়ে ওঠার বার্তায় দিচ্ছে। আর এমএলএসের ক্লাবগুলোর সঙ্গে সৌদি প্রো লিগের বড় পার্থক্য মূলত মানসিকতায়। এমএলএসের মতো সৌদি ক্লাবগুলো ইউরোপীয় লিগগুলোর ছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকতে চায় না, যেখানে তারা শুরুটাই করেছে রোনালদো-মেসির মতো তারকাদের দিয়ে।

রিয়াল ছেড়ে সৌদি আরব যাচ্ছেন করিম বেনজেমা

শুধু প্রো লিগে তারকা খেলোয়াড়দের নিয়ে এসে নয়, ইউরোপিয়ান ফুটবলেও নিজেদের প্রভাব রাখতে শুরু করেছে সৌদি আরব। সৌদি মালিকানাধীন ইংলিশ ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেড এরই মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নিয়ে চমক দেখিয়েছে। সৌদি ফুটবলের উত্থানের সঙ্গে এই প্রভাব সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। ফুটবল নিয়ে সৌদি আরবের কৌশলগত অবস্থান সামনের দিনগুলোতে আরও চমক নিয়ে আসতে পারে। সৌদি আরবের ফুটবল নিয়ে মরিয়া হয়ে ওঠার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে।

প্রথমত, ২০৩০ সালের বিশ্বকাপ আয়োজন করতে চায় মরুরাষ্ট্রটি। ফুটবল দুনিয়ার শীর্ষ তারকাদের নিয়ে গিয়ে নিজেদের দাবিকে আরও জোরালো করার চেষ্টার অংশ হতে পারে এটি। সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। সেই সমালোচনার বিপরীতে নিজেদের একটা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তৈরির প্রচেষ্টাও এর পেছনে কাজ করতে পারে। এ ছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নিজেদের আয়কে আরও বহুমুখী খাতে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যও তারকাবহুল লিগ গড়ার কারণ হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারে। পাশপাশি ফুটবলকে ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী দেশ কাতার যেসব সুবিধা পেয়েছে, সেগুলোকে হয়তো নিজেদের জন্যও পেতে চায় দেশটি।

সৌদি লিগের মহাতারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো

কারণ যা–ই হোক, এখনই সৌদি লিগ বিশ্ব ফুটবল অঙ্গনে বড় ধরনের ঝড় তুলেছে। সৌদি লিগের টাকার থলে এমএলএস বা জাপানি লিগ তো বটেই, ইউরোপের পরাশক্তিগুলোকেও রীতিমতো হুমকি দেখাতে শুরু করেছে, যা কিনা ইউরোপিয়ান ফুটবলের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত ফিন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে (এফএফপি) নীতিকে ভাগাড়ে ছুড়ে ফেলতে যাচ্ছে।

কারণ, এই নীতি সৌদি ক্লাবগুলোর জন্য প্রযোজ্য নয়। গোটা ক্লাবের বেতন তারা চাইলে একজন খেলোয়াড়কেই দিয়ে দিতে পারে। আর তাদের দলবদল জুনে শুরু হয়ে চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ফলে খেলোয়াড় কেনাবেচার বাজারে ইউরোপের জন্য মাথাব্যথার বড় কারণ হতে পারে সৌদি লিগ। এরই মধ্যে বেতনের অঙ্ক তারা শুরুই করছে এমন জায়গা থেকে, ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো যা কল্পনাও পারছে না, যা সামনের দিনগুলোতে আরও বড় জটিলতা তৈরি করতে পারে।

তবে সৌদি লিগের এমন আগ্রাসী অবস্থান সাময়িকভাবে ঝড় তুললেও দীর্ঘ মেয়াদে এটি আসলেই বড় প্রভাব রাখতে পারবে কি না, সে আশঙ্কা থেকেই যায়। গোধূলিলগ্নে থাকা রোনালদো-মেসি-বেনজেমারা নিজেদের শেষের কিছু সময় কাটাতে সৌদি আরব যেতে পারেন, যা তাঁদের বড় অঙ্কের অর্থ লাভের সুযোগ করে দিচ্ছে।

কিন্তু একজন তরুণ খেলোয়াড়ের জন্য এখনো ফুটবলের আসল মঞ্চটা ইউরোপই। যে কারণে কিলিয়ান এমবাপ্পে বা আর্লিং হলান্ডকে নিয়ে তেমন কোনো গুঞ্জন নেই। এমনকি নেইমারও নাকি সৌদি লিগের বড় অঙ্কের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ তথ্য জানিয়ে দিচ্ছে, টাকার হাতছানি যেমনই হোক, নিজেদের রাঙাতে এখনো ফুটবলারদের জন্য ইউরোপই শেষ কথা। তাই মরুস্বর্গে সংগ্রামটা শুরু করার পরিবর্তে শেষের রংটা বরং সেখানে গিয়ে ছড়াতে চাইবেন তাঁরা।