বাংলাদেশের ফুটবলে সবচেয়ে বিখ্যাত সহোদর কারা?
এ প্রজন্ম সেভাবে তাঁদের চেনে না। পুরোনো ফুটবলপ্রেমীরা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে খুব বেশি সময় বোধ হয় ব্যয় করবেন না। এখন যে ফুটবলপ্রেমীদের বয়স ষাটের ওপর, তাঁদের কাছে সেই দুই ভাইয়ের কীর্তিগাথা একধরনের নস্টালজিয়া। মনোয়ার হোসেন নান্নু আর শামসুল আলম মঞ্জু এক মায়ের সন্তান হলেও একসময় বাংলাদেশের ফুটবলে তাঁদের মুখোমুখি লড়াই ছিল আলোচনার বিষয়।
একই বাড়ি থেকে একসঙ্গে বের হয়ে দুজনের দুটি পথ আলাদা হয়ে যেত। বেশ কয়েক বছর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান–আবাহনীর লড়াই মানেই ছিল দুই ভাইয়ের দ্বৈরথ। দুজনের মুখোমুখি লড়াইয়ের দিন তাঁদের মা নাকি চাইতেন ম্যাচটা ড্র হোক—এমন কাহিনি এ দেশের পত্রিকায় এসেছে বহুবার।
দুজন একসঙ্গে সতীর্থ হিসেবে খেলেছেন বাংলাদেশের জার্সি পরেও। ২০০৮ সালে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন বড় ভাই, এ দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মনোয়ার হোসেন নান্নু। ছোট ভাই শামসুল আলম মঞ্জু এখন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। তিনিও দেশের ফুটবলের অন্যতম সেরা রাইট ব্যাক।
মনোয়ার হোসেন নান্নু আর শামসুল আলম মঞ্জুর পর আরও কয়েকজন সহোদরের দেখা মিলেছে বাংলাদেশের ফুটবলে। নব্বইয়ের দশকে মোহামেডানের কায়সার হামিদের ছোট ভাই শাহজাহান হামিদ ববিও পরিচিতি পেয়েছিলেন যথেষ্টই। ১৯৯২ সালের লিগে ওয়ারীর কাছে ১–০ গোলে হেরে গিয়েছিল মোহামেডান। সে ম্যাচে বড় ভাই কায়সারকে বোকা বানিয়ে গোল করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন শাহজাহান হামিদ। খুব বেশি দিন খেলেননি শাহজাহান। ২০২২ সালে তিনিও ক্যানসারের কাছে হার মেনে দুনিয়া ছেড়েছেন।
নব্বইয়ের দশকে আরও দুই সহোদরের দেখা মিলেছিল দেশের ফুটবলে—বরুণ বিকাশ দেওয়ান ও অরুণ বিকাশ দেওয়ান। বরুণই ছিলেন বেশি বিখ্যাত। মোহামেডান, আবাহনী ও মুক্তিযোদ্ধায় সুনামের সঙ্গে খেলেছেন রাঙামাটির বরুণ। জাতীয় দলেও নিয়মিত ছিলেন এই লেফট–ব্যাক। গোলকিপার অরুণ মুক্তিযোদ্ধায় খেলেছেন। জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন। ১৯৯৪ সালের দিকে বরুণ–অরুণ দুই ভাই একসঙ্গে খেলেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় দলে।
গতকাল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে বসুন্ধরা কিংস ও চট্টগ্রাম আবাহনীর ম্যাচ আবারও দুই ভাইয়ের লড়াইয়ের সাক্ষী হয়েছে। কিংসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় রাকিব হোসেনের ছোট ভাই সাকিব হোসেন খেলেছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে। যদিও প্রিমিয়ার লিগে এ মৌসুমে দুটি ভিন্ন দলে আছেন আরও দুই ভাই—জাতীয় দলের আরেক নিয়মিত মুখ কিংসের সাদউদ্দিনের ছোট ভাই তাজউদ্দিন খেলছেন শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবে। রাকিব–সাকিবের মতো সাদ আর তাজ এখনো মুখোমুখি হননি। কাল রাকিব–সাকিবের লড়াইয়ে অবশ্য শেষ পর্যন্ত জিতেছেন বড় ভাই রাকিবই। কিংসের ৪–১ গোলের জয়ে একটি গোল ছিল রাকিবের।
রাকিব বেশ কয়েক বছর ধরে বড় নাম। জাতীয় দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, কিংসেরও। গতি আর পায়ের কাজ দিয়ে তিনি নজর কেড়েছেন ফুটবলপ্রেমীদের। ছোট ভাই সাকিবও হঠাৎ করে উঠে আসা কেউ নন। বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলেছেন তিনি। ২০২২ সালে বাহরাইনে এএফসি অনূর্ধ্ব–২০ বাছাইয়ে খেলেছেন দেশের জার্সি গায়ে। আবির্ভাবটা মূলত ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব–১৭ বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ দিয়ে। বরিশাল জেলা দলে খেলেন। পারফরম্যান্স দিয়েই এরপর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ফুটবল কোচ ও সাবেক ফুটবলার আবদুর রাজ্জাকের নজরে পড়েন। সেখান থেকে সোজা ২০২০–২১ সালে দেশের ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নস লিগে সুযোগ মেলে, খেলেছেন উত্তরা ক্লাবে। উইঙ্গার সাকিবকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
প্রিমিয়ার লিগে খেলেন উত্তর বারিধারার হয়ে। গত মৌসুমে প্রায় সব ম্যাচই খেলেছেন। এবার ডাক পেয়েছেন চট্টগ্রাম আবাহনীতে। গতকাল ভাই রাকিবের বিপক্ষে মাঠে নামলেও চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে স্বাধীনতা কাপে খেলেছেন। ফেডারেশন কাপেও একটি ম্যাচ খেলেছেন।
ছোট ভাইকে কেমন দেখলেন রাকিব? প্রথম আলোকে জাতীয় দলের উইঙ্গারের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘মাত্র সুযোগ পেল সাকিব। ওকে অনেক দূর যেতে হবে।’ সাকিবেরও একই অনুভূতি, ‘চট্টগ্রাম আবাহনীর মতো দলে সুযোগ পেয়েছি। এটা কাজে লাগাতে হবে। ভাইয়ের বিপক্ষে খেলাটা অন্যরকম এক অনুভূতি। ভালো লাগত ম্যাচটা জিততে পারলে।’
ভাইকে ম্যাচের আগে কী বলেছিলেন রাকিব, ‘ভাইয়া আমাকে সব সময়ই নানা পরামর্শ দেয়। আজও (কাল) ম্যাচের আগে নানা পরামর্শ দিয়েছে। বলেছে সব সময় কোচের নির্দেশ মেনে চলতে। নিজের মনমতো কিছু যেন না করি, এটা বারবারই বলে। কিংসের বিপক্ষে ম্যাচের আগেও বলেছে। ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সে খেলছে। তার অভিজ্ঞতা আমার কাজে আসবে।’
ভাইয়ের সঙ্গে একই দলে খেলা রাকিবেরও স্বপ্ন, ‘আল্লাহ চান তো ভবিষ্যতে এক দলে খেলার সুযোগ হয়তো মিলবে। তবে আমি চাই, সাকিব নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলুক। ও ছোটবেলা থেকেই ফুটবল ভালোবাসে। বিকেএসপিতে পড়ে নিজেকে তৈরি করছে। আমার তো স্বপ্ন দেশের হয়েই একসঙ্গে খেলা। জানি না, এই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না!’
ছোট ভাইকে নিয়ে রাকিবের স্বপ্ন পূরণ হলে সেটি হবে দেশের ফুটবলের জন্য দারুণ কিছু। রাকিব–সাকিব নিজেদের ‘নান্নু–মঞ্জু’ কিংবা ‘বরুণ–অরুণ’দের মতো সফল সহোদর বানাতে পারেন কি না, গতকালের পর থেকে অপেক্ষা শুরুই হয়ে গেল!